-->

রপ্তানি আয় বাড়লেও অর্থনীতিতে দুশ্চিন্তার ছায়া

জাফর আহমদ
রপ্তানি আয় বাড়লেও অর্থনীতিতে দুশ্চিন্তার ছায়া

জাফর আহমদ: বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার আঘাত সব দেশে। বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচক রপ্তানি খাতেও এ আঘাত লেগেছে। বছরের প্রথম ৪ মাসে রপ্তানি খাত থেকে বাংলাদেশের আয় পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া যায়। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, এ ৪ মাসে এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৭.০১ শতাংশ। অথচ আগের বছরের একই সময়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ২২.৬২ শতাংশ। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় এ বছর প্রবৃদ্ধি কমেছে। এ কারণেই অর্থনীতিতে দুশ্চিন্তার প্রভাব স্পষ্ট হয়েছে। রপ্তানিকারক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রপ্তানি আয়ের এ নেতিবাচক ধারা আগামী মাসগুলোয় আরো স্পষ্ট হবে।

 

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয় হয়েছে ১৬.৮৫ বিলিয়ন ডলার। আগের বছরের একই সময়ে রপ্তানি আয় হয়েছিল ১৫.৭৫ বিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে এবার রপ্তানি আয় বেশি হয়েছে ১.১০৪ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু গত ২০২১-২২ অর্থবছরে তার আগের বছরের চেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২.৯০৫ বিলিয়ন ডলার বা ২২.৬২ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট রপ্তানি আয় হয়েছিল ১২.৮৪৪ বিলিয়ন ডলার। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয়ে বড় ধরনের অগ্রগতির পর এ বছর বড় ধরনের একটি লক্ষ্যও নির্ধারণ করা হয়। করোনা-পরবর্তী বৈশ্বিক অর্থনীতিতে যে পুনরুদ্ধার কার্যক্রম শুরু হয়, তাতে আরো কিছুদিন রপ্তানির উচ্চ প্রবৃদ্ধির আশা তৈরি করে। কিন্তু চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে। জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া ও যোগাযোগ সংকটের কারণে দেশে দেশে মূল্যস্ফীতি চরম আকার ধারণ করে। এতে নাভিশ্বাস ওঠে মানুষের। তৈরি পোশাকসহ বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য যেসব দেশে রপ্তানি হয়, যেসব দেশে মূল্যস্ফীতির ঘা বেশি লাগে। এসব দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। এর আঘাত লাগে রপ্তানি আয়ে। গত বছর বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ে যেখানে ২৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়, এবার সেখানে প্রবৃদ্ধি হয় মাত্র ৭ শতাংশ। অর্থাৎ আগের বছরের চেয়ে এ বছর রপ্তানি আয় কিছুটা বাড়লেও গত বছরের রপ্তানি আয় বৃদ্ধির যে ধারা এবার তা সøথ হয়ে যায়। এ ধারার শুরু সেপ্টেম্বর মাসের রপ্তানি আয় দিয়ে। রাশিয়া-ইউক্রেন অব্যাহত থাকার কারণে খুব শিগগির রপ্তানি বাড়বে সে আশাও অনেকটা ক্ষীণ।

 

রপ্তানি আয়ের এ হ্রাসকে সুদূরপ্রসারী বলে মনে করেন তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) অন্যতম নেতা শোভন ইসলাম। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, সেপ্টেম্বর-অক্টোর দুই মাসে রপ্তানি আয় কমেছে মানে শুধুই দুই মাসের রপ্তানি আয় কমেনি। এর একটি বড় প্রভাব আছে। আমরা আগামী ছয় মাসে কাজের কার্যাদেশগুলো ইতোমধ্যে পেয়েছি। সেখানে দেখা যাচ্ছে, প্রায় ২০ শতাংশ কার্যাদেশে কমেছে। এর অর্থ হলো রপ্তানি আদেশের চিত্র বলে আগামী ৬ মাসের রপ্তানি আয়ে প্রভাব ফেলবে। তবে যুদ্ধ পরিস্থিতির উন্নতি হলে আমেরিকা-ইউরোপের দেশগুলোয় মূল্যস্ফীতি কমলে এবং মানুষের চাহিদা বাড়লে সেক্ষেত্রে রপ্তানি আদেশ বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। কিন্তু বর্তমান যে পরিস্থিতি চলমান, তাতে মনে হচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি যুদ্ধপরিস্থিতির উন্নতি হবে না। ফলে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি হবে, সে আশাও অনেকটা ফিকে। দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক। মোট রপ্তানি আয়ের ৮৫ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক থেকে। চলতি বছরের জুলাই-অক্টোবর চার মাসে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে আয় হয়েছে ১৩.৯৫ বিলিয়ন ডলার। প্রবৃদ্ধির হার ১০.৫৫ শতাংশ। আগের বছর প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২০.৭৮ শতাংশ। রপ্তানিকারকরা বলছেন, সমস্যা এখানেই, যা অক্টোবর মাস থেকে স্পষ্ট হয়েছে। বছরের আগের ৩ মাস উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি হলেও অক্টোবর মাসে ৩ শতাংশে কমে গেছে। জুলাই-আক্টোবর ৪ মাসের গড় হার দাঁড়িয়ে ১০.৫৫ শতাংশে। আগের বছরের অর্ধেক। আগামী মাসগুলোয় এ হার কমে যাবে।

 

রপ্তানি আয়ে আঘাত হানার সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। মূলত জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। রপ্তানির বর্তমান ধারা ধরে রাখতেও গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন করার দাবি জানান বিজিএমইএ পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল।

 

তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, যে কার্যাদেশ আছে, তা আমরা সরবরাহ করা বিদ্যুৎ-গ্যাস দিয়ে চালাতে পারছি না। ডিজেল পুড়িয়ে উৎপাদন করতে হচ্ছে। ক্রাইসিস সময়েও তৈরি পোশাকশিল্প অর্থনীতির লাইফলাইনের ভূমিকা রাখছে। বৈদেশিক মুদ্রার জোগান দিচ্ছে, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখলে বৈশ্বিক মন্দার মধ্যেও আশা জাগিয়ে রাখবে। এজন্য প্রয়োজনে অন্য খাত থেকে গ্যাস-বিদ্যুৎ সরিয়ে উৎপাদন খাতে দিতে হবে। শিল্পকারখানায় উৎপাদন সচল রাখতে সরকারও নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর মধ্যে সাপ্তাহিক বন্ধের দিন এক দিনে না করে ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় ভিন্ন দিনে করেছে; যাতে সব এলাকায় উৎপাদন সচল আছে। ইতোমধ্যে পরিবহনসহ অন্যান্য খাতে জ্বালানি কমিয়ে শিল্প খাতে গ্যাস সরবারের দাবি জানিয়েছে ব্যবসায়ীরা। সরকারও বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। রপ্তানি আয় তথা উৎপাদন অব্যাহত রাখতে সরকোর এমন চিন্তা করছে।

 

এ বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আলোচনায় এ কথাগুলো এসেছে। পরিবহন খাতে গ্যাসের সরবরাহ কমিয়ে শিল্প খাতে বাড়ানো যায় কিনা, বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিবেচনায় নেবে।’

 

ভোরের আকাশ/আসা

 

মন্তব্য

Beta version