-->

পোশাক শিল্প ও বাংলাদেশের অর্থনীতি

এস. এম. আজমাইন ফায়েক
পোশাক শিল্প ও বাংলাদেশের অর্থনীতি

ঢাকা: ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের বিভাগ থেকে সরিয়ে উন্নয়নশীল দেশে নেওয়ার পরামর্শ দেয়। এটি জাতি হিসেবে আমাদের জন্য গর্বের বিষয় বৈকি। তবে এ অর্জনের জন্য আমাদের সময় লেগেছে স্বাধীনতার পর আরও ৫০ বছর।

এটিকে ‘ঐতিহাসিক অর্জন’ বলে মন্তব্য করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে এই তালিকায় রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া, চীন এবং ভিয়েতনামের মতো দেশগুলো। তবে অত্যন্ত নিম্ন আয়ের স্তর থেকে দেশগুলোকে মধ্যম আয়ের অবস্থায় নিয়ে আসার জন্য সর্বোত্তম আধুনিক ট্র্যাক ব্যবহার করতে হয়েছে। সেটা হলো রপ্তানির প্রসার।

যুদ্ধবিধ্বস্ত এক দেশ বাংলাদেশের এই তালিকায় জায়গা করে নিতে লেগেছে ৫০ বছরেরও বেশি সময়। এ দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সবচেয়ে বেশি সাহায্যকারী খাত হচ্ছে পোশাক শিল্প। বাংলাদেশের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান, বৈদেশিক রিজার্ভ ও নারী ক্ষমতায়নের সবকিছু তৈরি পোশাক শিল্পের (আরএমজি) উপর অত্যন্ত নির্ভরশীল, এমনটাই বলছেন অর্থনীতিবিদরা।

বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান পোশাক শিল্পের কারণে, গত দশ বছরে দেশের রপ্তানি ডলারের পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় ৮০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যেখানে ভারত ও পাকিস্তানের রপ্তানি প্রকৃতপক্ষে কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। মার্কিন ডলারে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ২০১১ সালের হিসাবে ভারতের তুলনায় ৪০ শতাংশ কম ছিল। তবে এখন তা ভারতের থেকে বেড়েছে কয়েকগুণ।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ২২৭ মার্কিন ডলার। বর্তমান বাজার দরে বাংলাদেশি মুদ্রায় এই অঙ্ক ১ লাখ ৮৮ হাজার ৮৫০ টাকা। আর প্রতিবেশি দেশ ভারতের মানুষের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৯৪৭ ডলার। বাংলাদেশি টাকায় যা ১ লাখ ৬৫ হাজার ১০৫ টাকা। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের মাথাপিছু আয় ২৮০ ডলার কম। অর্থাৎ ভারতের একজন নাগরিকের চেয়ে বাংলাদেশের একজন নাগরিক এখন বছরে ২৩ হাজার ৭৪৪ টাকা বেশি আয় করেন।

এদিকে কোভিডের জন্য দেশের অর্থনীতিতে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে। তার অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে পোশাক শিল্পের কারণেই। বর্তমানে ৮ হাজার ৬০০টিরও বেশি আরএমজি(রেডি মেড গার্মেন্টস) কারখানা দেশের বৃহত্তম শিল্প খাত গঠন করে এবং এ খাতে জড়িত ৪১ লাখ শ্রমিককে নিয়ে উৎপাদন কর্মসংস্থানের ৩৬ শতাংশ অবদান রাখে। সুশৃঙ্খল ও স্বল্প মজুরির নারী শ্রমিকরা এ শিল্পের মেরুদণ্ড। আরএমজি শিল্প ৬১ শতাংশ নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে।

তবে বেশ কিছু কারণে সম্ভাবনাময় এই শিল্প পিছিয়ে পড়ছে। ফলে ক্ষতি হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, শ্রমিক অসন্তোষ। প্রায়ই দেখা যায় শ্রমিকরা বকেয়া বেতনের দাবিতে কাজ বন্ধ করে রাস্তা অবরোধ করছে। যার কারণে পিছিয়ে যাচ্ছে কাজ। দেশের ভাবমূর্তিও নষ্ট হচ্ছে বাইরের দেশগুলোতে। এজন্য বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশে পোশাক উৎপাদন বন্ধ করে দিচ্ছে।

যদিও আমেরিকা-চীন বাণিজ্য বিরোধের কারণে, অনেক ফ্যাশন কোম্পানি তাদের পণ্য উৎপাদনের ভার দিয়েছে বাংলাদেশকে। তবে ২০১২-২০১৩ সালে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া দুটি শিল্প ট্র্যাজেটি অনেকখানি ক্ষতির মুখে ফেলে দিয়েছিল এই শিল্পকে। তাজরিন ফ্যাশন অগ্নিকাণ্ড ও রানা প্লাজা ট্র্যাজেটির পর আমেরিকান অনেক ফ্যাশন ব্র্যান্ড তাদের বাংলাদেশি সোর্সিং কমিয়ে দিয়েছিল। আবার অনেকে পুরোপুরিভাবে বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশের কাজ। এতে হুমকির মুখে পড়ে দেশের গার্মেন্টস শিল্প। মুখ থুবড়ে পড়তে থাকে অর্থনীতির মানদণ্ড।

ধীরে ধীরে ফিরেছে সুদিন। দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি উন্নত করার প্রয়াসে বিগত দুই বছরে ব্যবসাগুলো সেখানে তাদের সোর্সিং বাড়িয়েছে। বিশেষ করে আমেরিকান জনপ্রিয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড রাল্ফ লরেন। বাণিজ্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে অর্থনৈতিক অবস্থাও। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বছরের প্রথমার্ধে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি মূল্যে ১৪.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

দেশের উন্নয়ন কৌশলের অন্যান্য ইতিবাচক দিকগুলোর মধ্যে আছে অল্প মজুরিতে কমবয়সী শ্রমিক এবং শক্তিশালী ও ক্রমবর্ধমান নারী শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার অনেক উন্নতই বলা যায়। অল্প পারিশ্রমিকেই শ্রমিক পাওয়া যায় খুব সহজেই এবং গার্মেন্টস সেক্টরে এই শ্রমশক্তির যোগানও অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের অবসান গার্মেন্টস সেক্টরে অনেক বেশি। অল্প বেতনে কাজ করছেন তারা।

পুনরায় বাংলাদেশে কাজ দেওয়ার ব্যাপারে দেশের শ্রম ও নিরাপত্তা বিধি পরীক্ষা করছে বাইরের দেশগুলো। ২০১২ সালের নভেম্বরে ঢাকার তাজরিন ফ্যাশন পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ১২০ জন নিহত হয়। পাঁচ মাস পর রানা প্লাজা, যেখানে পাঁচটি পোশাক প্রস্তুতকারক ছিল, ধসে ১ হাজার ১০০ জনেরও বেশি মানুষ মারা যায়। এই দুটি বিপর্যয়ের আগে, কম বেতন, প্রচুর শ্রমিক থাকায় পোশাক উৎপাদনে বাংলাদেশ ছিল একটি শক্তিশালী দেশ।

বাংলাদেশের পরবর্তী পদক্ষেপ হবে ভিয়েতনামের মতো উচ্চমূল্যের উৎপাদন ও রপ্তানির দিকে অগ্রসর হওয়া। এর রপ্তানি খাত এখনো বেশিরভাগ পোশাক শিল্পকে কেন্দ্র করে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রোথ ল্যাবের তথ্য মতে, অর্থনৈতিক জটিলতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ১৩৩ টি দেশের মধ্যে ১০৮ তম স্থানে রয়েছে। যদিও এটি ১৯৯৫ সালের তুলনায় কম।

বাংলাদেশের অর্থনীতির ৮০ শতাংশই আসে পোশাক শিল্প থেকে। এমনকি গত অর্থবছর অর্থাৎ ২০২১ সালের শেষে পোশাক রপ্তানিতে প্রধান প্রতিযোগী ভিয়েতনামের থেকেও বাংলাদেশের ৪৭২ কোটি ডলার রপ্তানি বেড়েছে। ফলে ভিয়েতনামকে টপকে এখন বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানিতে আছে দ্বিতীয় অবস্থানে। প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে বাংলাদেশ ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে আন্তর্জাতিক বাজারে। ঠিক একই সময় ভিয়েতনামের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ১০০ কোটি ডলার। বলাই যাচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা কতটা সচল রেখেছে পোশাক শিল্প। তাই এ ব্যাপারে সরকার ও সংশ্লিষ্টদের আরও মনোযোগী হওয়া দরকার বৈকি।

লেখক: শিক্ষার্থী, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস, ইএমবিএ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য

Beta version