জেনেভা ক্যাম্পে বোমা তৈরির কারখানা

বিস্ফোরণে দুইজনের প্রাণহানি

এমদাদুল হক খান
জেনেভা ক্যাম্পে বোমা তৈরির কারখানা

নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দারা। শুধু তাই নয়, আধিপত্য বিস্তার করতে তারা ক্যাম্পেই বসিয়েছে বোমা তৈরির কারখানা। সম্প্রতি সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ অভিযানে দেশীয় পদ্ধতিতে তৈরি অর্ধশতাধিক ককটেল ও হাত বোমা উদ্ধার করা হয়েছে। এসব বোমা একই ক্যাম্পে বিভিন্ন আস্তানায় বসে বানাচ্ছে বুনিয়া সোহেল ও চুয়া সেলিম গ্রুপের সদস্যরা। গত তিন মাসে ক্যাম্পে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ ও হাত বোমার আঘাতে শিশুসহ সাতজনের প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে বিস্ফোরণের আঘাতেই মারা গেছেন দুইজন। আহত হয়েছেন শিশু-নারীসহ অন্তত শতাধিক মানুষ। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ তথ্য।

জানা যায়, চুয়া সেলিমের নিয়ন্ত্রণে থাকা দুই, চার ও আট নম্বর সেক্টরে বোমা বানাচ্ছে পাঁচজন কারিগর। এর মধ্যে দুই নম্বর সেক্টরে বোমা কারিগর উল্টা সালাম ও পাপ্পুর ছেলে সনু, চার নম্বরে সোহেল কসাই এবং আট নম্বর সেক্টরে গাল কাটা মনু ও কালা ইমরান বোমা বানায়।

মোহাম্মদপুর থানার অফিসার্স ইনচার্জ (ওসি) আলী ইফতেখার জানান, সম্প্রতি রাজ নামে যে ব্যক্তি খুন হয়েছে হাতবোমার আঘাতে, এসব বোমা তারা নিজেরাই তৈরি করছে। গানপাউডার, ভেতরে কিছু লোহার টুকরা ও জর্দ্দার কৌঁটা দিয়ে বানাচ্ছে সেগুলো। তিনি বলেন, আমরা বোমা কারিগরদের তথ্য সংগ্রহ করছি—কারা বোমা বানাচ্ছে এবং কাদের নিয়ন্ত্রণে বোমা বানানো হচ্ছে। কারা ক্যাম্পকে অশান্ত করে তুলছে। ক্যাম্পের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। যতদিন পর্যন্ত ক্যাম্পে অরাজকতা চলবে, ততদিন আমাদের অভিযান চলমান থাকবে।

নাম প্রকাশ না করা শর্তে চুয়া সেলিম গ্রুপের এক সদস্য বলেন, গত মাসে হাত বোমা ও ককটেল বানানোর জন্য পাঁচ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় চুয়া সেলিম গ্রুপের আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী ও পাঁচ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা লাড্ডু কসাই। তিনি বলেন, বোমা অনেকেই বানাতে পারে। তবে এটা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় এখন অল্প কয়েকজন কাজ করে। এর আগে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বোমা বানাতে গিয়ে একজন মারা যায়।

অন্যদিকে বুনিয়া সেলিমের নিয়ন্ত্রণে থাকা ক্যাম্পের সাত ও পাঁচ নম্বর সেক্টরে রয়েছে আরও কয়েকজন বোমাকারিগর। এর মধ্যে ফরিদ, কালো, একগাল ওরফে রাজ, আকরাম, বেজি নাদিম অন্যতম বোমা কারিগর। যদিও গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে বোমার আঘাতেই মারা যায় রাজ ওরফে একগাল। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ক্যাম্পের সাত নম্বর সেক্টরের একটি রেস্তোরাঁয় বসেছিল রাজ। সে সময় একদল লোক অস্ত্রসহ ক্যাম্পে প্রবেশ করে। তাদের মধ্যে মুখোশ পরা এক ব্যক্তি এলোপাতাড়ি বোমা নিক্ষেপ করে। এ সময় রাজের ওপর একটি বোমা বিস্ফোরিত হলে সেখানেই তার মৃত্যু হয়। এছাড়াও ওই সময়ে বেশ কয়েকজন বাসিন্দা বোমার আঘাতে আহত হয়েছেন বলে জানা যায়।

এর আগে ২৪ অক্টোবর হুমায়ুন রোডে ক্যাম্পের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ককটেল বিস্ফোরণে দুইজন আহত হন। আহতরা হলেন—মোটর মেকানিক ওমর ফারুক (২০) ও মাংসের দোকানের কর্মচারী মো. লিটন (৩০)।

আহত লিটনের আত্মীয় মিজানুর বলেন, ক্যাম্পে প্রথম বোমা বিস্ফোরণে রাসেল (৮) নামে এক শিশু মারা যায়। জেনেভা ক্যাম্পের জন্মলগ্ন থেকে কখনও আগ্নেয়াস্ত্র বা ককটেল বোমা নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। সরকার পরিবর্তনের পর থেকে বোমা ও আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে। এমন অশান্তি ক্যাম্পে আগে কখনও দেখেনি বাসিন্দারা।

জেনেভা ক্যাম্পের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সরদার ইব্রাহিম বলেন, গত বৃহস্পতিবার ময়লা পরিষ্কার করতে গিয়ে বোমা বিস্ফোরণে চারজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী গুরুতর আহত হয়েছে। তারা এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এ ঘটনার পর থেকে এখনও অনেকেই ময়লা পরিষ্কারের কাজ করতে চাইছে না। কোন ময়লায় ভাগাড়ে না অবিস্ফোরিত ককটেল পড়ে রয়েছে, এটা তো দেখে বোঝা যায় না।

গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বুনিয়া সোহেল গ্রুপকে ক্যাম্প এলাকা থেকে তাড়িয়ে চুয়া সেলিম গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইলে দুই গ্রুপের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এ সময় স্বয়ংক্রিয় ভারী আগ্নেয়াস্ত্র ও নিজেদের বানানো বোমা ব্যবহার হয়েছে। সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ ও বোমার আঘাতে সাতজন নিহত হয়। তাদের পাঁচজন ক্যাম্পের সাধারণ বাসিন্দা ও দুইজন মাদক কারবারি। এরই মধ্যে ক্যাম্পের শীর্ষ সন্ত্রাসী বুনিয়া সোহেলকে সিলেট থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত দুগ্রুপের শতাধিক সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য