-->

লাক মিয়ার ‘পেটে’ হাজার বিঘা জমি

হেলাল সাজওয়াল
লাক মিয়ার ‘পেটে’ হাজার বিঘা জমি

নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানার ব্রাহ্মন্দি ইউনিয়নের ফকির বাড়ি এলাকার বাসিন্দা আলী ইসলাম। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ওই এলাকার ৬ বিঘা জমিতে বসতবাড়ি গড়ে বসবাস করে আসছিলেন। পুকুর ভরা মাছ আর নানান ফল ও গাছ-গাছালি ঘেরা দৃষ্টিনন্দন বাড়িটির ওপর চোখ পরে ইউনিয়ের চেয়ারম্যান লাখ মিয়ার।

প্রথমে বিভিন্ন জনের মাধ্যমে আলী ইসলামের কাছে বাড়ি বিক্রির প্রস্তাব পাঠায়। ওই প্রস্তাবে সায় না দেওয়ায় ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসের এক রাতে লাক মিয়ার ভাই হক মিয়া কয়েকশ মানুষ নিয়ে সীমানা প্রাচীর ভেঙ্গে প্রথমে আলী ইসলামের পুকুর ও বাগান দখল করে নেয়। রাতারাতি বালু ফেলে পুকুর ভরাট করে ফেলে হক মিয়ার বাহিনী। কয়েকদিনের মাথায় মিথ্যা মামলা দিয়ে আলী ইসলামের পরিবারকে উচ্ছেদ করে পুরো বসতভিটা দখলে নেয় তারা। অন্যত্র জমি দেওয়ার কথা বলে ওই মাসের একদিন রাত তিনটার দিকে আলী ইসলামকে মারধর করে তুলে নেয় হক মিয়ার বাহিনী। পরদিন স্থানীয় সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে নিয়ে আলী ইসলামের কাছ থেকে জোর করে জমি বিক্রির স্বাক্ষর নিয়ে পুরো বসতভিটা নিজের নামে লিখে নেয় হক মিয়া।

আলী ইসলাম ভোরের আকাশকে বলেন, তার সাজানো বসতভিটা হক মিয়া দখল থেকে ফিরে পেতে এলাকার এমপি থেকে প্রভাবশালী অনেকের কাছে গেলেও কোন লাভ হয়নি। তাদের বক্তব্য; লাক মিয়ার মতো প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে তারা কিছু করতে পারবেন না। তারা আইনের আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ দেন। মামলা করার পর লাখ মিয়া পাশ্ববর্তী বিনার চর এলাকায় একটি পুকুর দেখিয়ে সেটি ভরাট করে বসতবাড়ি গড়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, জল দলিলের ওই জমির দাগ-খতিয়ান সবই ভুল। নিজের বসতভিটা হারিয়ে জীবনের ভয়ে আপোষ করে ওই জমিতে ঘর তুলে বসবাস করে আসছি।

নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানার ব্রাহ্মন্দি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান লাখ মিয়া ফিল্মি স্টাইলে এভাবেই একের পর এক পরিবারকে বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করে জমি দখল করে নিচ্ছেন। এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা লাখ মিয়ার কোনো জমির ওপর চোখ পড়লেই মুহূর্তের মধ্যে তা তার দখলে চলে যায়। আইন-আদালতও যেন তার কাছে অসহায়! কোনো কিছুতেই তোয়াক্কা নেই তার।

এলাকাবাসীর ভাষ্য, স্থানীয় প্রভাবশালীদের বড় অংকের অর্থ দিয়ে মুখ বন্ধ রাখেন লাখ মিয়া। এ কারণে এত অপকর্ম করার পরও তার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খোলার সাহস পায় না।

সম্প্রতি জাহের উদ্দিন সরকার (জহির) নামে এক ব্যবসায়ীর জমি জোর করে দখলে নেওয়ার দায়ে স্ত্রীসহ লাখ মিয়া ও তার তিন সহযোগীকে চার বছর করে জেল ও আর্থিক দণ্ড দিয়েছেন আদালত। কিন্তু লাক মিয়াসহ আসামিদের কেউ এখনও গ্রেফতার হননি। দলবল নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখের সামনে দিয়ে এলাকায় প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ান। ওই এলাকার কমপক্ষে হাজার বিঘা জমি অবৈধভাবে দখলে নিয়েছে এই লাক মিয়া। এ যেন লাক মিয়ার ত্রাসের রাজত্ব!

আড়াইহাজার থানার ওসি আহসান উল্লাহ জানান, বিষয়টি এখনও তার কাছে পৌঁছায়নি। ওয়ারেন্ট অফিসারের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে পারবো। আদালতের নির্দেশনা পেলে অবশ্যই তাকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হবে।

আদালতে স্ত্রীসহ তার শাস্তির বিষয় তুলে ধরে বক্তব্য জানতে চাইলে লাক মিয়া ভোরের আকাশকে বলেন, আদালতের বিষয় তিনি দেখবেন। জাহের উদ্দিন সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে প্রতিবেদককে তিনি বলেন, আপোষে জমি দিয়ে দিলে তার (জাহের সরকার) জন্য ভালো হবে। আজ হোক কাল হোক জমি তিনি নেবেন। আইন-আদালত দিয়ে এখানে কিছু হবে না।

এ যেন লাক মিয়ার ত্রাসের রাজত্বএলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ২০ বছর ধরে লাক মিয়া নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানার ব্রাহ্মন্দি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এরও অনেক আগে থেকে মানুষের জমি ও বসতভিটা দখল করে আসছেন তিনি। কাউকে নামমাত্র মূল্য পরিশোধ করে আবার কাউকে কোনো টাকা না দিয়ে জমি নিজের নামে রেজিস্ট্রি করে নিচ্ছে। মানুষের জমি ও বসতভিটা জোর করে সে দখল করেছে। জমি দখল করাই তার নেশা-পেশা। জমি দখলের জন্য এলাকায় গড়ে তুলেছেন নিজস্ব পেটোয়া বাহিনী। এ বাহিনীর নেতৃত্বে তার সহদর হক মিয়া। কখনও রাতের আধারে আবার কখনও দিন-দুপুরে মানুষের জমি দখল করে নেয় এ বাহিনী।

ওই এলাকার বাসিন্দা আবদুল ওয়াদুদ জানান, ২০১২ সালে তার ৩৭ শতাংশ জমি লাক মিয়া জোর করে দখল করে রেখেছে। এ জমি নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে অনেকবার শালিস বৈঠক হয়। কিন্তু জমি ফেরত পেতে মামলা চলছে। তবে এখনও জমিটি ফেরত পাওয়া যায়নি। ওই জমিতে কিছু সবজি আবাদ করতে গেলে গত ইদুল ফিতরের কয়েকদিন আগে হক মিয়ার নেতৃত্বে কয়েকশ দুর্বৃত্ত তাদের ওপর হামলা করে। জমি উদ্ধার করতে না পারার শোকে তার বাবার মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ করেন ওয়াদুদ।

নুর মোহাম্মদ নামে ওই এলাকার আরেকজন বাসিন্দা জানান, তার বাড়ির আশপাশের বিভিন্ন মানুষের সব জমি লাক মিয়া দখল করে নিয়েছে। তার বাড়িও দখল নিতে মরিয়া লাক মিয়া। বাড়ির চারপাশে তিন ফিট উঁচু করে বালু ফেলে ভরাট করে রেখেছে। এখন বাড়ি থেকে বের হওয়া দুরূহ হয়ে পড়েছে। জমি বিক্রির জন্য তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে বাজার মূল্যের তুলনায় অনেক কম দাম অফার করে। এলাকার চেয়ারম্যান হওয়ার কারণে সবাই তাকে ভয় করে। এ কারণে কেউ কোনো প্রতিবাদ করতে পারে না।

ফকির বাড়ীর কুদরত আলী জানান, তাদের প্রায় ১৫ শতাংশ জমি লাক মিয়া দখল করে নিয়েছে। এলাকার এমন আরও অন্তত একশ মানুষের জমি দখল করে নিলেও কেউই লাক মিয়ার বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস পায়নি। মুখ খুললেই হামলার শিকার হতে পারে এ ভয়ে সবাই আতঙ্কিত থাকে।

লাক মিয়ার লাগাম টানলেন একজনজাহের উদ্দীন সরকার (জহির) নামে একজন ব্যবসায়ী ২০১৪ সালের দিকে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানার গোলাকান্দাইল ইউনিয়নের পানাব মৌজায় দুই দলিলে ১৪ ও ৩৭ দশমিক ৫০ শতাংশ জমি ক্রয় করেন। জমির দখল বুঝে নিয়ে প্রথমে রাস্তা থেকে জমিতে প্রবেশ করার জন্য ছোট কালভার্ট নির্মাণ করেন। ক্রয় করা জমির চারদিকে বাউন্ডারি দিয়ে চারটি রুমসহ অবকাঠমো তৈরি করে তা দেখভালের জন্য কিছু কর্মচারী নিয়োগ করেন।

জাহের উদ্দীন সরকার ভোরের আকাশকে বলেন, ২০২১ সালে এক রাতে তার কেয়ার টেকার (জমির তত্ত্বাবধায়ণকারী) মোবাইল ফোনে জানায়, ‘স্যার আপনার জমি কে বা কারা দখল করার জন্য অনেক লোকজন নিয়ে এসেছে। এক্সকেভেটর (ভেকু মেশিন) দিয়ে জমির বাউন্ডারি দেওয়াল ভেঙে ফেলছে।’ পরদিন রূপগঞ্জ থানায় গিয়ে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে বিষয়টি অবগত করি। রূপগঞ্জ থানার কর্মকর্তা আমার অভিযোগ আমলে নিয়ে আমার সাথে কয়েকজন পুলিশ সদস্য দিলে তাদের নিয়ে ক্রয় করা জমিতে উপস্থিত হই। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে তাৎক্ষণিক দখলকারী সবাই পালিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে দেখতে পাই জমির ওপর বাউন্ডারির কোনো চিহ্ন বলতে কিছু নেই। আশপাশের লোক মারফত জানতে পারি; আমার জমি লাক মিয়া নামে এক ব্যক্তি দখল করে নিয়েছে। এর বেশি আর সঠিকভাবে কেউ কিছু জানাতে পারেনি।

কিভাবে লাক মিয়া আমার জমির মালিক হলো তা জানতে রূপগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, শুভ বিশ্বাস নামে এক চায়ের দোকানদারকে আমি জমি বিক্রয়ের জন্য পাওয়ার অব এ্যাটর্নি দিয়েছি। অথচ তার সাথে আমার কোনো পরিচয়ই নেই। শুভ বিশ্বাস ভুয়া পাওয়ার অব এ্যাটর্নির বলে মামুন নামে একজনকে সাব কবলা দিয়েছে। মামুন আবার মাহমুদা বেগমকে (লাক মিয়ার স্ত্রী) হেবাবিল এ্যাওয়াজ করে দিয়েছে। এ ঘটনা জানার পর আমি বাকরুদ্ধ হয়ে যাই।

এর মধ্যে কিছুদিন পর আমি আমার জমিতে কারখানা এবং শেড তৈরির জন্য কয়েক ট্রাক মালামাল রেখে যাই। আবারও লাক মিয়া দলবল নিয়ে গিয়ে আমার কেয়ারটেকারকে ভয় দেখিয়ে ওই সমস্ত মালামাল লুটপাট করে নিয়ে যায়। এ বিষয়ে আমি রূপগঞ্জ থানায় এজাহার দাখিল করি। এরপর রূপগঞ্জ থানা তদন্ত শেষে লাক মিয়ার নামে চার্জশিট দাখিল করে। রূপগঞ্জ থানায় এ মামলা চলমান রয়েছে।

জাহের সরকার আরও বলেন, পরবর্তীতে শীর্ষস্থানীয় এক ব্যক্তি আমাকে লাক মিয়ার হয়ে সমঝোতার জন্য শুক্রবার জুমার নামাজের পর রূপগঞ্জের ভুলতায় যাওয়ার প্রস্তাব দেন। প্রস্তাব অনুযায়ী ওই এলাকায় পৌঁছে ওই ব্যক্তির সঙ্গে বৈঠকে বসার পর তিনি বলেন, ‘লাক মিয়া টানা কয়েকবারের চেয়ারম্যান, প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং ১ হাজার বিঘা জমির মালিক। আপনি বাইরের লোক ঢাকা থেকে এসে জমি ক্রয় করেছেন। এ জমি আপনি ছেড়ে দিবেন এবং লাক মিয়ার সাথে সমঝোতায় বসবেন। ওই বৈঠকে লাক মিয়ার সাথে সমঝোতার প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছি। বলেছিলাম, ধরে নিলাম আমি ওই জমি পাব না; কিন্তু লাক মিয়ার সাথে বেআইনিভাবে সমঝোতায় যাব না। আমি আমার জমি ছেড়ে দিলাম, যেভাবে সে গরিব-দুঃখীদের জায়গা-জমি দখল করে এক হাজার বিঘা জমির মালিক হয়েছে আমারটাও সেভাবে যায় যাক। এ কথা বলে সেখান থেকে চলে আসি।

পরে ১৩ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করি। আদালত মামলা গ্রহণ করে এবং অভিযোগ তদন্তের জন্য পিবিআইকে দায়িত্ব দেয়। পিবিআই প্রায় এক বছর ধরে অনুসন্ধান করে ৯ জনকে বেআইনিভাবে জমি দখলে অভিযুক্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করেন। আদালত ৯ জনের নামে ওয়ারেন্ট জারি এবং বিচারকাজ শুরু করেন। পরে আদালত লাক মিয়া, তার স্ত্রী ও ৩ সহযোগী প্রত্যেককে চার বছর করে দণ্ডাদেশ দেন। একইসঙ্গে অর্থ জরিমানাও করেন। আদালতের রায় অনুযায়ী লাক মিয়ার মতো ভূমিদস্যুর বিচার দাবি করি। যেন দ্রুততম সময়ে তার শাস্তি কার্যকর হয়।

ভোরের আকাশ/ সু

মন্তব্য

Beta version