-->
শিরোনাম

‘শয়তানের নিশ্বাস’ মাদকের বিস্তার বাড়ছে বাংলাদেশে

ইমরান খান
‘শয়তানের নিশ্বাস’ মাদকের বিস্তার বাড়ছে বাংলাদেশে

ইমরান খান: স্কোপোলামিন। এক ভয়ংকর মাদকের নাম। অপরাধজগতে এ মাদকটি ডেভিল ব্রেথ বা শয়তানের নিশ্বাস নামে পরিচিত। এ মাদক প্রয়োগ করে যেকোনো মানুষকে বশীকরণ বা হিপনোটাইজ করা সম্ভব। লাতিন আমেরিকার দেশ কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা, আর্জেন্টিনা, পেরু, চিলি প্রভৃতি দেশে এটি অপরাধীরা বিভিন্ন বয়সিদের বশীকরণ (হিপনোটাইজ) করে যৌনমিলনে বাধ্য করতে স্কোপোলামিন নামের এ মাদক ব্যবহার করে থাকে। বাংলাদেশেও এটির ব্যবহার বাড়ছে। কিছু ইরানি নাগরিক সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্র স্কোপোলামিন বা শয়তানের নিশ্বাস নামের ভয়ংকর এ মাদক ব্যবহার করে হিপনোটাইজ করে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাত্রী ও পথচারীদের সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে।

 

তথ্য বলছে, গত আট মাসে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এ ভয়ংকর মাদক ব্যবহার করে প্রতারণায় জড়িত থাকায় ৬ ইরানি নাগরিকসহ মোট আটজনকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে স্কোপোলামিন ব্যবহার করে লুটপাট ও চুরির ঘটনায় বিদেশি নাগরিকরা জড়িত থাকায় তাদের গ্রেপ্তারে আইনি জটিলতায় পড়তে হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। রাজধানীর পল্লবীর ১২ নম্বরের ডিওএইচএস কমপ্লেক্সের পি অ্যান্ড জেড ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করেন জিসান নামে এক যুবক। চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি বিকেলে বিমানের টিকেট কিনতে আসা দুজন বিদেশি কথা বলার ফাঁকে হঠাৎ করেই ক্যাশ বাক্সে হাত দেন এবং বক্স থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা নিয়ে বেরিয়ে যান ওই দুই বিদেশি। এর কয়েক মিনিট পর জিসান বুঝতে পারলেন তার দোকানে চুরি হয়েছে। তখন জিসানের মাথায় হাত।

 

জিসান জানান, আমার চোখের সামনেই ক্যাশ থেকে টাকা বের করল। আমি সবই দেখছিলাম। কিন্তু তাদের থামাইনি। এমন মনে হচ্ছিল যে আমিও তাদের একজন। এজন্য তাদের সহযোগিতা করছি। কিন্তু এটি কীভাবে হলো তা আজও আমি বুঝতে পারিনি।

 

এ বিষয়ে পল্লবী থানায় লিখিত অভিযোগ করেন প্রতিষ্ঠানটির মালিক রাকিব মিয়া। এরপর তদন্ত শুরু করে পল্লবী থানা-পুলিশ। প্রথমে আশপাশের এলাকার সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে পাওয়া যায় প্রতারকদের গাড়ি নম্বর। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই গাড়িটি উত্তরার ‘গাড়ি ভাড়া ডট কম’ নামের একটি রেন্ট-এ কারের। সেই রেন্ট-এ কারের এক বিদেশি ইরানি পাসপোর্ট জমা দিয়ে গাড়িটি সাত দিনের জন্য ভাড়া নিয়েছেন। পরে সেই রেন্ট-এ কার ও আশপাশের এলাকায় নজরদারি রাখে পুলিশ। ৮ দিন পর গত ২৯ জানুয়ারি সন্ধ্যায় গাড়ি পরিবর্তনের জন্য সেখানে আসেন এক ইরানি নাগরিক। তখন মাইশাম গোরহানি নামে সেই ইরানি নাগরিককে আটক করে পুলিশ। তবে কৌশলে সেখান থেকে পালিয়ে দেশত্যাগ করেন মাইশামের সহযোগী পারভিজ মোহম্মাপুর। পরে এ বিষয়ে পল্লবী থানায় আটক মাইশাম ও তার সহযোগী পারভিজ মোহাম্মপুরের বিরুদ্ধে মামলা করেন পি অ্যান্ড জেড ট্রাভেল এজেন্সির মালিক রাকিব মিয়া।

 

এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকতা পল্লবী থানার উপপরিদর্শক চিন্ময় সরকার বলেন, দুই ইরানি নাগরিক মাইশাম ও তার সহযোগী পারভিজ মোহাম্মপুরের সঙ্গে টঙ্গীর কিছু লোকও চুরির কাজে জড়িত। এরকম চুরির ঘটনায় আমি সর্বপ্রথম ইরানি ১ নাগরিককে গ্রেপ্তার করি। কিন্তু তখন স্কোপোলামিন ব্যবহারের বিষয়টি বুঝে উঠতে পারিনি। পরে যখন দেশের বিভিন্ন স্থানে একইরকম চুরির সঙ্গে ইরানি নাগরিকদের গ্রেপ্তার করা হয়, তখন বিষয়টি আমার কাছে স্পষ্ট হয়। আসামি মাইশাম তার পাসপোর্ট ফিরে পেতে বিভিন্ন জায়গা থেকে ফোন করাচ্ছে। বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করছে।

 

মামলার বাদী রাকিব মিয়া বলেন, ‘শয়তানের নিশ্বাস’ প্রয়োগ করে চুরি ও প্রতারণার অভিযোগে কয়েকজন ইরানি নাগরিক গ্রেপ্তারের সংবাদ বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখার পর বঝতে সমস্যা হয়নি যে তারাও এ একই চক্রের সদস্য। এর মধ্যে ইরান থেকে আমার ফোনে বেশ কয়েকটি ফোনকল আসে। তারা আমার করা মামলায় গ্রেপ্তার মাইশামের সঙ্গে আপস করার জন্য অনুরোধ করছেন। এদের মধ্যে একজন ইরানি নাগরিক মাইশামের টাকা চুরির বিষয় স্বীকার করে সেটা ফেরত দিতে চেয়েছেন।

 

এ ঘটনার ছয় দিন পরই একই কৌশলে প্রতারণার শিকার হন মোহাম্মদপুর বিজলী মহল্লার এ-ব্লকের বাসিন্দা মাহবুবা আক্তার। গত ২৭ জানুয়ারি তার বাড়ির পঞ্চম তলার একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেয়ার জন্য আসেন সেলিম আহমেদ নামে একজন। ফ্ল্যাট দেখে মোটামুটি পছন্দ হয় তার। পরদিন তিনি তার স্ত্রী ও মা পরিচয়ে দুই মহিলাকে নিয়ে আবার ওই বাড়িতে আসেন। তারা ড্রয়িংরুমে বসে কথা বলছিলেন। একসময় মাহবুবা দুই মহিলাকে নিয়ে তার শোয়ার ঘরে যান। একে একে ওই মহিলার হাতে তুলে দেন তার নিজের পরিধেয় হাতের চুড়ি, কানের দুল, আংটিসহ প্রায় ৭ ভরি স্বর্ণালংকার। কিছুক্ষণ পর তারা ওই বাসা থেকে বিদায় নেন। তাদের গেট পর্যন্ত এগিয়েও দেন মাহবুবা আক্তার। প্রায় আধাঘণ্টার পর সব ঘটনা মনে পড়ে মাহবুবার। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। তবে গত ২৯ জানুয়ারি ইরানি নাগরিক মাইশাম গ্রেপ্তার হওয়ার পর মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে এরকম চুরির খবর আর পাওয়া যায়নি।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৮ মে ডেভিল ব্রেথ বা ‘শয়তানের নিশ্বাস’ নামে পরিচিত প্রতারণা চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে যশোর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এদের মধ্যে তিনজন ইরানি নাগরিক। তারা হলো খালেদ মাহবুবী, সালার মাহবুবী ও ফারিবোর মাসুফি। এ সময় তাদের কাছ ডলারসহ বিভিন্ন দেশের মুদ্রা জব্দ করা হয়।

 

সর্বশেষ গত ১১ আগস্ট বগুড়ার শিবগঞ্জ থেকে ‘শয়তানের নিশ্বাস’ দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে প্রায় লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে দুই ইরানি নাগরিক আজাদ নুবাহার ও আরশাদ আমনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। জানা গেছে, শয়তানের নিশ্বাস নামক ওষুধের উৎপত্তি হয় কলম্বিয়ায়। ১৮৮০ সালে সর্বপ্রথম জার্মান বিজ্ঞানী আলবার্ট লাদেনবার্গ ‘সত্যের সিরাম’ অর্থাৎ সত্যের সন্ধানে এর ব্যবহার নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ১৯২২ সালে এটি কারাবন্দিদের ওপর প্রয়োগ করা হয় ‘ড. রবার্ট হাউস’ নামক একজনের সন্ধানে তথ্য বের করার ক্ষেত্রে। বর্তমানে এ মাদকটি মূলত প্রতারক চক্রের সদস্যরা প্রতারণার কাজে ব্যবহার করে থাকে। লাতিন আমেরিকার দেশগুলোয়; বিশেষ করে কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা, আর্জেন্টিনা, পেরু, চিলি প্রভৃতি দেশে এটি মাদক হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। অপরাধীরা বিভিন্ন বয়সিদের যৌনমিলনে বাধ্য করতে এ মাদকটি ব্যবহার করে থাকে। পর্নোগ্রাফিক ভিডিও তৈরি করতে বা নগ্ন ছবি তোলার জন্যও এটি ব্যবহার করা হয়।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আ ব ম ফারুক বলেন, এ ড্রাগটি তো অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশে আছে। ক্লিনিকোলজিক্যাল কাজে এটি ব্যবহার করা হতো। এগুলো আগে সবার হাতের নাগালে ছিল না। তবে এখন সমাজের বখে যাওয়া কিছু লোক এ ড্রাগটিকে মাদক হিসেবে ব্যবহার করছে, যা খুবই ভয়ংকর সংকেত। এ ড্রাগ অতি দ্রুততম সময়ের মধ্যে সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমকে নষ্ট করে দেয়। এ ড্রাগ খুবই বিষাক্ত। এ ড্রাগের অতিরিক্ত ব্যবহারে মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকিও রয়েছে বলে জানান তিনি। এর আগে গত বছরের ২১ নভেম্বর দেশে প্রথমবারের মতো ‘ক’ শ্রেণির মাদক ডাইমেথক্সিব্রোমো অ্যাম্ফেটামিন (ডিওবি) খুলনা থেকে জব্দ করে ডিএনসি। গ্রেপ্তার করা হয় আসিফ আহমেদ, অর্ণব কুমার শর্মা ও একটি কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী মামুনুর রশীদকে। ডার্ক ওয়েবসাইটে ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে পোল্যান্ড থেকে ২০০ ব্লট ডিওবি অর্ডার করেন খুলনার যুবক আসিফ আহমেদ শুভ। অর্ডারের পর ইন্টারন্যাশনাল কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মাদকের চালানটি সরাসরি তার বাসায় পৌঁছায়। ওই ঘটনায় ঢাকার নিউমার্কেট থানায় মামলা হয়।

 

রাসায়নিক বিশেষজ্ঞরা জানান, ডিওবি সেবনের পর সেবনকারীকে যেকোনো দিকে প্রভাবিত করা যায়। ডিওবির মতোই কিন্তু এর চেয়েও আরো ভয়ংকর ড্রাগ হলো স্কোপোলামিন বা শয়তানের নিশ্বাস। এর ফলে সেবনকারী নির্দেশিত কাজ করতে উদ্যোমী হন। এজন্য নির্দিষ্ট মাত্রায় সেবন করতে হয়। বেশি পরিমাণে সেবন মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

 

স্কোপোলামিনের মতো ভয়ংকর কেমিক্যাল ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের সর্বস্ব লুটে নেয়ার মতো প্রতারণায় বিদেশিরা জড়িত থাকায় তাদের গ্রেপ্তারে কোনো আইনি জটিলতা রয়েছে কিনা জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) ড. খ. মহিদ উদ্দিন দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, বিদেশি কেউ যদি এ দেশের মাটিতে অপরাধ করে, তাহলে দেশে প্রচলিত আইনানুযায়ী তাদের বিচার হবে। এরকম অপরাধে কাউকে ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই।

মন্তব্য

Beta version