-->

স্বামীর জবানে আফরোজা হত্যার রোমহর্ষক বর্ণনা

রুদ্র মিজান
স্বামীর জবানে আফরোজা হত্যার রোমহর্ষক বর্ণনা

রুদ্র মিজান: রাত তখন সাড়ে ৮টা। ওই সময়েই বাগ্বিতন্ডা শুরু হয় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে। তুমুল ঝগড়া। কথায় কেউ কাউকে ছাড় দিচ্ছেন না। ঝগড়ার বিষয় পরকীয়া সন্দেহ থেকে কাবিনের বিপুল টাকা দেনমোহর। উত্তেজনা বাড়তে থাকে। এর মধ্যেই রান্নাঘর থেকে ধারালো বঁটি হাতে নেন কানাডা প্রবাসী আশরাফুল আলম। সময় নেন না মোটেও।

 

একে একে ধারালো বঁটি দিয়ে আঘাত করেন স্ত্রী আফরোজা আক্তারকে। পেছন থেকে বাম কাঁধে প্রথম কোপ দিতেই রক্তে ভেসে যায় শরীর। ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার করেন আফরোজা। তারপর দ্রুত গতিতে একের পর এক ধারালো বঁটির আঘাত। রোমহর্ষক এই হত্যাকান্ডের বর্ণনা দিয়েছেন আশরাফুল আলম নিজেই। গত ২৮ মে রাতে দক্ষিণপাড়া বৈশাখী মোড়ের এক বাসায় এ হত্যাকান্ড ঘটে।

 

৩১ মে রাতে ফোনে দক্ষিণ খান থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক রাজিয়া খাতুনের কাছে অবৈধভাবে সহযোগিতা চান আশরাফুল।

 

এ সময় তিনি জানান, কীভাবে আফরোজাকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার পর কোথায় লাশ গুম করা হয়েছে। এ সময় এস আই রাজিয়াকে নগদ ১৫ লাখ টাকা দেয়ার প্রস্তাব দেন তিনি। সেসঙ্গে রাজিয়ার পরিবারের অন্তত দুইজনকে কানাডা নিয়ে যাবেন বলে জানান। বিনিময়ে তাকে হত্যা মামলা থেকে রক্ষা করার প্রস্তাব দেন। লাশটি তুলে নিয়ে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিতে বলেন আশরাফুল।

 

রাজিয়া জানান, আফরোজা আক্তার নিখোঁজের ঘটনায় গত ২৯ মে তার ভাই আরিফুল ইসলাম দক্ষিণ খান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। জিডির তদন্ত শুরু করেন এস আই রাজিয়া। রাজিয়া বলেন, কয়েক দফায় আফরোজার স্বজন ও তার স্বামী আশরাফুলের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলি।

 

আশরাফুলের পরিবারের সদস্যরা জানান, ছুটি শেষ হওয়ায় তিনি কানাডায় চলে গেছেন। কিন্তু আফরোজার কোনো সন্ধান দিতে পারছিলেন না তারা।

 

আশরাফুল আলমের বাবা জানান, কানাডা যাওয়ার সময় আফরোজার সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে গেছেন আশরাফুল। কিন্তু আফরোজা কোথায় গেছেন, তা জানা নেই।

 

আফরোজার মোবাইল ফোন কোথায় জানতে চাইলে তিনি জানান, ফোনটি আশরাফুল সঙ্গে নিয়ে গেছে। এতেই সন্দেহ বাড়তে থাকে। এ সময় আফরোজার ভ্যানিটি ব্যাগ বের করে দেন আশরাফুল আলমের বাবা।

 

এতে পাওয়া গেছে আফরোজার পাসপোর্ট, ওয়ার্ক পারমিট ও জাতীয় পরিচয়পত্র। ওই সময়ে আশরাফুল ফোনে কথা বলছিলেন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে।

 

তার এক খালা জানান, আশরাফুল কথা বলতে চান। তখন ওই নারীর ফোনে হেয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে কথা হয় এস আই রাজিয়ার সঙ্গে। স্ত্রীকে হত্যার কথা স্বীকার করে রাজিয়াকে প্রলোভন দেন।

 

আশরাফুল বলেন, আপনার পরিবারে কে কে আছেন, আমি ২৫ লাখ, ২৫ লাখ মোট ৫০ লাখ টাকা দিয়ে আপনার পরিবারের দু’জনকে কানাডায় নিয়ে আসব। আপনাকে নগদ ১৫ লাখ টাকা দেব। আপনি এ লাশ উদ্ধার করে বুড়িগঙ্গায় নিয়ে ফেলে দেবেন। কেউ যেন কিছু বুঝতে না পারে। কোনোভাবেই যেন আমি বা আমার পরিবারের কাউকে জড়িয়ে মামলা না হয়।

 

এ সময় কৌশলে এস আই রাজিয়া বিস্তারিত জেনে নেন। ভিডিওকলে কথা হয় তার সঙ্গে। ভিডিওকলে আশরাফুল নিজেই দেখিয়ে দেন কোথায় লাশ গুম করা হয়েছে। ভিডিওকলে আশরাফুল নির্দেশনা দেন, সামনে যান। তারপর গেট থেকে বের হন। একটু বামে যান। এই যে একটু সামনে... এখানেই ওর লাশ পুঁতে রেখেছি। আপনি এটি তুলে নিয়ে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেন।

 

হত্যাকান্ডের বর্ণনা দিয়ে আশরাফুল জানিয়েছেন, বিয়ের কাবিনে ৫০ লাখ টাকা দেনমোহর দিতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু আফরোজা এক কোটি টাকা লিখিয়েছে। শুরু থেকেই তার উদ্দেশ্য ভালো ছিল না। এ সময় স্ত্রীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করেন তিনি। কানাডায় আফরোজার অনেক বন্ধু রয়েছে। সে আমার অবাধ্য ছিল। এমনকি দেশে থাকাকালে বাবার বাড়িতেই বেশি ছিলেন আফরোজা। আশরাফুলের মা মারা গেলেও তিনি ঢাকায় আসেননি। এসব নিয়েই ঝগড়া হয়েছিল তাদের। তারপরই বঁটি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছেন তাকে।

 

বঁটি দিয়ে সাতটি আঘাত করেছেন। আঘাতগুলো ছিল মাথার পেছনে, হাতে, বাম কাঁধে, বাম বাহুর ওপর ও ঠোঁটের নিচে। তবে হত্যাকান্ডের অন্য কারো জড়িত থাকার বিষয় স্বীকার না করলেও পুলিশের ধারণা, এতে পরিবারের সদস্যরা জড়িত। পাশের রুমে হত্যাকান্ড ঘটলেও তারা তা জানেন না বলে পুলিশকে জানিয়েছেন। যা মোটেও বিশ্বাস যোগ্য নয়। তাছাড়া তিন ফুট গর্ত করে লাশটি গুম করার চেষ্টা করা হয়েছে। তার একার পক্ষে তা করা সম্ভব নয় মোটেও।

 

৩১ মে রাতে আশরাফুলের সঙ্গে কথা বলার পরপরই বিষয়টি ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের জানান এস আই রাজিয়া। খবর পেয়ে পুলিশ সদস্যরা এসে কানাডা প্রবাসী আফরোজার লাশটি উদ্ধার করেন।

 

পরে রাতেই ময়নাতদন্তের জন্য লাশটি শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। ময়নাতদন্ত শেষে লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। হত্যাকান্ডে জড়িত সন্দেহে আশরাফুল আলমের বাবা, ভাই, খালাসহ মোট পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় নিহতের বড় ভাই আরিফুল ইসলাম বাদী হয়ে দক্ষিণ খান থানায় একটি মামলা করেছেন। এতে ছয়জনকে এজাহার নামীয় আসামি করা হয়েছে। আজ তাদের আদালতে পাঠিয়ে প্রত্যেকের ১০ দিনের রিমান্ড চাইবে পুলিশ। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে এই হত্যাকান্ড সম্পর্কে আরো তথ্য পাওয়া যাবে বলে পুলিশ মনে করছে।

 

জানা গেছে, গত ছয় বছর ধরে কানাডায় থাকেন আফরোজা। তার আগে এক বিয়ে হয়েছিল। ওই সংসারে তার দুই কন্যা ও এক পুত্রসন্তান রয়েছে। প্রথম স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্সের পর কানাডাতে আশরাফুলের সঙ্গে পরিচয়। তারপর তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রায় এক বছর আগে তারা বিয়ে করেন। গত রমজানে দেশে এসেছিলেন তারা। ওই সময়ে দেশে আবার রেজিস্ট্রি করে বিয়ে হয়।

 

এদিকে, এই হত্যা মামলার আসামি আশরাফুলের ছিল এটি চতুর্থ বিয়ে। তার আগের সংসারে এক পুত্রসন্তান রয়েছে। বিয়ের পর থেকে দুইজন দুইজনকে সন্দেহ করতেন বলে তাদের ঘনিষ্ঠরা জানান।

 

আফরোজার গ্রামের বাড়ি নীলফামারীর ডোমার এলাকায়।

 

নিহত আফরোজা আক্তারের ভাই আরিফুল ইসলাম বলেন, আমার বোনকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমরা এই হত্যাকান্ডের সঠিক বিচার চাই।

 

দক্ষিণ খান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন খান বলেন, কানাডা প্রবাসী আফরোজা হত্যা মামলার তদন্ত চলছে। এ ঘটনায় ইতোমধ্যে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর কারো সম্পৃক্ততা পেলে তাদেরও গ্রেপ্তার করা হবে বলে জানান তিনি।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version