-->
১১ দিনের ব্যবধানে রাজধানীতে ৩ খুন

বেপরোয়া কিশোর গ্যাং

ইমরান খান
বেপরোয়া কিশোর গ্যাং

ইমরান খান: রাজধানীসহ সারা দেশে ভয়ংকর হয়ে উঠছে কিশোর গ্যাং কালচার। দেশের প্রধান শহরগুলোতে কিশোর-তরুণরা বিভিন্ন গ্যাংয়ের মাধ্যমে অপরাধ করছে। বেপরোয়া এসব গ্যংয়ের সদস্যরা চাঁদাবাজি, ছিনতাই থেকে শুরু করে খুনখারাবিও করছে।

 

গত ১০ মে থেকে ২১ মের মধ্যে ১১ দিনের ব্যবধানে শুধু রাজধানীতেই কিশোর গ্যাংয়ের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন তিনজন। কোনো কিছুতেই যেন থামছে না কিশোর অপরাধ। দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে কিশোর গ্যাং।

 

গত ২১ মে রাতে কিশোর গ্যাং সদস্যের ছুরিকাঘাতে সিয়াম (১৪) নামে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক কিশোর নিহত হয়। রাজধানীর দারুসসালামের লালকুঠির বসুপাড়া এলাকায় হত্যাকান্ড ঘটে।

 

প্রত্যক্ষ্যদর্শীদের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, রাজধানীর দারুসসালাম থানার লালকুটি এলাকায় দুর্বৃত্তরা স্কুলছাত্র সিয়ামকে পরিকল্পিতভাবে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। তাকে গুরুতর আহত করে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে পালিয়ে যায়।

 

পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় নিহত সিয়ামের মা বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেন।

 

ঘটনার সময় সিয়ামের সঙ্গে ছিলেন তার বন্ধু শীতল হোসেন। শীতল বলেন, ঘটনার দিন বিকেলে নিহত সিয়াম ও আমরা ১০ থেকে ১৫ জন বন্ধু একসঙ্গে ছিলাম। রাত সাড়ে ৮টায় ঝোড়ো হাওয়া শুরু হয়। এ সময় একটি গাছ থেকে আম পড়েছে ভেবে আম কুড়িয়ে আনতে আমিসহ সিয়াম ও আসিফ আহমেদ গাছটির সামনে যাই। গাছের নিচে কোনো আম না পেয়ে আমরা গাছটি থেকে দু-চারটি আম পেড়ে নিয়ে আসতে চেষ্টা করি।

 

এমন সময় লাইটের আলোতে আমরা দেখতে পাই দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কিছু যুবক আমাদের দিকে তেড়ে আসছে। লাইটের আলো ছিল বিধায় অস্ত্রশস্ত্র হাতে আমাদের দিকে তেড়ে আসা বিশ থেকে পঁচিশ জনের গ্রুপের সামনে থাকা রকি, ফরিদ, রুবেল ওরফে পটেটো রুবেল, ইমরান ও জার্মানি মাসুদকে দেখে আতঙ্কে দৌড়ে সেখান থেকে পালিয়ে যাই।

 

কিন্তু এ সময় সিয়াম আমাদের সঙ্গে দৌড়ে আসতে না পেরে পেছনে রয়ে যায়। শীতল জানান, সেদিকে খেয়াল করা হয়নি। পরে তিনি জানতে পারেন সিয়ামের পেটে অস্ত্রধারীরা ছুরিকাঘাত করে মারাত্মক আহত করে পালিয়ে যায়। আকস্মিক হামলার শিকার ভুক্তভোগী সিয়ামের ডাক-চিৎকারে আশপাশের লোকজন ছুটে গিয়ে গুরুতর আহত ও রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। এ ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থলের আশপাশের একটি সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে দারুসসালাম থানা পুলিশ।

 

সেই ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, এক যুবক ছুরিসদৃশ দেশীয় অস্ত্র হাতে সিয়ামের ঘাড় শক্ত করে ধরে জোরপূর্বক সামনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এ সময় আরো কিছু যুবক তাদের পেছনে পেছনে যাচ্ছে।

 

সিসিটিভি ফুটেজ দেখে নিহত সিয়ামের মা স্বপ্না বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ঘাড় ধরে জোরপূর্বক সামনের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া কিশোর ইমরানই আমার আদরের সন্তান সিয়ামকে হত্যা করেছে। হত্যাকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ পর্যন্ত স্কুলশিক্ষার্থী সিয়াম হত্যা মামলায় জড়িত সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে গত শুক্রবার কিশোর গ্যাং লিডার শান্তনু হোসেন রুবেল ওরফে পটেটো রুবেল ও মসিউর রহমান রকি নামে দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব।

 

র‌্যাব-৪ সাভারে ও র‌্যাব-৮ বরিশালের বাকেরগঞ্জে পৃথক অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে। এর আগে হত্যাকান্ডের পরদিন ২২ মে আকবর আলী ও ইমরান নামের দুই যুবককে গ্রেপ্তার করে দারুসসালাম থানা পুলিশ। পরবর্তীতে আরো তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

 

এ বিষয়ে দারুসসালাম থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) জামাল হোসেন দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হত্যার কারণ সম্পর্কে এখুনি কিছু বলা যাচ্ছে না। তদন্ত চলছে। পরবর্তীতে সব তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে।

 

র‌্যাব-৪-এর মিডিয়া কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মাজহারুল ইসলাম জানান, গ্রেপ্তার পটেটো রুবেল ও মসিউর রহমান রকি জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে।

 

গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা রাজধানীর দারুসসালাম লালকুঠি এলাকায় সংঘবদ্ধ কিশোর গ্যাংয়ের লিডার। তারা এলাকায় হত্যা, ডাকাতি, চুরি-ছিনতাইসহ একাধিক সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সঙ্গেও জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে থানায় হত্যা, ডাকাতি, চুরি-ছিনতাইসহ একাধিক মামলা রয়েছে।

 

এর আগে রাজধানীর শনির আখড়ায় দনিয়া কলেজের সামনে সিনিয়র-জুনিয়ররের দ্বন্দ্বে মারামারি ও ছুরিকাঘাতে নিহত হয় চলমান এসএসসি পরীক্ষার্থী মুশফিক ইসলাম তাজুন। এ ঘটনায় ১৭ জনকে আসামি করে মামলা করে তার পরিবার।

 

নিহত তাজুনের স্বজনরা জানান, ঘটনার দিন সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেয়ার সময় ছুরিকাঘাতে মারা যায় তাজুন ইসলাম। এ ঘটনায় আহত হয়েছে আরো তিনজন। ঘটনার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাজুনকে নিয়ে যায় তার কয়েক বন্ধু। সেখানে আহত তিনজনের মধ্যে দু’জনকে আটক করে যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ। তবে কেন ছুরিকাঘাতের ঘটনা ঘটেছে, তা বলতে রাজি হয়নি নিহতের বন্ধু-স্বজনরা।

 

যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মফিজুল আলম বলেন, জ্যেষ্ঠ-কনিষ্ঠ দ্বন্দ্বের জেরে মুশফিক তাজুন হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় তাজুনের ভগ্নিপতি আশিকুর রহমান ১৭ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন। তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

 

একই দিন ১০ মে রাত সাড়ে ১১টায় চানখারপুল এলাকায় ছুরিকাঘাতে খুন হন পলিন নামের আরেক যুবক।

 

সংশ্লিষ্টরা জানান, নিহতের স্ত্রী কাজলকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করলে আব্দুল্লাহ নামে এক কিশোর গ্যাং নেতা পলিনকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে।

 

নিহত পলিনের বন্ধু সাব্বির আহম্মেদ বলেন, রাত ১০টার দিকে পলিন তার স্ত্রীকে নিয়ে বাসায় যাচ্ছিলেন। এ সময় রাস্তায় আব্দুল্লাহ ও ফয়সাল নামে দুই বখাটে ছেলে ভাবিকে দেখে বিরূপ মন্তব্য করে। এতে পলিন ভাই রেগে ওই ছেলেদের চড়-থাপ্পড় দেয়। পরে ভাবিকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে রাত ১১টার দিকে হেঁটে চানখারপুল মোড় দিয়ে যাওয়ার সময় আব্দুল্লাহ ও ফয়সাল পলিনকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে গুরুতর আহত করে। পরে তার মৃত্যু হয়।

 

এ বিষয়ে চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. কাইয়ুম বলেন, পলিনকে হত্যার ঘটনায় আবদুল্লাহ নামে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সে ওই ঘটনায় সরাসরি জড়িত ছিল। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। একই সঙ্গে আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ চেক করা হচ্ছে। হত্যাকান্ডের সঙ্গে আর কারা জড়িত ছিল এবং কী কারণে ঘটানো হয়েছে তা জানার চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version