-->

আরাভকে ফেরানো কঠিন, অনৈতিক বাণিজ্য ও অপকর্মের মাধ্যমে উত্থান

রুদ্র মিজান
আরাভকে ফেরানো কঠিন, অনৈতিক বাণিজ্য ও অপকর্মের মাধ্যমে উত্থান

রুদ্র মিজান: আরাভ খান। চাঞ্চল্যকর এক পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা মামলার আসামি। দুবাইয়ে অবস্থানকারী আরাভের ডাকে দেশের তারকারা সেখানে ছুটে যান। এতেই আলোচনায় আসেন এ পলাতক আসামি। আলোচনা হচ্ছে, তাকে দেশে ফেরানো নিয়ে। ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাইলেও তাকে ফেরানো কঠিন বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ভিনদেশি পাসপোর্ট ব্যবহারের কারণেই এ জটিলতা। আরাভ খানের আমন্ত্রণে দুবাই যান ক্রিক্রেট তারকা সাকিব আল হাসান, নায়িকা দিঘী, হিরো আলমসহ আরো অনেকে। আরাভ খানের একটি স্বর্ণের দোকান উদ্বোধন করতে যান তারা। আরাভ খান দেশে রবিউল ওরফে হৃদয় ওরফে আপন নামে পরিচিত। ব্ল্যাকমেইল, অনৈতিক নারী বাণিজ্য থেকে শুরু করে নানা অপকর্মের মধ্য দিয়ে উত্থান ঘটেছে তার।

 

ঢাকায় অবস্থানকালেও অন্যের অর্থে সামনের সারিতে থেকে অপকর্ম করতে তিনি। শোবিজজগৎকে কেন্দ্র করেই বনানীতে গড়েছিলেন রাজধানীর আস্তানা। তার এ আস্তানায় যাতায়াত ছিল ঢাকার বিভিন্ন শ্রেণির প্রভাবশালীদের। ওই সময় থেকেই তারকাদের সঙ্গে তার পরিচিত গড়ে ওঠে। দীর্ঘদিন পর হত্যা মামলার এ আসামির ডাকে দুবাইয়ে যান বাংলাদেশের তারকাদের অনেকে। দুবাইয়ে আরাভ খানের আমন্ত্রণে যান হিরো আলম। এ প্রসঙ্গে দুবাইফেরত হিরো আলম জানান, তাকে বা আমন্ত্রিত সাকিব আল হাসানসহ কাউকে পুলিশ দুবাই যেতে বাধা দেয়নি। এমনকি কোনো সতর্কও করেনি। আরাভ খান যে হত্যা মামলার আসামি, এটা তার জানা ছিল না। দুবাই যাওয়ার পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ-সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ পেলে তিনি বিষয়টি জানতে পারেন।

 

এ বিষয়ে হিরো আলম আরো বলেন, পুলিশও জানত না যে এ আরাভ খান হত্যা মামলার আসামি এবং তিনি দুবাই থাকেন। আমরা তার আমন্ত্রণে দুবাই যাওয়ার কারণে পুলিশ বিষয়টি জানতে পেরেছে। আমি মনে করি, এজন্য পুলিশের পক্ষ থেকে আমাদের পুরস্কৃত করা উচিত। তবে দুবাইয়ে আমন্ত্রিতদের আরাভ খান কত টাকা দিয়েছেন- জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।

 

তবে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, সাকিব ছাড়া কাউকে নগদ অর্থ দেয়া হয়নি। ক্রিক্রেটার সাকিবকে প্রায় ১৫ লাখ টাকা দিয়েছেন আরাভ খান। এসব বিষয়ে আরাভ খানকে দেশে ফেরাতে চেষ্টা করছে পুলিশ। কিন্তু তা সফল হতে অনেক বেগ পোহাতে হবে বলে মনে করছেন অভিজ্ঞরা। ভারতীয় পরিচয় বহন করার কারণে ইন্টারপোল চাইলেই আরাভকে বাংলাদেশে পাঠাতে পারবে না। কারণ সেখানে তার অবস্থান ভারতীয় হিসেবে। এছাড়া আরব আমিরাতের সঙ্গে বাংলাদেশের বহিঃসমর্পণ চুক্তিও নেই। পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা মামলায় আসামি হলেও এখন পর্যন্ত এ মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হননি তিনি। ভারত ও দুবাই চাইলেও প্রক্রিয়াটি জটিল বলেই জানান আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

 

এ বিষয়ে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক বলেন, দুবাই থেকে আরাভ খানকে বাংলাদেশে ফেরত আনা কঠিন ও জটিল প্রক্রিয়া। বাংলাদেশ কর্তৃক অবগত হওয়ার পরে জালিয়াতির অভিযোগে রবিউল ওরফে আরাভাবের বিরুদ্ধে মামলা করবে ভারত। পরে ভারত কর্তৃক দুবাইয়ে বিষয়টি অবগত করে তাকে ফেরত চাইতে হবে। এভাবেই তাকে বাংলাদেশে ফেরত আনা সম্ভব। এজন্য অবশ্যই ভারত ও দুবাইয়ের সদিচ্ছা থাকতে হবে।

 

আরাভের বিরুদ্ধে অভিযোগ- তিনি পুলিশের স্পেশাল বাঞ্চের পরিদর্শক মামুন ইমরান খান হত্যায় জড়িত। ২০১৮ সালের ৮ জুলাই বনানীর একটি বাসায় ডেকে নেয়া হয় মামুনকে। বন্ধু রহমত উল্লাহ তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল মডেল আন্নাফি আফরিনের জন্মদিনের পার্টিতে। ঘটনাস্থল বনানীর ২/৩ সড়কের ৫ নম্বর বাসার এ-২ ফ্ল্যাট। সেখানে নিয়ে পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে এ মডেল ও অভিনেত্রীর সঙ্গে অশ্লীল ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইলের চেষ্টা করা হয়। মামুন নিজের পরিচয় দিলে তাকে মারধর করা হয়। একপর্যায়ে মারা যায় পুলিশ পরিদর্শক মামুন। সারা রাত তার লাশ নিয়ে বসে থাকে সন্ত্রাসী চক্রের সদস্যরা। পরদিন সকালে বস্তায় লাশ ভরে রহমতের প্রাইভেট কারের ব্যাকডালায় তোলা হয়। সারা দিন তারা গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়ায়। পরে সন্ধ্যায় গাজীপুরের কালীগঞ্জ থানার উলুখোলা রাইরদিয়ার রাস্তার পাশে নির্জন এলাকায় গাড়ি থামায়। এর আগে পাম্প থেকে ৭ লিটার পেট্রল কেনে। পরে গাড়ি থেকে লাশ বের করে বাঁশঝাড়ে ফেলে দিয়ে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়।

 

এ মামলার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে- কথিত ওই মডেল ও অভিনেত্রীসহ ১০-১২ জনের এ একটি চক্র ছিল বনানী এলাকায়। তারা মাদক সেবন করত। রাতভর পার্টি করত। এসব পার্টিতে টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে ডেকে নিয়ে ফাঁদ পেতে অর্থ আদায় করত। ওই চক্রের হোতা নজরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি। হত্যাকাণ্ডের দুই মাস আগে মাসে ৪৫ হাজার টাকায় বনানীর ওই ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেয় নজরুল। সেখানে বায়িং হাউস ও একটি বৃদ্ধাশ্রমের অফিস এবং শোবিজ মিডিয়ার কার্যালয় হিসেবে ব্যবহারের কথা বলা হয়েছিল। হত্যাকাণ্ডের পর ১৬০০ স্কয়ার ফিটের ওই ফ্ল্যাটে একটি টেবিল, তিনটি চেয়ার ও অন্য কক্ষে একটি তোষক ছাড়া তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। ফ্ল্যাটটি ভাড়া দেয়ার পর থেকে নিয়মিত সেখানে থাকতেন শেখ হৃদয় ওরফে আপন ওরফে রবিউল। পরে যার নাম হয়ে যায় আরাভ খান। ওই ফ্ল্যাটে নিয়মিত মদ-জুয়ার আসর বসাতেন আরাভ। শোবিজের উঠতি বয়সের মডেল, অভিনেত্রীরা থাকতেন এসব আসরে। এছাড়া অর্থের বিনিময়ে নিয়মিত দেহ ব্যবসা করাতেন আরাভ খান ও তার স্ত্রী সুরাইয়া আক্তার। ওই সময়ে সরকারি ঊর্ধ্বতন কয়েক কর্মকর্তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে আরাভের।

 

এসবির পরিদর্শক মামুন হত্যাকাণ্ডে নিহত মামুনের বড় ভাই জাহাঙ্গীর আলম খান বাদী হয়ে বনানী থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় অভিযুক্ত আসামি ১০ জন। তাদের মধ্যে দুজন কিশোরী। আরাভের বিরুদ্ধে অভিযোগ, মামুনকে হত্যার পর লাশ গুম করতে সহায়তা করেছেন আরাভ। খুনে সরাসরি জড়িতরাও আরাভের সহযোগী। এ হত্যা মামলায় ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ চার্জশিট দেয় ডিবি পুলিশ। এ মামলার আসামি হয়ে কারাগারে রয়েছেন- রহমত উল্লাহ, মিজান শেখ, আতিক হাসান, স্বপন সরকার, দীদার পাঠান ও সারোয়ার হোসেন। মামলাটি ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। আরাভ খান ওরফে রবিউল ইসলামের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জে।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version