-->

হদিস নেই ছিনিয়ে নেয়া দুর্ধর্ষ দুই জঙ্গির

ইমরান আলী
হদিস নেই ছিনিয়ে নেয়া দুর্ধর্ষ দুই জঙ্গির

ইমরান আলী: ঢাকার সিএমএম আদালত থেকে ছিনিয়ে নেয়া মৃত্যুদÐপ্রাপ্ত দুর্ধর্ষ দুই জঙ্গি এখনো ধরা পড়েনি। এমনকি এই দুই জঙ্গি দেশে আছে, না বিদেশে পালিয়ে গেছে সেই হদিসও নেই। বর্তমান সময়ে পাহাড়ে সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফের তত্ত¡াবাধানে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। তারা পালিয়ে যে কেএনফের আশ্রয়ে রয়েছে, সে বিষয়েও সুস্পষ্ট তথ্য নেই।

 

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, তারা যদি কেএনএফের আশ্রয়ে থাকে, তবে সেটি আমাদের জন্য ভয়ংকর। আরো সুসংগঠিত হয়ে তারা নাশকতার পরিকল্পনা করছে।

 

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল আব্দুর রশিদ বলেন, মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত ছিনিয়ে নেয়া দুই জঙ্গিকে গ্রেপ্তারে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। দ্রুত তম সময়ের মধ্যেই তাদের আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। কেননা এ বছর জাতীয় নির্বাচনের বছর। চারদিক থেকে নানা ষড়যন্ত্র এমনকি বড় নাশকতা চালিয়ে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির ষড়যন্ত্র চলছে। জঙ্গিরাও এ ধরনের ষড়যন্ত্রে পিছিয়ে নেয়। পলাতক জঙ্গিরা যেহেতু মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত এবং দুর্ধর্ষ সেহেতু তারাও চেষ্টা চালিয়ে যাবে। গ্রেপ্তারকৃত নানা জঙ্গির পরিকল্পনা ভয়াবহ বলেও আমরা জানতে পেরেছি।

 

তিনি বলেন, দ্রুত তম সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার করা গেলে তাদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হবে, এমনকি তাদের পরিকল্পনা সম্পর্কেও জানা যাবে। সে মোতাবেক প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে সহজ হবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য।

 

জানা যায়, ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত এলাকা থেকে ছিনিয়ে নেয়া মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা যায়নি এখনো। আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ও মাইনুল হাসান শামীমকে ছিনিয়ে নেয় তাদের সহযোগীরা। ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা পলাতক দুজনের একজনকেও শনাক্ত করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

 

পলাতক দুই জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করতে না পারলে ওই ঘটনায় জড়িত মেহেদী হাসান অমি ওরফে রাফি (২৪) ও প্রয়াত রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ওমর ফারুককে গ্রেপ্তার করে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)।

 

বিশেষজ্ঞদের মতে, সাবধানতা ও সতর্কবার্তার মধ্যেই ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাজধানী ঢাকায় হলি আর্টিসান রেস্তোরাঁয় ইতিহাসের অন্যতম নৃশংসতম জঙ্গি হামলা ঘটে। সেই হামলায় দুই পুলিশ কর্মকর্তা, বিদেশি নাগরিকসহ ২৩ জনকে হত্যা করে তারা।

 

মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, আদালত থেকে ছিনিয়ে নেয়া দুই আসামি গ্রেপ্তারে কাজ করছেন গোয়েন্দারা। আশা করা যাচ্ছে, দ্রুত সময়ের মধ্যেই তারা গ্রেপ্তার হবেন। তারা যদি বিদেশে পালিয়ে যান, ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাদের ফিরিয়ে আনা হবে। এখন পর্যন্ত বিদেশে পালানোর বিষয়ে কোনো ধরনের গোয়েন্দা তথ্য পাওয়া যায়নি।

 

জানা যায়, পলাতক দুই জঙ্গি নিষিদ্ধ ঘোষিত আনসার আল ইসলামের সঙ্গে জড়িত। আনসার আল ইসলাম কাট আউট (একই কাজে যুক্ত এক দলের তথ্য অন্য দল জানে না) পদ্ধতিতে কাজ করার কারণে গ্রেপ্তার মেহেদীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও কোনো তথ্য জানতে পারেনি পুলিশ। জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় অংশ নেয়া আরো সাতজনকে চিহ্নিত করা গেলেও তাদের অবস্থানের বিষয়ে এখনো নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

 

ছিনিয়ে নেয়া দুই জঙ্গি জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন এবং লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত আসামি। এ ছাড়া আরো কয়েকটি হত্যা মামলারও আসামি তারা।

 

সিটিটিসি সূত্র জানায়, জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় ওমর ফারুক নামে এক আইনজীবী জড়িত বলে জানায় তারা। গত ২৬ ডিসেম্বর তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। ওমর ফারুক পালিয়ে যাওয়া এক জঙ্গির ভগ্নিপতি ও প্রয়াত রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ছিলেন। জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় মেহেদী হাসান অমি ওরফে রাফি (২৪) নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে সিটিটিসি।

 

রাফি (২৪) মোটা অঙ্কের টাকা এনেছিলেন। এ টাকা ছিনিয়ে নেয়া জঙ্গিদের হাতে দেন তিনি। যাতে জঙ্গিরা টাকা-পয়সা দিয়ে তাদের পরবর্তী কার্যক্রম চালাতে পারেন। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের একটি মামলায় গ্রেপ্তার মেহেদী আগে থেকেই পরিকল্পনা করেছিলেন ছিনিয়ে নেয়ার পর জঙ্গিদের হাতে টাকা দেবেন। অমি প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

 

দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ। সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (কারা অনুবিভাগ) মো. হাবিবুর রহমানকে প্রধান করে এ কমিটি গঠন করে আদেশ জারি করা হয়। কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শকের প্রতিনিধি (ডিআইজি পদমর্যাদার নিচে নন), অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক ও ঢাকার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট।

 

পুলিশ সদর দপ্তরের একজন ডিআইজিকে প্রধান করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির প্রধান পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অডিট) মো. আমিনুল ইসলাম ও সদস্য সচিব অতিরিক্ত ডিআইজি (ক্রাইম মেট্রো) মো. হাসানুজ্জামান। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন সিটিটিসির ড. এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মেট্রো সাউথ) মো. আনিচুর রহমান।

 

দুই জঙ্গি মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত সামির ও মো. আবু ছিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব পালানোর ঘটনায় অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনারকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম আ্যন্ড অপস) এ কে এম হাফিজ আক্তার। কমিটির সদস্যরা হলেন ডিএমপির যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার (অপারেশনস), যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার (সিটিটিসি), লালবাগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার ও ডিএমপির সিআরওর অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার।

 

পলাতক দুই জঙ্গির বিষয়ে র‌্যাব কাজ করছে জানিয়ে সংস্থাটির লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, হলি আর্টিসানের মতো ঘটনা বারবার হবে না। জঙ্গিরা নতুন কোনো প্ল্যানে কাজ করতে পারে। তবে র‌্যাব এক্ষেত্রে সব সময় সতর্ক আছে। পলাতক দুই জঙ্গিসহ তাদের সহযোগীদেরও আইনের আওতায় আনতে র‌্যাবের গোয়েন্দা দল ও সবগুলো ইউনিট কাজ করছে।

 

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, আদালত থেকে পালিয়ে যাওয়া দুই জঙ্গির বিষয়ে পুলিশের একাধিক ইউনিট কাজ করছে। পুলিশ এর আগে অনেক বড় বড় জঙ্গি নেতাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় এনেছে। পলাতক দুই জঙ্গি যেখানেই পালিয়ে থাকুক, তাদেরও গ্রেপ্তার করে আইনের মুখোমুখি করা হবে।

 

পালানো দুই জঙ্গিকে গ্রেপ্তার না করা পর্যন্ত ঝুঁকি রয়েই যায় উল্লেখ করে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক বলেন, দুই জঙ্গিকে গ্রেপ্তারে নিশ্চয়ই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ চেষ্টাই করে যাচ্ছে। তাদের শনাক্ত করতে না পারলে গ্রেপ্তার করা খুব কঠিন। দুই জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করতে না পারলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অস্বস্তি রয়ে যাবে।

 

‘হলি আর্টিসানের পরে আমি আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব পাই। তখন সারাদেশে জঙ্গিদের আস্তানা খুঁজে খুঁজে অভিযান পরিচালনা করে নির্মূল করি। জঙ্গিদের অনেকগুলো আত্মঘাতী দল হয়েছিল তখন। যদি শনাক্ত না করা যেত তবে দেশ অচল হয়ে যেত। জঙ্গিরা নতুন করে সৃষ্টি হচ্ছে ঠিক, তবে হলি আর্টিসানের মতো ঘটনা ঘটানোর সক্ষমতা জঙ্গিদের নেই।’

 

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. নূরুল আনোয়ার বলেন, যখন কোনো মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি পলায়ন করে, তখন খুব সহসা ধরে পড়বে না, সেভাবে তারা পালিয়ে যায়। তারা খুব ভালো করেই জানত, তাদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর হবে। প্রথম মৃত্যুদন্ড থেকে রেহাই পাওয়া আর দ্বিতীয়ত জঙ্গি সংগঠনকে পুনর্গঠন করা। হলি আর্টিসানের ঘটনা আমাদের দেশের আপামর জনসাধারণ সমর্থন করেনি।

 

তবে নির্বাচন সামনে, জঙ্গিরা ধরা না পড়া পর্যন্ত হামলার আশঙ্কা উড়িয়ে দিতে পারি না।

 

ভোরের আকাশ/নি

মন্তব্য

Beta version