-->

হেরোইন পাচারের গেটওয়ে ‘গোদাগাড়ি’

ইমরান আলী
হেরোইন পাচারের গেটওয়ে ‘গোদাগাড়ি’

ইমরান আলী: রাজশাহী জেলার পশ্চিমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সীমান্তবর্তী পদ্মাপাড়ের উপজেলা গোদাগাড়ী। নদীর ওপারে ভারতীয় সীমানা। একসময়কার ধান, আম, টমেটো আর সবজির জন্য বিখ্যাত গোদাগাড়ী এখন দেশের সবচেয়ে বড় হেরোইন পাচার কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।

 

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রবেশ করা হেরোইনের ৮০ শতাংই আসে এ পথে। মরণনেশা হেরোইন পাচারের জন্য নারী, শিশু থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধিরাও জড়িয়ে পড়েছে। বিষয়টি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা।

 

তারা বলছেন, হেরোইন পাচার রোধে তারা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

 

রাজধানীতে ৫ কেজি হেরোইন ও নারীসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। এছাড়াও গোদাগাড়ী উপজেলায় ১০০ গ্রাম হেরোইনসহ ৬নং মাটিকাটা ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ড সদস্য বাবুসহ ৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে রাজশাহী জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। আটককৃতরা হলেন মাটিকাটা গ্রামের আতাবুর রহমানের ছেলে সেতাবুর রহমান ওরফে বাবু মেম্বার, সহড়াগাছি গ্রামের আ. লতিফুর রহমানের ছেলে আলমগীর হোসেন (৪০), উজানপাড়া গ্রামের মৃত লতিফের ছেলে আব্দুল্লাহ (৩৫) ও আব্দুল্লাহর স্ত্রী ফেন্সি বেগম (৩০)।

 

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গোদাগাড়ীর হেরোইন চোরাচালানিদের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি সীমান্তবর্তী গ্রাম মাদারপুর। এ গ্রামসহ মাদক ঘাঁটিগুলোর প্রায় সব গ্রামই গোদাগাড়ী পৌর এলাকায় অবস্থিত। অনেকেই মাদারপুর গ্রামের নাম দিয়েছেন, ‘হেরোইন গ্রাম’। আবার গোদাগাড়ী পৌরসভাও অনেকের কাছে ‘হেরোইন রানি’ নামে পরিচিত। উপজেলার কমপক্ষে ১৫০ জন বড় মাপের হেরোইন চোরাচালানির অন্তত ৪০ জনেরই আবাস এই মাদারপুরে।

 

জানা যায়, ইয়াবা বলতে যেমন কক্সবাজার বা টেকনাফকে চিহ্নিত করা যায়, হেরোইনের ক্ষেত্রে তেমন রাজশাহীর এই গোদাগাড়ী। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে ট্রাকচালক সবাই এ ব্যবসার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

 

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যমতে, হেরোইন ব্যবসায় এখানে এমনও লোক জড়িত, যারা প্রশাসনে কাজ করে। আর এ ব্যবসায় এখানকার অধিবাসীদের ব্যাপক বাহ্যিক পরিবর্তন এসেছে। যার কোনো স্থাবর সম্পত্তি বা বাহ্যিক ব্যবসা-বাণিজ্য নেই এবং কোনো পেশাতেও জড়িত নেই। সীমান্তবর্তী প্রত্যন্ত গ্রামে তার আছে প্রাসাদসম দালান-বাড়ি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মেহেদি হাসান এ বিষয়ে বলেন, সীমান্তবর্তী গ্রামে একমাত্র রাস্তায় কোনো অভিযান পরিচালনা করতে গেলে আগেই খবর পেয়ে যান ব্যবসায়ীরা।

 

এছাড়া প্রশাসনেও মাদক কারবারিদের লোক থাকতে পারে। একই সঙ্গে আছে সময়মতো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অভিযানের সময় পাওয়ার জটিলতা। অনেক সময়ই নিয়মিত কাজের কারণে তারা আমাদের সঙ্গে সময় দিতে পারেন না। মাদক ব্যবসায়ীরা এখন অস্ত্র বহন করেন। খালি হাতে তো তাদের মোকাবিলা করা যাবে না।

 

নাম প্রকাশ না করা শর্তে গোদাগাড়ী উপজেলা পরিষদেও একজন জনপ্রতিনিধি বলেন, গোদাগাড়ী পৌরসভার পাশেই বর্ডার। এ বর্ডার কিন্তু উন্মুক্ত নয়। কাঁটাতার দেয়া। চাঁপাইনবাবগঞ্জ হয়ে এই ভয়ংকর মাদক ঢুকছে। একটি চালান পৌঁছে দিলে লাখ লাখ, কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়া যায়। তাই গোদাগাড়ীর মানুষ সে সুযোগ গ্রহণ করছে। সবাই কঠোর না হলে এটা ঠেকানো যাবে না।

 

তিনি বলেন, আমি ওসি সাহেবকে বলেছি, বিজিবিকে বলেছি। তারা আমাকে ওপেন মিটিংয়ে বলেছেন, তারা এখান থেকে হেরোইন ধরে ঢাকা পাঠান, সেখান থেকে তা আটা হয়ে বের হয়ে আসে। তার মানে সমস্যা রয়েছে অনেক ওপরে। ঠিক হতে হবে সেখান থেকেই। তা না হলে দেশ রসাতলে যাবে।

 

অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, হেরোইন চোরাচালানের আন্তর্জাতিক রুট হিসেবে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে ব্যবহার হচ্ছে গোদাগাড়ী। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের লালগোলায় রয়েছে হেরোইন তৈরির কারখানা। সেখান থেকে সীমান্ত পেরিয়ে ভয়ংকর মাদক হেরোইন আসছে গোদাগাড়ীতে।

 

গোদাগাড়ীতে হেরোইন ব্যবসায় জড়িয়ে রয়েছে চার শতাধিক মাদক ব্যবসায়ী। এদের মধ্যে শতাধিক মাদক সম্রাট কোটি কোটি টাকার হেরোইন এনে দেশের ভেতরে পাচার করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে রয়েছে ২৫৩ জন মাদক ব্যবসায়ীর তালিকা। এ তালিকায় থাকা অধিকাংশ মাদক সম্রাট কখনোই ধরা পড়েনি।

 

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, মাদক পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে গোদাগাড়ী, সাহেবনগর, মানিকচক, কোদালকাটি, আলাতুলি বগচর, হাকিমপুর, সুইজগেট, কামারপাড়া, সুলতানগঞ্জ, সারাংপুর, ভগবন্তপুর, হাটপাড়া, বারুইপাড়া, রেলবাজার, মাদারপুর, মাটিকাটা, সিঅ্যান্ডবি আঁচুয়া, গড়ের মাঠ, রেলগেট বাইপাস, বিদিরপুর, প্রেমতলী, ফরাদপুর, রাজাবাড়ী, খরচাকা, নির্মলচর,

 

পবা উপজেলার সোনাইকান্দি, গহমাবোনা, জাহাজঘাটি, হরিপুর, হাড়পুর। চারঘাট উপজেলার ইউসুপপুর, মুক্তারপুর, গোপালপুর, টাংগন, পিরোজপুর, রওথা এবং বাঘার মীরগঞ্জ, হরিরামপুর ও আলাইপুর চর মাজার দিয়ার সীমান্ত ব্যবহৃত হচ্ছে। চারঘাটের মাদক কারবারি আসাদুল পিতা, ইয়াদুল্লাহ, কহিনুর (৩৫) স্বামী, ইমরান, লালন পিতা লাবান, মোবারক (৩৮) পিতা খলিল, উজ্জ্বল (৩২) পিতা কাফি, টুটুল (২৭) পিতা সফি নিযামুল (৪০) জুয়েল পিতা আলাউদ্দিন, রসিদ, পিতা আব্বাস এরা সবাই চারঘাটের সীমান্তবর্তী ইউসুফপুর ইউপির মুক্তারপুর গ্রামের মাদকের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে।

 

এছাড়াও শীর্ষ হেরোইন ব্যবসায়ী চারঘাট উপজেলার শলুয়া ইউপির চামটার কালু, মুক্তার, মেম্বার আশরাফ ও গ্রাম শিবপুর এলাকার শুভ। চারঘাট থানায় এদের সবার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। এসব সীমান্ত এলাকা দিয়ে ফেনসিডিল, মদ ও গাঁজা এলেও গোদাগাড়ী সীমান্তপথগুলো দিয়ে বেশিীভাগ হেরোইন প্রবেশ করে। হেরোইনের বড় চালান আসার পর সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে ভাগবাটোয়ারা হয়ে অভিনব কৌশলে তা পাচার করা হয়।

 

হেরোইন বহনে নারী ও শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে। গোদাগাড়ী সীমান্তে শুধু হেরোইন পাচারের সঙ্গে ৫ শতাধিক চোরাচালানি জড়িত রয়েছে। এরা অল্প সময়ের ব্যবধানে বনে গেছেন কোটিপতি। হেরোইনের খনিখ্যাত গোদাগাড়ীতে পাইকারি ছাড়াও খুচরাভাবে হেরোইন বিক্রি হয়। হেরোইন ও ফেনসিডিলের সঙ্গে জড়িত মাদক ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা নিরাপদে চালিয়ে যেতে পুলিশ ও সরকারি রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে গড়ে তুলেছেন সখ্য।

 

জানা যায়, মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের নীতি জিরো টলারেন্স। তবুও সক্রিয় হয়ে উঠেছে রাজশাহীর সীমান্ত এলাকার চোরাকারবারি ও মাদক ব্যবসায়ীরা। পুলিশি তৎপরতায় চুনোপুঁটিরা ধরা পড়লেও ধরাছোঁয়ার বাইরে মূল হোতা। সীমান্তপথ দিয়ে আসছে বড় বড় চালান। নিত্যদিন ভারত থেকে আসছে কোটি কোটি টাকার হেরোইন। এগুলো অবৈধ পথে নিয়ে এসে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তরে। এগুলো পরিবহনে কখনো বাস, ট্রেন, পাথর, বালুবোঝাই এমনকি ফলভর্তি ট্রাকে করেও হেরোইন পাচার হয়।

 

নারী, শিশু এমনকি জনপ্রতিনিধিরাও হেরোইন পাচারের সঙ্গে জড়িত। গোদাগাড়ী থানার ওসি কামরুল ইসলাম বলেন, থানা পুলিশ সবসময় এ বিষয়ে সতর্ক। থানা পুলিশের নানা সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। জনবল কম, অন্যান্য ডিউটিও থাকে। তিনি বলেন, আমাদের পাশাপাশি অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও কাজ করছে। মাঝেমধ্যে গ্রেপ্তারও হচ্ছে। সর্বোপরি জনসাধারণ সচেতন না হলে এটি রোধ করা সম্ভব নয়। এর জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার কোনো বিকল্পও নাই।

 

এদিকে  ৫ কেজি ৪০০ গ্রাম হেরোইনসহ নারীসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। র‌্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, চক্রটি পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে রাজশাহীর গোদাগাড়ীর সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে নদীপথে প্রতি মাসে ৪-৫ কেজি হেরোইন নিয়ে আসত। মাদক পরিবহনের কৌশল হিসেবে শাকিব নারী সদস্যদের ব্যবহার করত।

 

তাদের মাদক কারবার চক্রে ১০-১২ জন সক্রিয় নারী সদস্য রয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হেরোইন পাচারের অন্যতম গেটওয়ে হচ্ছে গোদাগাড়ী। র‌্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হেরোইন পাচার রোধে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version