-->

ভেজাল জৈব সারে প্রতারিত কৃষক

ইমরান আলী
ভেজাল জৈব সারে প্রতারিত কৃষক

ইমরান আলী: ভেজাল আর নিম্নমানের জৈব সারে ছেয়ে গেছে সারা দেশের হাটবাজার। বৈধ কোম্পানির প্যাকেটের মোড়ক হুবহু নকল করে একটি চক্র বাজারে ছাড়ার কারণে এসব সার কিনে প্রতারিত হচ্ছেন কৃষক। যার কারণে প্রকৃত ফলও পাচ্ছে না। সম্প্রতি এরকম কিছু অবৈধ জৈব সার কোম্পানিকে চিহ্নিত করেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। দ্রুত এসব ভুয়া ও অবৈধ কোম্পানির বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, এ বিষয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত রয়েছে। আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দিলে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাসায়নিক সারের অতি ব্যবহারের কারণে ফসল ও মাটির ক্ষতি হয়। এ যুক্তি দিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় ও পরিবেশবাদীরা জৈব সার ব্যবহারে কৃষকদের উৎসাহিত করে আসছেন। এ ধরনের সার ব্যবহারে মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকে এবং ফসলের মান ও উৎপাদন ভালো হয় বলে পরামর্শ দেয়া হয়। কিন্তু ভেজাল সার ব্যবহারে উল্টো ফসলে নানা ক্ষতিকারক উপাদান যুক্ত হচ্ছে।

 

এতে ফসলে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান থাকছে না, ফলনও ভালো হচ্ছে না। অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সরকার বিগত ২০২২ সাল পর্যন্ত সারা দেশে প্রায় ৮০টি কোম্পানিকে জৈব সার উৎপাদনের অনুমতি দিয়েছে। এর মধ্যে নানা কারণে ১০টির লাইসেন্স বাতিলও করে দেয়। কিন্তু এর বাইরে অন্তত শতাধিক ভুয়া কোম্পানি গজিয়ে ওঠে। তারা অনুমোদিত কোম্পানির প্যাকেট হুবুহু নকল করে বাজারজাত শুরু করে।

 

এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হন কৃষক। বারবার প্রয়োগের ফলেও কোনোরূপ ফল না পাওয়ায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের শরণাপন্ন হতে থাকেন তারা। পরে কর্মকর্তারা সরেজমিন পরিদর্শন করে বিষয়টির সত্যতা পান। অনুসন্ধানে জানা গেছে, যে কয়েকটি ভুয়া কোম্পানি ভেজাল জৈব সার উৎপাদন করছে এর মধ্যে নিউ সেবক অর্গানিক বাংলাদেশ, পঞ্চবটি, নারায়ণগঞ্জ, (নিউ সেবা জৈব সার)। নিউ সেবক অর্গানিক বাংলাদেশ, পঞ্চবটি, নারায়ণগঞ্জ, (ভার্মি কম্পোস্ট, জৈব সার, রেডি মিক্স সয়েল)।

 

রূপস এগ্রোটেক লিমিটেড (ভ‚মিজ জৈব সার), (সুফলা জৈব সার), নিউ সেবক অর্গানিক বাংলাদেশ, পঞ্চবটি, নারায়ণগঞ্জ, (ভার্মি কম্পোস্ট)। সাউদার্ন এগ্রো প্রোডাক্ট প্রডিউসার কোম্পানি (ভার্মি কম্পোস্ট জৈব সার), মাটি (মাটি জৈব সার), বিটিএস (ভার্মি কম্পোস্ট), বিটিএস (অনিক অর্গানিক ফার্টিলাইজার)। নারায়াণগঞ্জের এসব ভুয়া জৈব সার উৎপাদনের সঙ্গে সোহাগ নামে এক ব্যক্তি জড়িত।

 

সিটি করপোরেশনের জায়গা; এমনকি গাড়ি ব্যবহার করে তিনি এসব নিম্নমানের জৈব সার বাজারজাত করছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। তবে করপোরেশনের নগর পরিকল্পনাবিদ মইনুল ইসলাম বলেন, এ ধরনের তথ্য তার জানা নেই। আমি খোঁজ নিচ্ছি। যদি কেউ এ ধরনের অবৈধ ও অন্যায় কাজ করেন আমি ব্যবস্থা নেব।

 

জানা গেছে, নওগাঁর মহাদেবপুরে এসডি এগ্রোভেট কোম্পানিতে ভেজাল জৈব সার ও রাসায়নিক কীটনাশক জব্দ করে র‌্যাব-৫ ও ভ্রাম্যমাণ আদালত। একইসঙ্গে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা এবং জব্দকৃত ভেজাল জৈব সার ও রাসায়নিক কীটনাশক ধ্বংস করা হয়েছে। র‌্যাব জানায়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে মহাদেবপুর উপজেলার শিবগঞ্জ এলাকায় এসডি এগ্রোভেট কোম্পানিতে অভিযান পরিচালনা করা হয়।

 

এ সময় ১০ হাজার কেজি ভেজাল রাসায়নিক জিপসাম, ৯ হাজার কেজি ভেজাল জৈব জিপসাম, ২২ হাজার ৫০০ কেজি লাইসেন্সবিহীন জৈব সারের কাঁচামাল, ১৮ হাজার কেজি লাইসেন্সবিহীন রাসায়নিক সারের কাঁচামাল, ১৪ হাজার কেজি মেয়াদোত্তীর্ণ রাসায়নিক সারের কাঁচামাল, ১ হাজার ৮০০ লিটার তরল কীটনাশক, ২০ হাজার পিস কীটনাশক চক, ১৫ হাজার পিস বিভিন্ন অবৈধ লেবেল, ৪ হাজার ২০০ কেজি রাসায়নিক চক পাউডার উদ্ধার করা হয়। বগুড়ার শেরপুর উপজেলায় অভিযান চালিয়ে ৩০ বস্তা ভেজাল সার ও জৈব সার তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করে পুলিশ।

 

এ সময় দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশের ভাষ্য, মাটির সঙ্গে ইটের গুঁড়া ও রং মিশিয়ে নকল জৈব সার তৈরি করে বাজারে বিক্রি করছিল একটি অসাধু চক্র। বোরো মৌসুম ঘিরে কৃষকদের ঠকিয়ে প্রতারণা করে আসছিল চক্রটি। বগুড়ার শেরপুর থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) এসএম আবুল কালাম আজাদ বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ভেজাল সার ও কীটনাশক তৈরির কারখানায় অভিযান চালানো হয়। এ সময় ভেজাল সার তৈরিতে জড়িত দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ভেজাল সার তৈরির মূল কারিগর পালিয়ে যাওয়ায় তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।

 

তবে তাকে গ্রেপ্তারে পুলিশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এসএম আবুল কালাম আজাদ আরো বলেন, অভিযানের সময় ৩০ বস্তা ভেজাল সার, ৫০ কেজি রং, ১৫ কোম্পানির প্যাকেটের নকল লেভেল, স্প্রে মেশিন, মাটি ও ইটের গুঁড়ার বস্তা জব্দ করা হয়। মাটি ও ইটের গুঁড়ার সঙ্গে রং মিশিয়ে সার তৈরি করে কৃষকদের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিল তারা। এগুলো ব্যবহারে উপকারের পরিবর্তে ফসলের ক্ষতি হবে। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে।

 

এদিকে মাটির উব্বরতা শক্তি বৃদ্ধি ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের জন্য অপরিহার্য একটি উপাদান হলো জৈব সার বা কেঁচো সার, জৈব সার উৎপাদনের জন্য অবশ্যই কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের লাইসেন্স নেয়া প্রয়োজন। আর এর লাইসেন্স পেতে হলে বিএআরসি, মৃত্তিকা, কৃষি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগে। পাশাপাশি কর্মকর্তারা ফ্যাক্টরি পরিদর্শন, উৎপাদন পণ্যের স্যাম্পল টেস্ট এবং স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তার ক্লিয়ারেন্সের পর রাষ্ট্রপতি কার্যালয় থেকে প্রজ্ঞাপন হয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর লাইসেন্স ইস্যু করে। সব মিলিয়ে ৩-৪ বছর সময়ও প্রয়োজন।

 

কিন্তু এসব নিয়মের কোনো তোয়াক্কা না করে একটি চক্র অবৈধভাবে নিম্নমানের ভেজাল জৈব সার উৎপাদন করে কৃষকদের সরবরাহ করছে। যার পুরো প্রভাব পড়ছে দেশের কৃষির ওপর। মানিকগঞ্জের কৃষক আব্দুর রহমান বলেন, বাজারে নানা রঙের প্যাকেটে অবৈধ ও নিম্নমানের জৈব সারে সয়লাব হয়ে গেছে। দেখে শুনে যাছাই-বাছাই ছাড়া কিনলেই ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে।

 

তিনি বলেন, এ এলাকায় সবজির উৎপাদনের জন্য নানা ধরনের জৈব সার প্রয়োজন হয়। কিন্তু অল্প দামে নিম্নমানের জৈব সার ব্যবহারের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ কৃষক। একই এলাকার কৃষক রবিউল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন এখানে জৈব সারের জন্য নানা লোক আসে। নতুন কোম্পানি, ভালো বলে কৃষককে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে। যারা না বুঝে কেনে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

 

দেখে শুনে যেগুলো অনুমোদিন মানে ভালো সেই সব জৈব সার ব্যবহারের পরামর্শ কৃষক রবিউলের। সার্বিক বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, কৃষকের সঙ্গে প্রতারণা করবে এমন কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। নিম্নমানের জৈব সার কৃষিজমির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এতে করে ফসলের উৎপাদন ব্যাহত করে।

 

তিনি বলেন, ইতোমধ্যে আমরা র‌্যাবের সহায়তা বেশকিছু স্থানে অভিযান পরিচালনা করে গ্রেপ্তার, জরিমানা এবং প্রতিষ্ঠান সিলগালা করে বন্ধ করে দিয়েছি। এ বিষয়ে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের কঠোর নির্দেশনা দেয়া রয়েছে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version