-->

মাদক কারবারে সীমান্তের চরাঞ্চলের নারীরা

ইমরান আলী
মাদক কারবারে সীমান্তের চরাঞ্চলের নারীরা

ইমরান আলী: রাজশাহীর প্রমত্তা পদ্মার কোলঘেঁষা বিশাল চরাঞ্চলে মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়ছেন নারীরা। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ নানা বিষয়ে অনগ্রসর এই জনগোষ্ঠীর নারীদের অর্থের লোভ দেখিয়ে মাদক সরবরাহের কাজে লাগাচ্ছে চিহ্নিত কারবারিরা।

 

সীমান্তের ওপার থেকে মাদকের চালান নিয়ে চরাঞ্চলের নিরাপদ কোনো স্থানে রেখে সেগুলোকে সুবিধামতো সময়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নারীদের দিয়ে সরবরাহ করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ এড়াতে হেরোইন ও ফেনসিডিল সরবরাহে একশ্রেণির নারীর ব্যবহার আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে।

 

বিষয়টি উদ্বেগের চোখেই দেখছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তারা বলছেন, এ বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারির পাশাপাশি নারীরা যেন এ ধরনের কর্মকান্ডে লিপ্ত না হন, সে বিষয়ে তারা পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

 

রাজশাহী জেলা পুলিশ সুপার মাসুদ হাসান বলেন, ইতোমধ্যে আমাদের কাছেও বিষয়টি দৃষ্টিগোচর হয়েছে। আমরা এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করব। পাশাপাশি থানাগুলোকে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী অঞ্চলের বাঘা থেকে শুরু করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ পর্যন্ত সীমান্তঘেঁষা বিশাল চরাঞ্চল রয়েছে। এর মধ্যে বাঘা, চারঘাট, গোদাগাড়ি, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ এলাকা দিয়ে সীমান্তের ওপার থেকে বিপুল পরিমাণ মাদক দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। এই সীমান্ত দিয়ে অন্যান্য মাদকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাচার হয়ে আসে হেরোইন ও ফেনসিডিল। হেরোইন আসে শুধু রাজশাহীর গোদাগাড়ির সীমান্ত এলাকা দিয়ে।

 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজশাহী শহরের পূর্ব-দক্ষিণ এলাকা ঘেঁষে গড়ে উঠেছে বাঘা ও চারঘাট উপজেলা। দেশের বৃহত্তম প্রমত্তা পদ্মা নদী ঘিরে রেখেছে বাঘা ও দৌলতপুর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নকে। মূল ভূখন্ড ছাড়াও দুটি উপজেলায় ছোট-বড় প্রায় ২০টি চর রয়েছে। এর মধ্যে বাঘা উপজেলার চকরাজাপুর ও পাকুড়িয়া ইউনিয়নের চকরাজাপুর চর, চৌমাদিয়া চর, আতারপাড়া চর, টিকটিকি পাড়ার চর, লক্ষীনগর চর, দাদপুর চর, দিয়ার কাদিরপুর চর, নিচ পলাশির চর, পলাশি ফতেপুর চর, কড়ালী নওসারা সুলতানপুর চর, দৌলতপুর উপজেলার ফিলিপ নগর ও চিলমারী ইউনিয়নের হবির চর, চিলমারীর চর, বৈরাগীর চর, মাজারদিয়ার চর, মরার চর, নতুন চর, মানিকের চর প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

 

আর এই চরের সীমান্ত এলাকা দিয়ে দুই উপজেলায় প্রবেশ করছে ফেনসিডিল, ইয়াবা ও হেরোইনের বড় বড় চালান। এগুলো দেখভালের জন্য দুই উপজেলায় স্থাপন করা হয়েছে পাঁচটি বর্ডার গার্ড (বিজিবি) ক্যাম্প। তারপরেও নানা কৌশল অবলম্বন করে পাচার হয়ে আসছে মাদক।

 

বাঘা থানা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, এ উপজেলায় প্রায় তিন শতাধিক মাদক চোরাকারবারি রয়েছে। এর মধ্যে দুইয়ের অধিক মাদক মামলা আছে এরকম নামের তালিকা রয়েছে ১৭০ জনের। গত এক বছরে বিভিন্ন সময় পৃথক-পৃথক অভিযানে ৮২ জনকে আটক করা হয়। যাদের অনেকেই জামিনে মুক্ত। তাদের দেয়া তথ্যমতে, পূর্বের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন নারী মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যা বাড়ছে।

 

স্থানীয় লোকজন জানান, নারী মাদক ব্যবসায়ীদের শনাক্ত করতে তাদের শরীরে যে কউ হাত দিতে পারে না। এ কারণে এ অঞ্চলের চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীরা নতুন কৌশল হিসেবে অর্থের লোভ দেখিয়ে নিজের স্ত্রীসহ প্রতিবেশী নারীদের মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ত করছে। এদের মধ্যে সর্বশেষ গত সপ্তাহে শিল্পী নামে এক নারী মাদক চোরাকারবারিকে ফেনসিডিলসহ আটক করে বাঘা থানা পুলিশ।

 

বাঘা থানা পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা (ইন্সপেক্টর) আব্দুল করিম জানান, আমরা গত মাসে একটি অভিযানে ৯০০ বোতল ফেনসিডিল আটক করেছিলাম। এর কয়েকদিন পর একজন নারী মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য পায়। নগদ অর্থের লোভে যে অনেক নারীরা এখন মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়ছে, এটাই সত্য। এর সংখ্যা উদ্বেগজনক বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

 

বাঘা থানার ওসি সাজ্জাদ হোসেন বলেন, কৌশলে মাদক কারবারিরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ এড়াতে নারীদের ব্যবহার করছে। বিষয়টি আমাদের নজরে আসার পর আমরা গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করেছি। পাশাপাশি এটি যেন আর কোনোভাবেই বৃদ্ধি না পায়, সেজন্য সামাজিকভাবেও সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

 

জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে পুলিশের একটি সূত্র জানায়, নগদ অর্থের লোভে অনেক নারী এখন মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়ছে। তারা মূলত মাদকগুলো এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরবরাহ করে থাকে। এতে করে তারা নগদ টাকা পায়।

 

তবে বাঘার মনিগ্রাম সীমান্ত এলাকার চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম বলেন, মাদক ব্যবসায়ীরা নতুন কৌশল হিসেবে এখন নারীদের ব্যবহার করছে। এটি যে কোনো উপায়ে বন্ধ করতে হবে। এর মধ্যে কয়েকজন চিহ্নিত নারী মাদক কারবারি সম্প্রতি হাজত থেকে জামিনে বেরিয়ে এসে খুব জোরেশোরে মাদক বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি অতিসত্বর এসব নারী মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তারের দাবি জানান।

 

তিনি বলেন, চরাঞ্চলের অন্যান্য নারীকে যেন এ কাজে ব্যবহার করতে না পারে, সে ব্যাপারে আমরা কাজ করছি। এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের চরবাগডাঙ্গা, হাকিমপুর, আলাতুলি ও পার্শ্ববর্তী রাজশাহীর গোদাগাড়ী সীমান্তের ওপারে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার সীমান্ত শহর লালগোলা শহর হচ্ছে বাংলাদেশে সব ধরনের মাদক পাচারের মূল ঘাঁটি। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার মতে, ভারতের লালগোলায় রয়েছে হেরোইন ও ফেনসিডিল তৈরির শতাধিক কারখানা।

 

বাংলাদেশের মাদক কারবারিরা এসব চালান ধরছে মাঝপদ্মার আলাতুলি, হাকিমপুর, বগচর, কোদালকাটি ও গোদাগাড়ী এলাকায়। চরবাগডাঙ্গা ও গোদাগাড়ীর মাদক কারবারিরা এখন ফ্রি-স্টাইলে জমজমাট মাদকের কারবার চালাচ্ছে। মাঝে মাঝে দু-একটি চালান ধরা পড়লেও অধিকাংশই থাকছে অধরা।

 

গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে, গোদাগাড়ী হচ্ছে হেরোইন চোলাচালানের আন্তর্জাতিক রুট। এখানে ২৫৩ জন তালিকাভুক্ত হেরোইন চোরাকারবারি সক্রিয়। করোনা ও বন্যার সুযোগে তারা অনেকটা নির্বিঘ্নে হেরোইন পাচার করছে। এ ছাড়াও গোদাগাড়ীর রেলবাজার, ফুলতলাঘাট, প্রেমতলী, খরচাকা ও পবা উপজেলার সোনাইকান্দি ঘাট এখন মাদক পাচারের মূল রুট হয়ে উঠেছে। নদীপথে আসা ফেনসিডিল ও গাঁজার বড় বড় চালান রাতের আঁধারে এনে দেশের ভেতরে পাচার করা হচ্ছে।

 

জানা গেছে, ফারাক্কার ৬ কিলোমিটার ভাটিতে শিবগঞ্জের সীমান্ত গ্রাম মাসুদপুর ও রঘুনাথপুর দিয়ে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর ১৫৬ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে রাজশাহীর চারঘাট-বাঘা হয়ে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় পুরোপুরিভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে পদ্মা নদী। পদ্মার দীর্ঘ এই গতিপথের দুই পাড়ে রয়েছে ভারত-বাংলাদেশের ছোট-বড় দুই শতাধিক গ্রাম, জনপদ ও চরাঞ্চল। গ্রামগুলো এখন মাদক চোরাচালানের মূল অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে। অভিযোগ, গরু পাচার রোধে বিএসএফ অতিমাত্রায় সক্রিয় হলেও মাদক পাচারে তাদের নিষ্ক্রিয়তায় বাংলাদেশে মাদক পাচার বেড়েছে। আর এসব কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে নারীদের।

 

রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি আব্দুল বাতেন বলেন, এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্ট এলাকার পুলিশ সুপারদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যাতে এটি বৃদ্ধি না পায় সে ব্যাপারে তারা পদক্ষেপ নেবেন।

 

তিনি আরো বলেন, জনসচেতনতা বাড়াতে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদেরও কাজে লাগানো হবে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version