-->
অনৈতিক কাজের অভিযোগে ডিএনসিসির মামলা

স্পা সেন্টারে অভিযানের নেপথ্যে মাসোহারা

লাফিয়ে পড়ে দুই নারীর মৃত্যু

ইমরান আলী
স্পা সেন্টারে অভিযানের নেপথ্যে মাসোহারা

ইমরান আলী: রাজধানীর গুলশানে স্পা সেন্টারে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অভিযান চালানোর নেপথ্যে রয়েছে মাসোহারা। মাসোহারার টাকা সময়মতো না পাওয়ায় ওই স্পা সেন্টারে অভিযান চালায় ডিএনসিসির ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুস সালামের নেতৃত্বে একটি দল। আর ওই অভিযানের সময় নিজেকে বাঁচাতে ৭তলা থেকে লাফ দেন ফারজানা ও ফারিহা নামে দুই তরুণী। এতে করে ফারজানার বুধবার মৃত্যু হয় আর গতকাল বৃহস্পতিবার মৃত্যু হয় ফারিহার।

 

স্থানীয়দের অভিযোগ, গুলশান-বনানীতে অনেক স্পা সেন্টার রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে চলেও আসছে। এর আগে পুলিশ র‌্যাব বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালালেও সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে অভিযান চালানো হয়নি। তারা বলছেন, ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুস সালামের নামে প্রতি স্পা সেন্টার এবং রেস্ট হাউস, গেস্ট হাউস থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা ওঠে। তবে এ অভিযোগের বিষয়ে আব্দুস সালামের সঙ্গে একাধিকবার তার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। বুধবারের দুর্ঘটনার পর থেকে তিনি মোবাইল বন্ধ রেখেছেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তার কয়েক সহকর্মী এ প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছেন।

 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরেই গুলশান বনানী এলাকায় স্পা সেন্টার পরিচালিত হচ্ছে। আর এ স্পার আড়ালে দেহব্যবসা ওপেন সিক্রেট। মাঝেমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে বন্ধ থাকলেও পরে আবারো তা চালু হয়। আর এভাবেই চলে আসছে অবৈধ কর্মকান্ড। স্পা সেন্টারগুলো থেকে মাসিক বড় অঙ্কের মাসোহারা সব জায়গায় যায়। এক্ষেত্রে ডিএনসিসির ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুস সালামের কাছেও যায়। 

 

অনুসন্ধানে জানা যায়, স্পা সেন্টারগুলোর একেকটি থেকে ডিএনসিসির ম্যাজিস্ট্রেটের নামে প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা মাসোহারা ওঠে। আর এ টাকা প্রতি মাসের ৫ থেকে ৭ তারিখের মধ্যে তার কাছে চলে যায়। কিন্তু এবারে গুলশান ২ নম্বরের ৪৭ রোডের ২৫ নম্বর বাসায় হাসানের পরিচালিত এ স্পা থেকে টাকা যায়নি। আর এ কারণে ক্ষুব্ধ হয়েই তিনি অভিযান পরিচালনা করেন। স্পা পরিচালনাকারী হাসানের সঙ্গে তার দীর্ঘদিন ধরে সখ্যও রয়েছে বলেও জানা গেছে। এছাড়া রেস্ট হাউস, গেস্ট হাউসগুলো থেকে নিয়মিত মাসোহারাও নেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

 

জানা যায়, স্পা বা রেস্ট হাউসগুলোয় সিটি করপোরেশন কোনোদিনই অভিযান পরিচালনা করেনি। এবারই প্রথম এ ধরনের অভিযানে যায় তারা। স্বাভাবিকভাবেই তাদের এ অভিযান নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। আর তাদের পরিচালিত প্রথম অভিযানেই দুই নারীর আত্মাহুতির ঘটনা ঘটল।

 

অভিযানের শুরু থেকে শেষ : প্রত্যক্ষদর্শী ও অভিযানসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বুধবার দুপুর ২টায় ডিএনসিসির ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুস সালামের নেতৃত্বে এপিবিএনসহ ডিএনসিসির একটি দল ৬তলা ভবনটিতে প্রবেশ করে। আবাসিক ভবনের নামে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলছে এমন অভিযোগের ভিত্তিতে ভবনটিতে অভিযান পরিচালনা করে ডিএনসিসি। অভিযানের একপর্যায়ে ভবনের চারতলার স্পা সেন্টারে প্রবেশ করে আভিযানিক দল। এদিকে অভিযানের কথা শুনে স্পা সেন্টারে কর্মরত নারীরা পালানোর জন্য বিভিন্ন রাস্তা খুঁজতে থাকেন। এ সময় ফারজানা ও তার দুই নারী সহকর্মী অভিযানকারী দল থেকে নিজেদের লুকিয়ে রাখতে ভবনের বাম পাশের একটি কক্ষের এসির কম্প্রেসারের ফাঁক দিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন।

 

এ সময় ফারজানা ও তার আরেক সহকর্মী এসি কম্প্রেসারের ফাঁক দিয়ে পাশাপাশি থাকা দুটি ভবনের নিচের ফাঁকা জায়গায় পড়ে যান। তাদের তৃতীয় সহকর্মী এসির কম্প্রেসারের ফাঁকে আটকে থাকেন। পরে তাকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা গিয়ে জীবিত উদ্ধার করেন।

 

অন্যদিকে ফারজানা নিচে পড়ে যাওয়ায় তার মাথা ও শরীরের বিভিন্ন অংশ দিয়ে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। এ কারণে তিনি হাসপাতালে মারা যান। ঘটনার সময় উপস্থিত থাকা এক প্রত্যক্ষদর্শী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আভিযানিক দলটি ভবনে প্রবেশ করার ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে ওপর থেকে নিচে কিছু একটা পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনে আমরা দৌড়ে যাই। আমরা ভবনের বাম পাশের নিচের খালি জায়গায় গিয়ে দেখি, পাশাপাশি দুই ভবনের মাঝে দুই নারী পড়ে আছেন।

 

এদের মধ্যে একজনের মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছিল। অন্যজন গুরুতর আহত হয়ে কাতরাচ্ছিলেন। তখন কিছু পুলিশ সদস্য তাদের ধরাধরি করে নিয়ে আসেন। এর প্রায় ৩০ মিনিট পর থানা-পুলিশ এলে ওই দুই নারীকে গাড়িতে করে হাসপাতালে নেয়া হয়। এর মধ্যে স্পা সেন্টার থেকে ৮-১০ জন নারীকে গাড়িতে তুলে নিয়েও যায় অভিযানকারী দলটি।

 

ডিএনসিসির মামলা : আবাসিক ভবনে স্পা সেন্টারে অভিযান চালানোর ঘটনায় ডিএনসিসির পক্ষ থেকে একটি মামলা করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান থানায় মামলাটি করা হয়। মামলায় স্পা সেন্টারের মালিক, ব্যবস্থাপক ও স্পা সেন্টারের ফ্ল্যাটের মালিককে আসামি করা হয়েছে। এছাড়া ডিএনসিসির অভিযানে আটক ৭ নারীর বিরুদ্ধে দেহব্যবসা করার অভিযোগে ডিএমপির অধ্যাদেশ অনুযায়ী প্রসিকিউশন ইউনিটের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে।

 

মামলার আসামিরা হলেন স্পা সেন্টারের মালিক হাসানুজ্জামান ওরফে হাসান, তার স্ত্রী ও স্পা সেন্টারের ম্যানেজার সাইনুর আক্তার পায়েল ও ফ্ল্যাটের মালিক এটিএম মাহাবুবুল আলম। মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন গুলশান থানার এসআই হাসিব। তিনি বলেন, গুলশানের স্পা সেন্টারে অভিযানের ঘটনায় ডিএনসিসির প্রসিকিউশন অফিসার (অঞ্চল-৩) আব্দুস সালাম বাদী হয়ে মামলা করেছেন।

 

মামলায় তিনজনকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় অভিযোগ আনা হয় অভিযুক্তরা সংঘবদ্ধভাবে অনৈতিক উপায়ে লাভবান হওয়ার জন্য পতিতালয় চালাচ্ছিল। মামলাটি আমরা তদন্ত করছি। এছাড়া ডিএনসিসির অভিযানে আটক ৭ নারীকে পতিতাবৃত্তিতে জড়িত থাকার অভিযোগে ডিএমপির অধ্যাদেশ অনুযায়ী প্রসিকিউশন ইউনিটের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে।

 

ভোরের আকাশ/নি

মন্তব্য

Beta version