-->
প্রতারণার নতুন ফাঁদ

ফোন করলেই সর্বনাশ

সম্পর্কে না জড়ানোই সমাধান : পুলিশ

ইমরান আলী
ফোন করলেই সর্বনাশ

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রেমের ফাঁদে পড়ে সর্বনাশ ডেকে আনছেন তরুণরা। কেউ রূপের মোহে পড়ে বিবাহিত নারীকে বিয়ে করে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। আবার অনেকে প্রেমের ফাঁদে পা দিয়ে ব্লাক মেইলের শিকার হচ্ছেন।

 

বিশেষ করে প্রবাসীদের টার্গেট করে এ ধরনের ফাঁদ পাতা হচ্ছে। ফেসবুকের রিলস ভিডিওতে এ ধরনের পাতা ফাঁদে অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়েছেন। সম্প্রতি এ রকম দুটি ঘটনার শিকার হয়েছেন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী এক তরুণ ও কুমিল্লার আরেক তরুণ।

 

ঘটনা-১ : অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী মাইনুল ইসলাম। নারায়ণগঞ্জের এ বাসিন্দা দীর্ঘদিন ধরে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে বসবাস করছেন। সেখানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে রিলস ভিডিও দেখে প্রেমে পড়ে যান। পরিচয় হয় একই এলাকার তরুণী শিউলির (ছদ্মনাম) সঙ্গে। প্রবাসী জীবন তারপর একই এলাকার তরুণী হওয়ায় ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে চায় মাইনুল। মাইনুলের চাওয়াতে সাড়া দেয় শিউলিও।

 

এভাবেই কিছুদিন চলতে থাকে তাদের। একপর্যায়ে ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যায় দুজনেরই। সুন্দরী হওয়ার সুবাদে মাইনুলের আগ্রহ ছিল শিউলির চেয়ে একটু বেশি। ঘনিষ্ঠতা এত বেশি বেড়ে যায় ভার্চুয়াল দেখা আর কথা বলা ভালো লাগে না মাইনুলের। চলে আসেন বাংলাদেশে। আর দেশে এসে সামনাসামনি দেখাতে মুগ্ধ হন তিনি। অপেক্ষার পালা শেষ করতেই দিয়ে দেন বিয়ের প্রস্তাব। বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হয় শিউলিও। প্রবাসী মাইনুলের আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে বিয়ের কাবিন ধার্য করা হয় দশ লাখ টাকা। ঘরোয়া আয়োজনেই বিয়ে হয় মাইনুল ও শিউলির।

 

বিয়ের সপ্তাহ না পেরোতেই মাইনুলের সন্দেহ হয় শিউলিকে। একপর্যায়ে মাইনুল বুঝতে পারেন তিনি ফাঁদে পড়ে গেছেন। বিয়ের আগে শিউলি নিজেকে অবিবাহিত বললেও মাইনুল জেনে যান সে এর আগেও একইভাবে আরেকজনকে বিয়ে করেছিল। সেই সংসারে তার এক ছেলেসন্তানও রয়েছে। আর সে বিয়েটাও একই কায়দায়। এরপর শিউলিকে ডিভোর্স দিয়ে দেন মাইনুল। পরে দুই পরিবারের মধ্যে সমঝোতায় ৮ লাখ টাকায় রফা হয়।

 

জানা যায়, শিউলি এর আগেও একই কায়দায় আরেক প্রবাসীকে বিয়ে করে। এ ছাড়াও কয়েকজন তরুণ ব্যবসায়ীকে এভাবে ফাঁদে ফেলে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। ভালো লাগার মানুষের এমন চরিত্রহীন একের পর এক সংবাদে মাইনুল আবারো অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে চলে যান।

 

ঘটনা-২ : কুমিল্লার তরুণ ব্যবসায়ী সালাউদ্দিন আহমেদ। একইভাবে প্রেমে পড়ে যান নারায়ণগঞ্জের লুবনার (ছদ্মনাম) সঙ্গে। ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে দুজনের। একপর্যায়ে তাদের দেখা হয়। দেখাদেখির মধ্যেই লুবনার এক প্রস্তাবে রাজি হন সালাউদ্দিন। চলে আসেন নারায়ণগঞ্জে। যখন লুবনা-সালাউদ্দিন এক রুমে তখনই বুঝতে পারেন সালাউদ্দিন লুবনার পাতানো ফাঁদে ধরা পড়েছেন। প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা দিয়ে পাতানো ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসেন সালাউদ্দিন।

 

শুধু এ দুটি ঘটনাই নয়, বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সুন্দরী তরুণীরা একধরনের প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে। আর এ ফাঁদের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রটি। চক্রটি টার্গেট করে প্রবাসী বা দেশের তরুণ ব্যবসায়ীদের। প্রথমে এক ধরনের সখ্যের মাধ্যমে তারা অন্য সম্পর্কে জড়ানোর অফারের মাধ্যমে মূলত এ কাজটি করছেন। আর যারাই এ ফাঁদে পা দিচ্ছেন, তারাই সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। রাজধানী ঢাকা ছাড়াও দেশের বড় বড় শহরগুলোতেও এ ধরনের ফাঁদ পেতেছে চক্রটি।

 

সম্প্রতি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ এ ধরনের কয়েকজন নারী প্রতারককে আটক করেন। পরে তাদের জিজ্ঞাসাবাদে মেলে চাঞ্চল্যকর তথ্য। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে আটক দোলা নামে এক তরুণী জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, বিভিন্ন বিত্তশালী ব্যক্তিকে টার্গেট করে মোবাইল ফোন নম্বর সংগ্রহ করে পাশাপাশি তাদের ফেসবুক আইডি নিয়ে রিকোয়েস্ট পাঠানো হয়। পরে তাদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে কৌশলে একটি সুনির্দিষ্ট ফ্ল্যাটে নিয়ে এসে ফাঁদে ফেলে। আর অন্তরঙ্গ মুহূর্তে এ চক্রের অন্য সদস্যরা রুমে প্রবেশ করে।

 

দোলা জানায়, তাদের এ চক্রে ভুয়া পুলিশ এমনকি ভুয়া সাংবাদিকও থাকে। তারা অন্তরঙ্গ সময়ে রুমে ঢুকে টার্গেট করা ব্যক্তির সঙ্গে জোরপূর্বক আপত্তিকর ছবি তোলেন। আর ওই ছবি পত্রিকায় প্রকাশের ভয় দেখিয়ে মামলার হুমকি দেয়া হয় ভুক্তভোগী ব্যক্তিকে। পরে ওই ব্যক্তির সঙ্গে দেনদরবারের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করা হয়। এর আগে গোয়েন্দা পুলিশের কাছে আটক হয় রোজি আক্তার তানহা নামের আরেক তরুণী।

 

বেসরকারি এক প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে সে। একপর্যায়ে তাকে কৌশলে ডেকে নিয়ে তার সহযোগীদের নিয়ে আটকে দেয়। পরে ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। আর শেষে ১০ লাখ টাকায় সমঝোতা হয়। এ ঘটনা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ জানতে পেরে সুন্দরী তরুণী তানহাসহ ওই চক্রের পাঁচজনকে আটক করে।

 

ঢাকা মহানগর পুলিশের সিটিটিসির সাইবার ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার নাজমুল ইসলাম জানান, সম্প্রতি আমাদের কাছে এ ধরনের অভিযোগ আসছে। এরই মধ্যে এ চক্রের অন্যতম একটি গ্রুপকে আমরা আটক করতে সক্ষম হয়েছি।

 

তিনি বলেন, এ চক্রটি একটি কাজ করার পর ২/৩ মাস গা ঢাকা দিয়ে থাকে। এরপর আবার তারা মধ্যবয়সী বিত্তবান ব্যক্তিদের টার্গেট করে আবার প্রতারণার কাজটি চালায়। তিনি বলেন, মূলত নারীদের দিয়ে রূপের ফাঁদে ফেলে। আর এ ফাঁদে পা দিয়ে ভুক্তভোগীরা সর্বস্ব হারান। এসব ঘটনায় প্রতারিত হয়ে কেউ যদি অভিযোগ করেন, তবে আমরা ব্যবস্থা নেব।

 

তিনি আরো বলেন, নারীদের ব্যবহার করে প্রতারণা নতুন বিষয় না হলেও বর্তমানে এ ধরনের কর্মকান্ড বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে গোয়েন্দা পুলিশ কিছু কিছু চক্র শনাক্ত করে তাদের গ্রেপ্তারও করেছে। আমাদের কাছে এ ধরনের অভিযোগও রয়েছে। আমরা তা নিয়ে অনুসন্ধান অব্যাহত রেখেছি।

 

তিনি বলেন, নিজেরা এড়িয়ে যাওয়াই এর সহজ সমাধান। কিন্তু লোভের বশবর্তী হয়ে অনেকেই নানা সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়ে নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনেন।

 

ফেসবুক রিলস ভিডিও কী : বর্তমান সময়ে ফেসবুক একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যম। এই ফেসবুক এখন শতাধিক মানুষ ব্যবহার করছে। এই ফেসবুক থেকে ফেসবুকের নতুন একটি ফিচার যোগ করা হয়েছে এবং সেই নতুন ফিচারটি হলো ফেসবুক রিলস। ফেসবুক রিলসটি হলো টিকটকের মতো ছোট ছোট শর্ট ভিডিও তৈরি করা এবং রিলসে পোস্ট করা। আপনার ফেসবুক প্রোফাইলটি যদি প্রফেশনাল মুড অন থাকে, তাহলে আপনি আপনার ফেসবুক প্রোফাইলে রিলস ভিডিওর অপশন পেয়ে যাবেন। আপনি আপনার ফেসবুকে ঠিক যেভাবে স্টোরি পোস্ট করতে পারেন, ঠিক সেভাবে আপনি ফেসবুকে রিলস ভিডিও পোস্ট করতে পারবেন।

 

প্রতারণার ফাঁদ : রিলস ভিডিওতে আপলোড করা হচ্ছে মেয়ে কণ্ঠে ‘যারা আমার সঙ্গে কথা বলতে চান তারা কমেন্টস বক্সে হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর দেয়া হয়েছে, সেখানে গিয়ে কল করুন।’ মজার ব্যাপার হচ্ছে, এখানে যে ভিডিওর সঙ্গে মেয়ের ছবি দেয়া হচ্ছে সেটি তার প্রকৃত ছবি নয়। বিভিন্ন স্থান থেকে ছবি সংগ্রহ করে সেটিকে মোন গ্রাফিক্সে কণ্ঠ জুড়ে দিয়ে এ ফাঁদ পাতা হচ্ছে। আর ছবি দেখেই কিছু প্রবাসী সেখানে ফোন করছেন।

 

তাদের সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলে আকৃষ্ট করা, এমনকি ভিডিওকলের মাধ্যমে ছবি শেয়ারিংয়েও জড়িয়ে পড়ে। আর এর পরেই ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে অর্থ আদায়, আবার বিয়ের নামে নাটক সাজিয়েও লাখ লাখ টাকা আদায় করছে এ চক্র।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version