-->
তথ্য সংগ্রহ করছেন গোয়েন্দারা

শতাধিক কাউন্সিলরের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি

ইমরান আলী
শতাধিক কাউন্সিলরের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি

ইমরান আলী: কারো মুখের কথাই আইন, কেউ চাঁদাবাজ-টেন্ডারবাজ, কেউ মার্কেটের দখলবাজ-ভ‚মিদস্যু, কারো ভয়ে মুখ খোলেন না কেউ, কেউ অঘোষিত রাজা, কেউ ক্যাসিনোর নিয়ন্ত্রক, ফুটপাত থেকে কোটিপতি বনেছেন কেউ কেউ, আবার বিরোধী রাজনৈতিক দলের দলীয় কর্মসূচিতে লোক সরবরাহ করেছেন অনেকে। গোয়েন্দা তদন্তে এমন তথ্য উঠে এসেছে এদের বিরুদ্ধে।

 

রাজধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের এমন প্রায় শতাধিক কাউন্সিলরের ওপর সরকারের বিশেষ নির্দেশে নজরদারি শুরু করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। তাদের অতীত কর্মকান্ড পর্যালোচনা করে তৈরি করা হচ্ছে বিশেষ প্রতিবেদন। একই সঙ্গে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে তাদের গতিবিধির ওপর নজরদারি করা হচ্ছে। বিশেষ করে বর্তমান সময়ে বিরোধী দলের আন্দোলন কর্মসূচিতে লোক সমাগমের জন্য গোপনে তাদের আঁতাতের বিষয় নিয়ে মাঠ পর্যায়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করছেন। এদের নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করা গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।

 

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, বিরোধী রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন সভা-সমাবেশে টাকার বিনিময়ে কর্মী পাঠাচ্ছেন বেশকিছু কাউন্সিলর। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে তারা বিরোধী শিবিরে দৌড়ঝাঁপও করছেন। নানাভাবে যোগাযোগ রক্ষার চেষ্টাও করছেন। বিশেষ করে আন্দোলনের সময় লোক সমাগমের জন্য এসব কাউন্সিলরের হাত রয়েছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা মনে করেন। এ কারণে বিএনপির পাশাপাশি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাউন্সিলরদের গতিবিধিও নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে।

 

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, কিছু কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দখলবাজি, জুয়া পরিচালনাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগ আমলে নিয়েও কাজ করছেন কর্মকর্তারা। বছরজুড়েই তাদের গতিবিধি নজরদারির মধ্যে থাকবে। এ ছাড়া আলোচিত ক্যাসিনোকান্ডে যেসব কাউন্সিলর জড়িত ছিলেন, তাদের নিয়েও কাজ চলছে। অভিযোগ থাকা কাউন্সিলরদের অতীত-বর্তমান কর্মকান্ড নিয়ে তাদের প্রত্যেকের পৃথক প্রতিবেদন থাকবে। সেই প্রতিবেদনের আলোকে ব্যবস্থাও নেয়া হবে।

 

এদিকে জানা যায়, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে মোট ১২৯টি ওয়ার্ড রয়েছে। এর মধ্যে উত্তর সিটিতে ৫৪ এবং দক্ষিণ সিটিতে ৭৫টি। প্রত্যেকটি ওয়ার্ডেই একজন করে কাউন্সিলর রয়েছেন।

 

গোয়েন্দাদের হিটলিস্টে যারা : গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, ফরিদুর রহমান খান ইরান ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ২৭নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র ফার্মগেট এলাকায় দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কোচিংবাণিজ্য সবকিছুই তার একক নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে অভিযোগ। তার ক্ষমতার কাছে সবাই ধরাশায়ী। তার ইচ্ছার বাইরে গেলেই চরম নির্যাতনের শিকার হতে হয়। ভয়ে মুখ খোলেন না কেউ। অনেকের মতে, ফার্মগেট এলাকার ‘অঘোষিত রাজা’ ইরান। তার কথাই সেখানে আইন, তিনিই সর্বেসর্বা। ফুটপাত থেকে শুরু করে বড় বড় দোকানে চাঁদাবাজি করে তার বাহিনী। অভিযোগ অস্বীকার করে ফরিদুর রহমান ইরান বলেন, এ ধরনের ঢালাও অভিযোগ করাটা যুক্তিযুক্ত নয়।

 

ঢাকা দক্ষিণের ৫৯নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আকাশ কুমার ভৌমিক। কদমতলী থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তিনি। ১০ বছর আগেও ছিলেন তরকারি বিক্রেতা। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রীর ছত্রছায়ায় রাতারাতি বদলে যায় তার জীবনযাত্রা।

 

লেখাপড়া খুব একটা না থাকলেও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের টেন্ডার প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে তিনি ছিলেন অন্যতম। কাউন্সিলর পদে জয়ের পর ভ‚মি দখল, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসায় তার দাপট আরো বেড়ে যায়। তার ক্যাডার বাহিনীর অত্যাচারে এলাকার লোকজন অতিষ্ঠ। ক্ষুব্ধ স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও। এসব অভিযোগ পেয়েছেন গোয়েন্দারা।

 

৫৬নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেনের ওপর এলাকায় কেউ কথা বলার সাহস পায় না। এলাকাবাসীর অভিযোগ, কাউন্সিলর হোসেনের বাইরে কেউ কথা বললেই তার ওপর নির্যাতন নেমে আসে। এলাকায় মাদক বিক্রি, বাড়ি দখল, চাঁদাবাজি সবকিছুই তার নিয়ন্ত্রণে। এলাকায় কাউন্সিলর যাই বলবেন, সেটাই আইন বলে তিনি নিজেই প্রচার করেন। তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ সামনে রেখে কাজ করছে গোয়েন্দারা।

 

২০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরিদ উদ্দিন আহমেদ রতন। তাকে অনেকেই ‘ম্যাজিক রতন’ বলে অভিহিত করেন। গুলিস্তান এলাকায় তার একক আধিপত্য। মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব থেকে ক্যাসিনোর বড় একটা ভাগ পেতেন তিনি। সিটি করপোরেশনের কয়েকটি মার্কেটে দখল, চাঁদাবাজিসহ বহু অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। বর্তমানে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারিতে আছেন এই কাউন্সিলর। র‌্যাবের হাতে আটক যুবলীগ নেতা খালেদ ভ‚ঁইয়া, জি কে শামীম ও সম্রাটের সঙ্গে তার সখ্য এবং ব্যবসায়িক সম্পর্ক খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা। একসময় ফুটপাত থেকে উঠে আসা রতন এখন শতকোটি টাকার মালিক। তার বিরুদ্ধেও এসব অভিযোগ সামনে রেখে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

 

এ বিষয়ে কাউন্সিলর রতন তার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমি নিজেই চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে। আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন।

 

নানা অভিযোগ আছে দক্ষিণের ২৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাসিবুর রহমান মানিকের বিরুদ্ধে। প্রকল্পের কাজে বাধা দিয়ে ঠিকাদারের কাছ থেকে বড় অঙ্কের অর্থ আদায়, এলাকার দোকান, মার্কেটসহ বিভিন্ন স্থাপনা থেকে চাঁদা আদায় ও মাদক ব্যবসায় সহযোগিতা করাসহ বহুবিধ অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত করছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

২৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সলিমুল্লাহ সলুর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের অভিযোগে ২৪টির বেশি মামলা আছে। ১৯৭৮ সালে বিজলী মহল্লার একটি বাড়িতে ডাকাতি করতে গিয়ে আটক হয়ে গণপিটুনির শিকার হন সলু। পরে সামরিক আদালতে তিন বছর সাজা হয় তার। সাজা ভোগের পর রেস্টুরেন্ট ব্যবসা শুরু করেন সলু।

 

ওই সময় আবুল, হাসু, ‘কাইল্যা’, কাশেমসহ কয়েকজনকে নিয়ে দখল ও চাঁদাবাজির একটি বিশেষ বাহিনী গড়ে তোলেন তিনি। ওই বাহিনী দিয়ে সাধারণ মানুষের সম্পত্তি, খাস জমি, খাল ও জলাধার দখল করে এখন বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক সলু। মোহাম্মদপুর এলাকায় নামে-বেনামে তার অর্ধশত বাড়ি রয়েছে। যার অধিকাংশই অবৈধ দখল করা। অপারেশন ক্লিনহার্টের সময় অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হন সলু।

 

বিএনপি নেতা বাবুল, ছাত্রদল নেতা সজল, ওয়ার্ড কমিশনার শাহাবুদ্দিন, যুবলীগ নেতা ইউনুস, ওয়ার্ড বিএনপির সহসভাপতি জামান খুন ও ৪৪ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার রাজু হত্যা মামলার আসামি এই সলু। বিএনপি ও জাতীয় পার্টি ঘুরে আওয়ামী লীগে যোগ দেয়া সলু ছিলেন একসময় সংঘবদ্ধ ডাকাত দলের সদস্য। তুরাগ নদ ও বেড়িবাঁধ এলাকায় নৌকা ও গাড়িতে ডাকাতি করতেন তিনি।

 

পুলিশ ও গোয়েন্দাদের তালিকাতেও সন্ত্রাসী হিসেবে সলুর নাম রয়েছে। এ ছাড়াও তার ছেলেকে দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে নারী ও মাদকের সিন্ডিকেট। হোটেল ও ক্লাবপাড়ায় নারী সাপ্লাইয়ের কাজ এ সিন্ডিকেটের। বেশির ভাগ সময় তার ছেলের উত্তরা, গুলশান ও ধানমন্ডিতে আসা-যাওয়া রয়েছে। জানা গেছে, মোহাম্মদপুরে তার বাসাতে এই সিন্ডিকেটের একাধিক নারী আসা-যাওয়া করে। ভোরে আসে এবং গভীর রাতে তারা চলে যায়। রাফি নামের তার ছেলে এ সিন্ডিকেট পরিচালনা করে। রেস্টুরেন্ট ব্যবসার আড়ালে তার এ কর্মকাÐ বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দারা। এদিকে এ বিষয়ে কাউন্সিলর সলুর মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।

 

ঢাকা উত্তরের ৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তাইজুল ইসলাম চৌধুরী বাপ্পি যেন ওই এলাকার অঘোষিত রাজা। রূপনগরের ঝিলপাড় বস্তি থেকে অবৈধ গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ ও ডিশলাইন থেকে মাসে আয় হতো অন্তত দুই কোটি টাকারও বেশি। রূপনগর ও আশপাশ এলাকার পরিবহন থেকে চাঁদা তোলা ও মাদক কারবারিদের সহায়তারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তার মালিকানাধীন একাধিক সুরম্য বাড়ি ও গাড়ি রয়েছে। অল্প সময়ে এত সম্পদের নেপথ্যে রয়েছে তার দখলদারিত্ব আর চাঁদাবাজি।

 

তাইজুল ইসলাম চৌধুরী বাপ্পি বলেন, আমার বিরুদ্ধে একটি চক্র বরাবর কুৎসা রটনা করে। এটিও এক ধরনের কুৎসা রটনারই অংশ।

 

ঢাকা উত্তরের চার নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জামাল মোস্তফার বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার পৃষ্ঠপোষকতা এবং চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে। মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুর পর ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এ সময় তার ছেলে মাদকসহ র‌্যাবের হাতে আটক হন। এসব বিষয়ে কথা বলতে তাকে ফোন করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

 

১নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আফসার উদ্দিন খানের বিরুদ্ধে রাজউকের ও ব্যক্তি মালিকানাধীন প্লটে মার্কেট বানানো, দখলবাজি, ফুটপাত ও পরিবহন চাঁদাবাজিসহ জুয়া ও ক্যাসিনো কারবার থেকে প্রতিমাসে মোটা অঙ্কের টাকা তোলার অভিযোগ রয়েছে। আফসারের বিপুল সম্পদের মধ্যে রয়েছে, আব্দুল্লাহপুরে খন্দকার সিএনজি স্টেশনটি ১০ কোটি টাকায় ক্রয়, উত্তরায় ১০ কাঠার ওপরের ১২ তলা খান টাওয়ার, আশুলিয়ায় একই সঙ্গে প্রায় ৫০ বিঘা জমি, আশুলিয়া ও রপ্তানি রোডে একটি পেট্রল পাম্প। এসব অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে কাজ করছেন গোয়েন্দারা।

 

৪৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শফিকুল ইসলাম শফিক উত্তরাতে গোল্ডেন শফি নামে সবার কাছে পরিচিত। তিনি উত্তরখান থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। তিনি ১১নং সেক্টরে বিলাসবহুল ও অভিজাত জমজম টাওয়ারের মালিক। ৪৯নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আনিসুর রহমান নাঈমের বিরুদ্ধেও মসজিদ কমপ্লেক্স, ফুটপাত, রাস্তা, সাইনবোর্ড, খাসজমি ও সাধারণ মানুষের জমি দখলসহ রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। রাজধানীর বিমানবন্দর, কাওলা, শিয়ালডাঙ্গা ও গাওয়াইরসহ আশপাশের এলাকায় দখল ও চাঁদাবাজির জন্য রয়েছে নাঈমের নিজস্ব বাহিনী।

 

উত্তর সিটির ৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর কাজী জহিরুল ইসলাম মানিক ধর্ষণের অভিযোগসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত। এলাকায় মার্কেট করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগ নিয়ে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা হবে বলে জানান আইনশৃঙ্খলাবাহিনী।

 

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, নানা অপরাধে যুক্ত এসব কাউন্সিলরের পাশাপাশি অন্যদেরও তথ্য সংগ্রহ চলছে। মূলত তাদের কর্মকান্ড পরিচালনা করে শিগগিরই প্রতিবেদন আকারে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে দেয়া হবে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version