-->

কক্সবাজারে ফের সক্রিয় মানবপাচার চক্র, নিখোঁজ দুই শতাধিক

এইচ এম ফরিদুল আলম শাহীন, কক্সবাজার থেকে
কক্সবাজারে ফের সক্রিয় মানবপাচার চক্র, নিখোঁজ দুই শতাধিক
ফাইল ফটো

এইচ এম ফরিদুল আলম শাহীন, কক্সবাজার থেকে: কক্সবাজারে মানবপাচার চক্র ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে। পাচার করা হচ্ছে পুরুষের পাশাপাশি নারী ও শিশুদেরও। দুই শতাধিক মানুষ এখনো নিখোঁজ রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের টার্গেট করে মাঠে সক্রিয় এখন বেশ কয়েকটি চক্র।

 

জানা যায়, আকাশপথ পাচারের নিরাপদ রুট হলেও শীত মৌসুমে চক্রের প্রধান টার্গেট সাগরপথ। যদিও বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিতে গিয়ে প্রতিবছর প্রাণ হারায় বহু মানুষ। কিন্তু এসব ঘটনায় যে হারে মামলা হয় সেই হারে নিষ্পত্তি ও বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার কারণে প্রকৃত ঘটনা যেমন ধামাচাপা পড়ছে তেমনি আসামিরা নানাভাবে মামলা থেকে পার পেয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন এসব মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা। ফলে শাস্তির আওতায় আসছে খুবই কম অপরাধী।

 

সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকাগুলোতে সাগর পথ দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আদম পাচার কাজে জড়িত রয়েছে রোহিঙ্গাসহ দুই শতাধিক স্থানীয় ও বহিরাগত দালাল। উপকূলীয় এলাকায় নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের চোখ ফাঁকি দিয়ে দালালরা দেশের বিভিন্ন এলাকার সহজ সরল লোকজনদের মালয়েশিয়ায় সোনার হরিণ ধরার প্রলোভন দেখিয়ে উপকূলে জড়ো করে মানবপাচার অব্যাহত রেখেছে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন মাঝে মধ্যে অভিযান চালিয়ে কিছু কিছু মালয়েশিয়াগামীকে আটক করলেও রহস্যজনক কারণে মূল হোতারা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। এ ছাড়া পুলিশের হাতে আটক হওয়া মালয়েশিয়াগামী যাত্রীদের বিরুদ্ধে মামলা না করে ছেড়ে দেয়ায় এবং চিহ্নিত দালালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় মানবপাচার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

 

অনুসন্ধানে জানা যায়, গেল ১ বছরে দালাল চক্রের সদস্যরা উখিয়া, টেকনাফ, মহেশখালী, কুতুবদিয়াসহ কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে ১৫ হাজার মানুষকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মালয়েশিয়া পাচার করেছে। তৎমধ্যে ২ শতাধিক মানুষ এখনো নিখোঁজ রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বৈধভাবে একজন মানুষ মালয়েশিয়া গমন করতে কমপক্ষে ৩ লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়। কিন্তু দালালের মাধ্যমে অবৈধভাবে সাগর পথে অল্প টাকায় মালয়েশিয়ায় যাওয়ার কথা বললেও যাত্রীরা মালয়েশিয়া পৌঁছলে তাদের বন্দিশালায় আটকে রেখে স্বজনদের কাছ থেকে দালালরা আদায় করছে লাখ লাখ টাকা। এসব উপকূলীয় এলাকায় সমুদ্রসৈকত সরাসরি বঙ্গোপসাগরের সাথে সংযুক্ত থাকায় মালয়েশিয়া মানবপাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করছে পাচারকারীরা। বিশেষ করে উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পভিত্তিক একাধিক দালাল চক্র মালয়েশিয়া মানবপাচারের সঙ্গে সরাসরি জড়িত রয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কক্সবাজারে বর্তমানে স্থানীয় বাসিন্দারা সাগরপথে ঝুঁকি নিয়ে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার প্রবণতা কমলেও দেশের অন্যান্য জেলা ও রোহিঙ্গা দালালের হাত ধরে মালয়েশিয়া যেতে মরিয়া। গত কয়েক মাসের মধ্যে সাগরপথে ট্রলারে চেপে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় এ পর্যন্ত কয়েক হাজার রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের উদ্ধার করেছে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে তথ্য নিয়ে জানা যায়, সাগরপথে মালয়েশিয়াগামী রোহিঙ্গাদের মধ্যে সুন্দরী নারীর সংখ্যা বেশি। মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত রোহিঙ্গা যুবকদের সঙ্গে বিয়ে দিতে দালালরা সুন্দরী নারীদের টার্গেট করে বিভিন্ন প্রলোভনের মাধ্যমে সে দেশে পাচার করছে। এ ছাড়া অনেক বিবাহিত নারীও তাদের শিশুসন্তানসহ সেখানে স্বামীর কাছে যাওয়ার জন্য দালালদের কাছে ধরনা দিচ্ছে।

 

এদিকে গত মাসের শুরুর দিকে স্থানীয় মহেশখালী থেকে মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা বলে ১০ কিশোর ও যুবককে নিয়ে যায় মানবপাচারকারী চক্র। যাত্রাপথে মিয়ানমারের জলসীমায় ঢুকে পড়লে সে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের ধরে নিয়ে গেছে বলে বিভিন্ন সূত্রে তাদের পরিবারের সদস্যরা নিশ্চিত হয়েছেন। বর্তমানে তারা মংড়ুর কারাগারে আটক রয়েছেন। ইতোমধ্যে তাদের ফিরিয়ে আনতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে স্থানীয় সংসদ সদস্যের দ্বারস্থ হয়েছেন তারা।

 

তাদের আত্মীয় ছৈয়দ কবির বলেন, বেশি আয়ের লোভ দেখিয়ে মালয়েশিয়ায় চাকরি দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে আমাদের এলাকার ১০ যুবক ও কিশোরকে নিয়ে যায় দালাল চক্র। পাচার করতে গিয়ে মিয়ানমারের সীমানা থেকে সে দেশের জলসীমা থেকে নৌপুলিশ তাদের নিয়ে গেছে। নিয়ে যাওয়ার বহুদিন পর্যন্ত ১০ জনের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। কিছুদিন আগে টেকনাফের কিছু জেলের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছেন ওই ১০ জন মিয়ানমারে আটক আছেন।

 

উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গা নারী সানজিদা বেগম বলেন, মালয়েশিয়ায় আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। দুই পরিবার মিলে আমাকে স্বামীর কাছে পাঠানোর জন্য ট্রলারে তুলে দিয়েছে। আমাকে বলা হয়েছিল জাহাজে করে নেয়া হবে, কিন্তু এখানে এসে দেখি ঝুঁকিপূর্ণ কাঠের ট্রলারে করে পাঠানো হচ্ছে।

 

উখিয়ার তাজনিমার খোলা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা আবদুল নবী বলেন, আগে স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় অনেক রোহিঙ্গা পাসপোর্ট তৈরি করে বাংলাদেশি সেজে আকাশপথে মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি রোহিঙ্গারা যেন কোনো পাসপোর্ট করতে না পারে সে বিষয়ে সরকারের কঠোর নজরদারি রয়েছে। ফলে অবৈধভাবে সাগরপথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মালয়েশিয়া যেতে রাজি হচ্ছে তারা। তিনি আরো বলেন, প্রতিটি ক্যাম্পে মালয়েশিয়া পাচারকারী দালাল চক্রের সদস্যরা ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে। দালালরা প্রথমে কম টাকার বিনিময়ে মালয়েশিয়া পৌঁছে দেয়ার কথা বললেও পরে মাঝপথে গিয়ে স্বজনদের কাছে পৌঁছানোর আগে হাতিয়ে নেয় মোটা অংকের টাকা। এই টাকা দিতে ব্যর্থ হলে দালালরা বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের পথ বেছে নেয়।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে দেশের সাত বিভাগে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা থাকলেও তা কার্যকর না হওয়ায় এসব চক্রকে নির্মূল করা কঠিন হয়ে পড়ছে।

 

এদিকে টেকনাফ মডেল থানা সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক দালালের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় ১২৫টি মামলা হয়েছে। চলতি বছরের ১০ মাসে শুধু টেকনাফ উপকূল থেকেই ২৮ দালালকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

 

টেকনাফ থানার ওসি আবদুল হালিম বলেন, চলতি মাসে ও ৪ জন মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যকে আটক করা হয়েছে। এর আগে মালয়েশিয়াগামী বোটডুবির ঘটনায় ২৪ জনকে এজাহারনামীয় একটি মামলা রুজু ও ছয় দালালকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। জড়িত অন্যদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

 

সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট কামরুল হাসান বলেন, মামলার নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা, অর্থ ব্যয় এবং পাচারকারী সিন্ডিকেট অনেক সংঘবদ্ধ হওয়ায় ভুক্তভোগীরা শেষ পর্যন্ত মামলা চালাতে পারেন না। যার কারণে একটা সময় তারা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন।

 

এ বিষয়ে মানব পাচার নিয়ে কাজ করা এক এনজিও কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মানব পাচার আইনে তদন্ত, শাস্তিসহ বেশ কিছু বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও সাত বিভাগে সাতটি ট্রাইবুন্যাল গঠনের কথা ছিল। কিন্তু এত বছরে কোথাও ট্রাইব্যুনাল গঠিত না হওয়া দুঃখজনক। তিনি বলেন, যেসব জেলায় মামলা জট বেশি সেখানে দ্রুততর সময়ে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে পাচার মামলার বিচার শুরু করলে এ সংকট থেকে মুক্তি সম্ভব হবে। অন্যথায় অপরাধীরা আরো সুযোগ পাবে এবং বেপরোয়া হয়ে উঠবে।

 

এই বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, মানবপাচার ও ইয়াবা পাচার চক্রের বিরুদ্ধে নিয়মিত নজরদারি রাখা হয়। এ ছাড়া সুনির্দিষ্টভাবে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেবে পুলিশ। বিশেষ করে, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, কক্সবাজার সদর, উখিয়া ও টেকনাফের সম্ভাব্য মানব পাচার স্পটগুলোতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব ও কোস্টগার্ড সক্রিয় রয়েছে মানবপাচার ঠেকাতে।

 

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্ব পালনকারী (১৪) আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক সৈয়দ হারুনর রশীদ জানান, ক্যাম্পে মাঝেমধ্যে মানবপাচারকারী চক্র সক্রিয় হয়ে ওঠে। যখনই পাচারচক্রকে শনাক্ত করতে সক্ষম হই তখনই তাদের ধরে থানায় সোপর্দ করি। নেয়া হয় আইনানুগ ব্যবস্থা।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version