-->

কাপ্তাই হ্রদে নাব্যতা সংকট চরমে

অধ্যক্ষ মুকতাদের আজাদ খান, চট্টগ্রাম
কাপ্তাই হ্রদে নাব্যতা সংকট চরমে
ক্যাপশন: প্রকৃতির অপরূপ লীলা বৈচিত্রের কাপ্তাই হ্রদ

নাব্যতা হারাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম কাপ্তাই হ্রদ। গ্রীষ্মের শুরুতে হ্রদের পানি কমে জেগে উঠছে চর। ফলে নৌচলাচল বিঘ্ন হচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে কার্প জাতীয় মাছের প্রজনন ক্ষেত্রগুলো। পাশাপাশি প্রভাব পড়ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন, জেলেসহ হ্রদকে কেন্দ্র করে নানান পেশায় যুক্ত থাকা মানুষের জীবিকায়।

 

জানা গেছে, ৭২৫ বর্গকিলোমিটারের এই কাপ্তাই হ্রদ খনন-সংস্কার হয়নি একবারও। যার কারণে পাহাড়ি ছড়ার পানির ঢলে আসা পলি মাটিতে ভরাটের পথে। নির্বিচারে গাছ কাটার ফলে পাহাড় ধসের মাটিও পড়ছে এ হ্রদে। ৬৩ বছর ধরে মানুষের ফেলা বর্জ্যে তলদেশ ভরাট হয়ে চর জেগে উঠছে কাপ্তাই হ্রদের কিছু কিছু জায়গায়। এতে শুষ্ক মৌসুমে (গ্রীষ্মের শুরু থেকে) সংকুচিত হয়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে নৌচলাচল। ফলে স্থানীয় পণ্য বাজারজাতকরণে বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। এমনকি উৎপাদিত ফসল নষ্ট হচ্ছে, আশানরূপ দাম পাচ্ছেন না কৃষকরা।

 

রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, জুরাছড়ি, বরকল, লংগদু ও বিলাইছড়ি উপজেলার প্রায় ৩ লাখ মানুষের জেলা শহরের সাথে যোগাযোগের একমাত্র পথ কাপ্তাই হ্রদ। আবার হ্রদের মাছের উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে প্রায় ২৫ হাজার জেলে পরিবার। উপজেলাগুলোতে উৎপাদিত কয়েক হাজার হেক্টর জমির ফসলের বাজারজাতকরণও হয় কাপ্তাই হ্রদের নৌ-পথ ধরে। নাব্যতা কমে যাওয়ায় চরম দুর্ভোগে এই ৫ উপজেলার মানুষ।

 

কাপ্তাই হ্রদের নাব্যতা কমার কারণে কার্প জাতীয় মাছ রুই, কাতলা, মৃগেল, বাঁচা, পাবদা, চিতল, দেশী মাগুর, বাতাসী, ট্যাংরা, বাটা মাছ কমে যাচ্ছে। রাঙামাটিতে মৎস্য নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, জেলা মৎস্য অফিস। এসব প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, কার্প জাতীয় মাছ পানির স্রোত থাকা অংশে প্রজনন করে। কিন্তু কাপ্তাই হ্রদের নাব্যতা কমে যাওয়ার কারণে কার্প জাতীয় মাছের প্রজননের স্রোতের জায়গায়গুলো নষ্ট হয়ে গেছে। এতে কার্প জাতীয় মাছের উৎপাদন দিনদিন কমছে। আর বর্তমান সময়ে দেখা যাচ্ছে অতীতের চেয়ে অল্পসময়ে কাপ্তাই হ্রদের পানি শুকিয়ে হ্রদের তলদেশ ভেসে উঠছে। যার কারণে ছোট মাছের প্রজ্জনন কেন্দ্রগুলোও হুমকি মুখে। মাছের প্রজননের জন্য নির্দিষ্ট তিনমাস মাছ ধরা বন্ধ থাকে। পানির কমে যাওয়ার কারণ কখনো কখনো নির্দিষ্ট সময়ের আগেই মাছ ধরা বন্ধ করতে হয়। আবার কখনো নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলেও মাছ আহরণ করা যায়না। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা।

 

বিদ্যুৎ উৎপাদন ঘিরে কাপ্তাই হ্রদের জন্ম। গ্রীষ্ম মৌসুমে পানির অভাবে বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনেও। ২০২৩ সালে দৈনিক ২৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে থেকে গ্রীষ্মের শেষের দিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় মাত্র ২০-২৫ মেগাওয়াট।

 

কাপ্তাই হ্রদের নাব্যতা কমে গ্রীষ্মের সময়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে ৬ উপজেলা। বন্ধ হয়ে যায় লঞ্চ চলাচল। এতে এসব উপজেলায় লঞ্চ চলাচলের উপর নির্ভর করা কয়েকশত মানুষের আয়ে ভাটা পড়ে।

 

সড়ক পথে গ্রীষ্মকালীন ফল সবজিসহ অন্যান্য উৎপাদিত পণ্য পরিবহনে একদিকে যেমন দুর্ভোগ, অন্যদিকে বাড়তি পরিবহন খরচ। যার কারণে পণ্যের দামও বেড়ে যায়। ফলে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়কে ভুগতে হয়। কৃষক প্রিয় তঞ্চঙ্গার তার উৎপাদিত ফল বিক্রি করেন বাগান হিসেবে। অন্যান্যবার লাভের মুখ দেখলেও গেল বছর আম ও লিচুতে বেশ বড় রকমের ধাক্কা খেয়েছেন তিনি। প্রিয় তঞ্চঙ্গা বলেন, পানি শুকিয়ে যাওয়ার কারণে খরচের সাথে পুষিয়ে উঠতে না পারায় কোনো পাইকার ব্যবসায়ী বাগান কিনতে আসেনা। ফলে অনেক ফল বাগানেই নষ্ট হয়। আগে বেপারিদের কাছে আমি বাগান বিক্রি করতাম। কিন্তু গতবছর পানি বেশি শুকিয়ে গিয়েছিল। এই বছরও পানি যেভাবে কমছে মনে হচ্ছে বেপারি পাব না। কাপ্তাই হ্রদ খনন বেশি প্রয়োজন।

 

রাঙামাটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, রাঙামাটিতে সহজে কৃষিজ পণ্য পরিবহনের অন্যতম নৌপথ। কিন্তু গ্রীষ্মকালে কাপ্তাই হ্রদের পানি শুকিয়ে যাওয়ার কারণে নৌপথে থাকা উপজেলাগুলোতে উৎপাদিত কয়েক হাজার হেক্টর জমির সবজি ও ফল নিয়ে কৃষকরা বিপাকে পড়েন। কাপ্তাই হ্রদ যথাযথ খননের মাধ্যমে গ্রীষ্মেও হ্রদে পানি রাখা গেলে কৃষকরা উপকৃত হবে।

 

রাঙামাটি জেলা মৎস্য কর্মকর্তা অধীর চন্দ্র দাস বলেন, রাঙামাটি মৎস্য উৎপাদন ও গবেষণা নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আমরা যে তথ্য পেয়েছি। সে তথ্যের উপর ভিত্তি করে আমরা বলতে পারি, কাপ্তাই হ্রদের নাব্যতা কমার কারণে কার্প জাতীয় মাছের প্রজনন কেন্দ্রগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যদি কার্প জাতীয় মাছের প্রজনন বাড়াতে হয় তাহলে কাপ্তাই হ্রদ খনন জরুরি। অন্তত মূল পয়েন্টগুলো। আবার হ্রদ খনন করে মাটিগুলো পাশে রেখে দিলে হবে না। তা সেখান থেকে সরিয়ে আনতে হবে।

 

রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান বলেন, কাপ্তাই হ্রদের নাব্যতা কমে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নসহ নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে প্রায় ৫ অঞ্চলের মানুষ। হ্রদ খননের জন্য পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি লিখেছি। এখন পর্যন্ত মন্ত্রণালয় থেকে কোন বার্তা পাইনি। আশা করছি তারা হ্রদ খননের ব্যবস্থা নিবে।

 

ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version