-->

কালের সাক্ষী ‘মাচাইন শাহী মসজিদ’

বাবুল আহমেদ, মানিকগঞ্জ
কালের সাক্ষী ‘মাচাইন শাহী মসজিদ’
মাচাইন শাহী মসজিদ

মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার মাচাইন গ্রামে রয়েছে ৬০০ বছর পুরোনো মাচাইন শাহী মসজিদ। জেলা সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে মসজিদটির অবস্থান। চুন, সুরকি ও সাদা সিমেন্টে নির্মিত এই মসজিদ কালের সাক্ষী হয়ে টিকে রয়েছে এখনো। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের অভাবে দিন দিন মলিন হয়ে যাচ্ছে এই স্থাপনাটি।

 

জানা গেছে, বাংলার স্বাধীন সুলতানী শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ত্রিগম্বুজ বিশিষ্ট ও আকর্ষণীয় শিল্পমন্ডিত মাচাইন শাহী মসজিদ। শিলালিপি অনুযায়ী মসজিদটি ১৫০১ খ্রিস্টাব্দের শেষভাগে হোসেন শাহ কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল।

 

মসজিদটির মূল অংশের ওপর রয়েছে তিনটি গম্বুজ। উত্তর ও দক্ষিণ পাশের গম্বুজের চেয়ে মাঝের গম্বুজটি একটু বড়। মসজিদটির মূল অংশের ওপর রয়েছে নিখুঁত খাঁজকাটা কারুকাজ। প্রতিটি দেয়ালেও রয়েছে প্রচুর কারুকাজ, যা যে কারোরই দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

 

মসজিদ নির্মাণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসহজরত শাহ জালাল (রহ.) নেতৃত্বে ৩৬০ আওলীয়া ইসলাম প্রচারে আসেন এই বাংলায়। তাদের মধ্যে ছিলেন হজরত শাহ্ রুস্তম বোগদাদী (রহ.)। শাহ রুস্তম মাচাইনে আসেন যখন ওই সময়টাতে তিস্তার স্রোত ধারা অবলম্বন করে প্রাচীন ভুবনেশ্বর নদী প্রবহমান ছিল। বর্তমানে মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলার ইছামতি নদীর তীরে এই মাচাই গ্রামটি অবস্থিত। চারদিকে যখন পানি আর পানি তখন শাহ রুস্তম (রহ.) বাঁশের একটি মাচা তৈরি করে সেই মাচায় বসে আধ্যাত্মিক চিন্তা করতেন।

 

একদিন মাঝ নদীতে ইবাদত করতে দেখে তৎকালীন স্বাধীন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ তার নৌকার মাঝি-মাল্লাদের যাত্রা বিরতির নির্দেশ দেন। পরে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ শাহ রুস্তম (রহ.) এর সঙ্গে দেখা করেন এবং তার এই ইসলাম প্রচার কাজ দেখে খুবই আনন্দিত হন। সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ইসলাম প্রচারের জন্য এই অঞ্চলে ১৫০১ খ্রিস্টাব্দে হজরত শাহ রুস্তম (রহ.) নামের তিন গম্বুজ বিশিষ্ট নান্দনিক শিল্পমন্ডিত একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এই মসজিদ ও শাহ রুস্তম (রহ.) মাজারটি মানিকগঞ্জের ঐতিহ্যের প্রতীক ও মুসলিম পুরাকীর্তির দুটি বিশেষ নজির হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। মাজার ও মসজিদটি এলাকার মুসলিম মানুষের কাছে পবিত্র জিয়ারত ও শ্রদ্ধার জায়গা।

 

শাহী মসজিদের নিখুঁত শৈল্পিক কারুকাজ

মাচাইন গ্রামের আঞ্চলিক রাস্তা ঘেঁষেই মসজিদটি কালের ও ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মসজিদটি তিন গম্বুজ বিশিষ্ট, মসজিদের প্রবেশ দ্বার হচ্ছে পূর্ব দিকে আর মিনার পশ্চিমে। মসজিদের উপরের তিনটি গম্বুজের উত্তর ও দক্ষিণের দুটির আকার মাঝের চেয়ে একটু ছোট। প্রতিটি গম্বুজের নিচের অংশে রয়েছে নিখুঁত খাঁজকাটা কারুকাজ। চারপাশের সব কয়টি দেয়ালে শৈল্পিক কারুকাজ রয়েছে চুন, সুরকি ও সাদা সিমেন্টের। চোখ জোড়ানো শৈল্পিক স্থাপনাটি সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ অভাবে দিনকে দিন মলিন হয়ে যাচ্ছে।

 

মসজিদকে কেন্দ্র করে বসতি স্থাপন

শাহ রুস্তম (রহ.) যখন এই মাচাইন আসেন তখন এই জনপথটি ছিল পশ্চিম বাংলা ও পশ্চিম ভারতীয় রাজধানীগুলোর মধ্যে জলপথে যাতায়াতের গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ অঞ্চল। এই জলপথটি উভয় অঞ্চলের প্রাচীন জনপদ আর এই জল পথের ওপর বাঁশের মাচানে বসে ইবাদত করতেন শাহ রুস্তম (রহ.)। মাচানে বসে ইবাদত করায় পরবর্তীতে এই গ্রামের নাম মাচাইন রাখা হয়। এ অঞ্চলে শাহ রুস্তম (রহ.) ইসলাম ধর্ম প্রচার এবং খানকা প্রতিষ্ঠা করেন। অলৌকিক গুণের অধিকারী শাহ রুস্তমের (রহ.) কাছে পরে স্থানীয় লোকজন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে এ অঞ্চলে ঘড়বাড়ি স্থাপন করতে শুরু করেন ভক্তরা।

 

মাচাইন এলাকার বাসিন্দা কাজী আকিল উদ্দিন বলেন, এই শাহী মসজিদটি প্রায় ৬০০ বছর আগের। বাগদাদ থেকে ৩৬০ আউলিয়ার একটি দল ইসলাম প্রচার করার জন্য আমাদের দেশে আসেন হজরত শাহ জালাল (রহ.) নেতৃত্বে। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হজরত শাহ রুস্তম (রহ.)। তিনি আসেন এই মাচাইন অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করতে। আমি আমার পূর্ব পুরুষের কাছ থেকে জানতে পেরেছি, তার অলৌকিক গুণে মুদ্ধ হয়ে মানুষ ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করেন। এই মাচাইনে তার নামানুসারে সুলতান হোসেন শাহ একটি মসজিদ স্থাপন করেন এবং মসজিদকে কেন্দ্র করে মানুষের বসতি গড়ে ওঠে পরে।

 

শাহী মসজিদের ইমাম হাফেজ মো. মিজানুর রহমান বলেন, আমি ১৮ বছর ধরে এই মসজিদে ইমামতি করছি। আল্লাহর কাছে লাখ কোটি শুকরিয়া তিনি আমাকে এই মসজিদের ইমাম হবার সুযোগ দিয়েছেন। অনেক দূর-দূরান্তের মুসল্লিরাও এ মসজিদে নামাজ আদায় করতে আসেন। মাচাইন শাহী মসজিদ কমিটির সহসভাপতি মো. বাবুল হোসেন চৌধুরী বলেন, মসজিদ ও মাজারটি মানিকগঞ্জ জেলার কালের সাক্ষী হয়ে আছে। এ ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে আরো পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। মানিকগঞ্জ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক হারেজ সিনহা বলেন, আমাদের এই জেলায় প্রায় ২ হাজার ৪০০’র বেশি মসজিদ রয়েছে। তবে মাচাইন মসজিদটি দেখতে বিভিন্ন জেলা থেকে লোক আসেন। মসজিদটিতে নিয়মিত নামাজ আদায়ের সব ব্যবস্থা রয়েছে।

 

কীভাবে যাবেন

মানিকগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে হরিরামপুর উপজেলোর মাচাইন গ্রামে অবস্থিত মাচাইন শাহী মসজিদ। জেলা শহর থেকে রওনা হয়ে বেওথা ব্রিজের ওপর দিয়ে হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা ঐতিহ্যবাহী হাট হয়ে পোদ্দার বাড়ির মোড় হয়ে যাওয়া যায় মাচাইনে। এ ছাড়াও ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক হয়ে মহাদেবপুর বাস্টস্যান্ড এলাকা হয়েও যাওয়া যায় এই মসজিদে। তবে প্রথম রাস্তাটি সহজ হওয়ায় এই রাস্তাটি ব্যবহার করে অনেকেই এই ঐতিহ্যবাহী শাহী মসজিদটি দেখতে যান।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version