-->
টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসন

আওয়ামী লীগের গৃহবিবাদের সুযোগ নিতে চায় বিএনপি

আ. রশিদ তালুকদার, টাঙ্গাইল
আওয়ামী লীগের গৃহবিবাদের সুযোগ নিতে চায় বিএনপি
টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীরা

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আমেজে মেতে উঠেছে টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) সংসদীয় আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীরা। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও অন্যান্য দলের প্রার্থীরা বিভিন্ন কৌশলে আগাম নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন। সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, সেবামূলক বিভিন্ন কর্মকান্ডসহ দোয়া মাহফিল এবং ব্যানার-ফেস্টুন ও পোস্টারের মাধ্যমে প্রার্থিতা জানান দিচ্ছেন।

 

টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনটি ২০০৮ সাল পর্যন্ত বিএনপির আসন হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৯৮৮ সালের সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী সাইদুর রহমান খান মোহন এ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টানা চারবার বিএনপি মনোনীত প্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমান খান আজাদ নির্বাচিত হন।

 

নির্বাচিত হয়ে সরকারের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়ে তিনি ঘাটাইল উপজেলার ব্যাপক উন্নয়নের প্রয়াস পান। ২০০৮ সালের নির্বাচনে দীর্ঘদিন দখলে থাকা আসনটি বিএনপির হাতছাড়া হয়। দীর্ঘ ২১ বছর পর এ আসনটি দখলে আসে আওয়ামী লীগের। বিশিষ্ট চিকিৎসক ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মতিউর রহমান আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে প্রথমবার নির্বাচনে অংশ নিয়েই এমপি নির্বাচিত হন।

 

তার নিকটতম বিএনপি মনোনীত প্রার্থী সাবেক প্রতিমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমান খান আজাদকে পরাজিত করেন তিনি। ডা. মতিউর রহমান ২০১২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর মারা যাওয়ায় টাঙ্গাইল-৩ আসনটি শূন্য হয়। ওই বছরের ১৮ নভেম্বর শূন্য আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

 

নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পান উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা শহিদুল ইসলাম লেবু। কিন্তু তার মনোনয়নকে প্রত্যাখ্যান করে নাগরিক কমিটির ব্যানারে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করেন তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক আমানুর রহমান খান রানা।

 

বিএনপি ওই উপনির্বাচন বয়কট করে। বিএনপি বিহীন নির্বাচনে আমানুর রহমান খান রানা নৌকার প্রার্থী শহিদুল ইসলাম লেবুকে সহজেই পরাজিত করেন। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমানুর রহমান খান রানা দলীয় মনোনয়নে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে পুলিশি তদন্তে বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমদ হত্যা মামলায় আমানুর রহমান খান রানা ও তার ভাইদের জড়িত থাকার বিষয়টি বেরিয়ে আসে।

 

পরে তারা আত্মগোপনে চলে যান। এ সময় ঘাটাইল আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব আমানুর রহমান খানের বিরোধীদের হাতে চলে যায়। পরে আমানুর রহমান খান আদালতে আত্মসমর্পণ করে তিন বছরের অধিক সময় হাজতে থাকার পর জামিনে মুক্ত হন।

 

জেলা আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমদ হত্যা মামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তাকে মনোনয়ন দেয়নি। আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেয় তার বাবা সোনালী ব্যাংকের সাবেক উপমহাব্যবস্থাপক আতাউর রহমান খানকে। আতাউর রহমান খান এখন এ আসনের সংসদ সদস্য।

 

গত বছরের ৬ জুন কেন্দ্রীয় ও জেলা নেতাদের উপস্থিতিতে ঘাটাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে ঘাটাইল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম লেবু সভাপতি ও আব্দুর রহিম সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন। তারা দুজনই খান পরিবারবিরোধী অংশের নেতা। গত ২৮ জানুয়ারি ঘাটাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়।

 

এতে খান পরিবার সমর্থিত অনুসারীদের বেশির ভাগ বাদ পড়েন। খান পরিবার অনুসারীরা ওই কমিটি বাতিলের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। পরদিন উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে।

 

এদিকে, বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমদ হত্যা মামলায় চার্জশিটের পর সাক্ষ্য গ্রহণও শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আমানুর রহমান খানের তিন ভাইয়ের মধ্যে টাঙ্গাইল পৌরসভার সাবেক মেয়র সহিদুর রহমান খান মুক্তি এখনো জেলহাজতে। টাঙ্গাইল শহরের ‘খান সাম্রাজ্যের পতন হলেও ঘাটাইলে এখনো তাদের আধিপত্য রয়েছে।

 

ফলে আগামী নির্বাচনে কে পাবেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বর্তমান এমপি আতাউর রহমান খান? সাবেক এমপি আমানুর রহমান খান রানা? উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম লেবু? প্রয়াত ডা. মতিয়ার রহমানের ছেলে ঢাকা ভিক্টোরিয়া হেলথ কেয়ারের চেয়ারম্যান তানভীর রহমান?

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান? না অন্য কেউ তা নিয়ে সাধারণ নেতাকর্মীদের মধ্যে ধুম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে। এসব কারণে দলের মধ্যে বিভেদ আরো বেড়েছে।

 

ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে সাধারণ এবং মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে। দলের ভেতর গড়ে উঠেছে আরেক দল। নেতৃত্বের প্রতিযোগিতার কারণে এ আসনে আওয়ামী লীগের অন্তঃকোন্দল চরম আকার ধারণ করেছে।

 

আওয়ামী লীগের এ কোন্দলের সুযোগ নিতে বিএনপি নেতাকর্মীরা অভ্যন্তরীণ দ্ব›দ্ব ভুলে একক প্রার্থী হিসেবে সাবেক প্রতিমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমান খান আজাদকে বেছে নিয়েছেন। তারা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী হয়ে আসনটি পুনরুদ্ধারে মরিয়া।

 

এ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী অন্যদের মধ্যে রয়েছেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক আইনবিষয়ক সম্পাদক ও পিপিএস আকবর খান, তেজগাঁও কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর অধীর চন্দ্র সরকার, ঘাটাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম আহব্বায়ক মাসুদুর রহমান আজাদ।

 

বিএনপি থেকে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য বাসাইলের বাসিন্দা ওবায়দুল হক নাছির মনোনয়ন চাইতে পারেন। উপজেলা জাতীয় পার্টির (জাপা) সাধারণ সম্পাদক সুজাত আলীর নাম শোনা যাচ্ছে। কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগের উপজেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক আতিকুর রহমান মনোনয়ন চাইবেন।

 

টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা ইতোমধ্যেই নির্বাচনী মাঠে নেমে পড়েছেন। নানা উছিলায় ভোটারদের কাছে টানার চেষ্টা করছেন। অনেকে কৌশলে জনসমর্থন নিজের পক্ষে টানতে অনেকটা সফলও হয়েছেন।

 

ঘাটাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম লেবু জানান, তিনি এ আসনে দলীয় মনোনয়ন চাইবেন। মনোনয়ন পেলে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করে নির্বাচনে অংশ নেবেন। তিনি জানান, ঘাটাইল একটি শান্ত জনপদ, আমানুর রহমান খান হঠাৎ করে এসে ঘাটাইলে সন্ত্রাস ছড়িয়েছে। তবে উপজেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যায় কোথাও এখন দলীয় নেতা-কর্মীরা আমানুর রহমান খানের সঙ্গে নেই।

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান জানান, তিনি ২০০১ সাল থেকে দলের মনোনয়ন চাইছেন। তারও আগে থেকে তিনি ঘাটাইলের গণমানুষের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন। দলীয়ভাবে তিনি দ্বন্দ্ব বা সংঘাতের পথ পরিহার করে জনসাধারণকে দলের সাথে সম্পৃক্ত করতে কাজ করছেন।

 

বর্তমান সংসদ সদস্য আতাউর রহমান খান জানান, সরকারের সব উন্নয়ন কর্মকান্ড তিনি স্বচ্ছতার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করেছেন। তিনি দলমতের ঊর্ধে উঠে ঘাটাইলের এমপি হিসেবে সমহারে উন্নয়ন করেছেন। তিনি মহান সংসদে ঘাটাইলের উন্নয়নে একাধিকবার কথা বলেছেন। তিনি জেলা-উপজেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন।

 

বিগত সময়ের স্বচ্ছতার ভিত্তিতে উন্নয়ন ও কাজের ধারাকে অব্যাহত রাখতে জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবারো তাকেই দলীয় মনোনয়ন দেবেন বলে বিশ্বাস করেন। বিএনপির সাবেক প্রতিমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমান খান আজাদ বলেন, সঠিক নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হলে বিএনপি অবশ্যই নির্বাচনে অংশ নিবে।

 

ঘাটাইলের মানুষ আমাকে বেশি ভালোবাসে। তাই আমি চারবার এ আসনে এমপি নির্বাচিত হয়েছি।

 

জাতীয় সংসদের ১৩২ টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনে দুই লাখ ৭২ হাজার ৫২৯ জন ভোটার রয়েছেন।

 

এর মধ্যে পুরুষ এক লাখ ৩২ হাজার ৫৭৫ জন এবং নারী এক লাখ ৩৯ হাজার ৯৫৪ জন।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version