-->
গণঅভ্যুত্থানে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার প্রথম শহীদ

মহানন্দ সরকারের স্মৃতি রক্ষার্থে স্মৃতিসৌধ নির্মিত

নিত্যানন্দ হালদার, মাদারীপুর
মহানন্দ সরকারের স্মৃতি রক্ষার্থে স্মৃতিসৌধ নির্মিত
মহানন্দ সরকারের স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মিত স্মৃতিসৌধ

নিত্যানন্দ হালদার, মাদারীপুর: ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলায় পুলিশের গুলিতে শহীদ হন মহানন্দ সরকার। তিনি তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। অর্ধ শতাব্দী পর বর্তমান সরকার মহানন্দের মহান আত্মত্যাগের স্মৃতি ধরে রাখতে নির্মাণ করেছে স্মৃতি সৌধ। এতে শহীদ পরিবারসহ এলাকাবাসী উচ্ছ¡সিত। স্মৃতিসৌধ নির্মিত হওয়ায় শহীদ মহানন্দ সম্পর্কে জানার কৌত‚হল জাগছে সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে।

 

জানা যায়, ১৯৬৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মহানন্দ সরকার বৃহওর ফরিদপুর জেলার বর্তমানে গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর উপজেলার জলিরপাড়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে টোল অফিস (পুলিশ ফাঁড়ি) ঘেরাও করার সময় পাকিস্তানি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। তখন তিনি ছিলেন মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার খালিয়া রাজারাম ইনস্টিটিউশনের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। কিশোর এ বীরের গৌরবগাথা স্মৃতি ধরে রাখার জন্য দীর্ঘ ৫৩ বছর পর তার নিজ গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার খালিয়া ইউনিয়নের পলিতা গ্রামে সরকারি অর্থায়ণে নির্মাণ করা হয়েছে মহানন্দ মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ।

 

বর্তমান সরকারের কাছে শহীদ পরিবারের সদস্য ও এলাকাবাসীর দাবি, শহীদ মহানন্দ সরকারকে মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় সম্মান দেয়া হোক। বিগত বছরগুলোতে ১ ফেব্রæয়ারি শহীদ মহানন্দ সরকারের পৈতৃক নিবাস রাজৈর উপজেলার খালিয়া ইউনিয়নের পলিতা গ্রামের বাড়িতে এ উপলক্ষে মহানন্দ সরকারের আত্মীয়স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীদের আর্থিক সহায়তায় কিছু ইট বালু দিয়ে স্মৃতিসৌধ তৈরি করে তাতে ফুল দিয়ে এলাকাবাসী শ্রদ্ধা নিবেদন করতেন। বর্তমান সরকার স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করায় শহীদ পরিবারের সদস্যরা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

 

সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী জলিরপাড় জে.কে.এম.বি মল্লিক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তণ শিক্ষক ও প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা জগদীশ চন্দ্র বিশ্বাস। শহীদ মহানন্দ সরকারের সহপাঠী জগন্নাথ বিশ্ব বিদ্যালয়ের সামাজিকবিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার গোস্বামী জানান, ১৯৬৯ এর গণআন্দোলনের সময় ছাত্র-জনতা জলিরপাড়ে আন্দোলন শুরু করেন। কিন্তু তৎকালীন জলিরপাড় ইউপি চেয়ারম্যান নিত্যরঞ্জণ মজুমদার, প্রভাবশালী মুসলিম লীগ নেতা নওয়াব আলী মিয়া ও মুকুন্দ বালা তাদের আন্দোলন করতে বাধা দেন। এর প্রতিবাদে ১ ফেব্রæয়ারি জলিরপাড় স্কুলের শিক্ষক ও কমিউনিস্ট নেতা সত্যেন্দ্রনাথ বারুরীর নেতৃত্বে ছাত্র সমাজ বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দেয়।

 

এদিন সকাল থেকে মাদারীপুরের খালিয়া, উল্লাবাড়ী, মুকসুদপুরের বেদগ্রাম, ননীক্ষীর, গোহালা, বানিয়ারচর থেকে প্রায় ২ হাজার ছাত্র জনতা জলিরপাড় বাজারে এসে জমায়েত হন। তাদের সঙ্গে ছিলেন খালিয়া রাজারাম ইনস্টিটিউশনের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র মহানন্দ সরকার। দুপুর ১২টার দিকে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা শ্লোগান দিয়ে মিছিল শুরু করলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। ছাত্ররা পুলিশের বাঁধা উপেক্ষা করে মিছিল করতে গেলে পুলিশ টিয়ার গ্যাস ও লাঠিচার্জ করে।

 

এ নিয়ে ছাত্র পুলিশের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, ইট-পাটকেল নিক্ষেপ এবং সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ছাত্ররা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পুলিশ জলিরপাড় টোল অফিসে আশ্রয় নেয়। দুপুরে ছাত্ররা আবার সংগঠিত হয়ে মিছিল বের করে টোল অফিস (পুলিশ ফাড়ি) এর পুলিশের ওপর হামলা চালায়। মহানন্দ সরকার অফিসের জানালা ভেঙে ফেললে পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ শুরু করে। এ সময় মহানন্দ সরকার গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে মৃত্যুবরণ করেন। পুলিশের গুলিতে উড়ে যায় নান্টু সরকারের ডান হাত। সেদিন গুলিবিদ্ধ হন অন্তত ১৫ জন।

 

এ ঘটনার পর এলাকাবাসী ক্ষোভে ফেটে পড়েন। উত্তেজিত জনতা পুলিশের গানবোট পুড়িয়ে দেয় এবং পুলিশের ওপর হামলা চালায়। আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে আনতে গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুর থেকে অতিরিক্ত পুলিশ এসে আ. রাজ্জাক মুন্সি, আ. লতিফ কাজী, মনোহর বৈরাগী ও মিহির বৈরাগীকে গ্রেপ্তার করে। এতে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। পুলিশের গুলিতে নিহত মহানন্দ সরকারের লাশ পোস্টমর্টেমের জন্য গোপালগঞ্জ মর্গে নিয়ে যায় পুলিশ। পোস্ট মর্টেম শেষেও মহানন্দের লাশ তার আত্মীয়স্বজনের কাছে ফেরত দেয়নি পুলিশ।

 

মহানন্দ সরকারের সম্মানে যেমন স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে, তেমনিভাবে তাকে মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভ‚ষিত করা হলে তার আত্মার শান্তির পাশাপাশি বৃহত্তর ফরিদপুরবাসী খুশি হবে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version