-->
ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধিতে

দিগন্ত জোড়া সরিষার মাঠ, স্বপ্ন বুনছে কৃষক

আ. রশিদ তালুকদার, টাঙ্গাইল
দিগন্ত জোড়া সরিষার মাঠ, স্বপ্ন বুনছে কৃষক

আ. রশিদ তালুকদার, টাঙ্গাইল: টাঙ্গাইলের দিগন্ত জোড়া ফসলের মাঠ সরিষার হলুদ ফুলে ছেয়ে গেছে। যতদূর চোখ যায় দু-একটি বাড়ি বাদে হলুদ আর হলুদ এ যেন হলুদের রাজ্য। প্রতিটি সরিষা ক্ষেতে পৌষের কনকনে হিমেল হাওয়ায় দোল খাচ্ছে কৃষকের স্বপ্ন। হলুদের রাজ্যে মৌ মাছির গুন গুন শব্দে মুখরিত ফসলের মাঠ, পেশাদার মধু সংগ্রহকারীরাও ব্যস্ত সময় পার করছেন।

 

ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধির কারণে এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে সরিষার আবাদ করা হয়েছে। বাম্পার ফলনের হাতছানিতে কৃষকের চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে আনন্দের হাসি। সরিষার হলুদ চাদরে মৌ মৌ ঘ্রাণে মুগ্ধ হচ্ছেন প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ। অধিক জমিতে সরিষা আবাদে ভোজ্যতেলে জেলায় অপার সম্ভাবনাও দেখছে কৃষি বিভাগ ও সংশ্লিষ্টরা।

 

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলায় চলতি মৌসুমে ৫২ হাজার ১২০ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৭ হাজার ২৫৮ হেক্টর জমিতে ও প্রণোদনা পেয়েছে ২ হাজার ৫০০ জন কৃষক, বাসাইলে ৬ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে ও প্রণোদনা পেয়েছে ২ হাজার ৬০০ জন, কালিহাতীতে ৪ হাজার ১৪০ হেক্টর জমিতে ও প্রণোদনা পেয়েছে ২ হাজার ৫০০ জন কৃষক, ঘাটাইলে ৩ হাজার ৪৬৬ হেক্টর জমিতে ও প্রণোদনা পেয়েছে ২ হাজার ৪০০জন কৃষক, নাগরপুরে ১১ হাজার ৫৮৬ হেক্টর জমিতে ও প্রণোদনা পেয়েছন ২ হাজার ৫০০ কৃষক।

 

মির্জাপুর উপজেলায় ১১ হাজার ৬১১ হেক্টর জমিতে ও প্রণোদনা পেয়েছেন ২ হাজার ৬০০ জন কৃষক, মধুপুরে ৭১২ হেক্টর জমিতে ও প্রণোদনা পেয়েছেন ২ হাজার ৪০০ জন কৃষক, ভূঞাপুরে ২ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমিতে ও প্রণোদনা পেয়েছেন ২ হাজার ৪০০ জন কৃষক, গোপালপুরে ৪ হাজার ৬১০ হেক্টর জমিতে ও প্রণোদনা পেয়েছেন ২ হাজার ৪০০ জন কৃষক, সখীপুরে ২ হাজার ৪৯০ হেক্টর জমিতে ও প্রণোদনা পেয়েছেন ২ হাজার ৪০০ জন কৃষক, দেলদুয়ারে ৩ হাজার ১৮৭ হেক্টর জমিতে ও প্রণোদনা পেয়েছেন ২ হাজার ৪০০ জন কৃষক এবং ধনবাড়ীতে ৫৬০ হেক্টর জমিতে ও প্রণোদনা পেয়েছেন ২ হাজার ৪০০ জন কৃষক।

 

এদিকে, ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধির কারণে কৃষকরা স্বপ্রণোদিত হয়ে অতিরিক্ত আরো ছয় হাজার হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ করেছে। ফলে জেলায় সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৮ হাজার ১২০ হেক্টর জমি। সরকারিভাবে উপজেলা ও পৌরসভায় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক পর্যায়ের ৩০ হাজার কৃষকের মাঝে বিনামূল্যে সরিষার বীজসহ সার বিতরণ করা হয়েছে। সরিষা চাষে বিভিন্ন ধরনের রোগ-বালাই ও ফসলের প্রাকৃতিক দুর্যোগরোধে মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে সব ধরনের সহযোগিতা করছে কৃষি অধিদপ্তর।

 

কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, এ অঞ্চলের কৃষকরা উচ্চ ফলনশীল ও স্থানীয় উভয় জাতের সরিষা চাষ করেন। দুই জাতের সরিষা নভেম্বরের শুরু থেকে নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত আবাদ করতে হয়। ফসল ঘরে উঠতে সময় লাগে জাত ভেদে ৭০ থেকে ৯০ দিন। বর্তমানে টাঙ্গাইল জেলার বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে এখন সরিষা ফুলের সমারোহ।

 

টাঙ্গাইল সদর, মধুপুর, ধনবাড়ী, গোপালপুর, কালিহাতী, ভ‚ঞাপুর ও গোপালপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আবাদি ও অনাবাদি এবং আনাচে-কানাচের পরিত্যক্ত জমিগুলোকেও সরিষা আবাদের আওতায় আনা হয়েছে। গত বছরের তুলনায় চলতি মৌসুমে প্রায় দ্বিগুণ হারে সরিষা চাষাবাদ করেছে কৃষকরা। এসব জমিতে সরিষায় গাছে ফুল ও ফল এসেছে। হলুদ ফুলের জমির পাশে পেশাদার মৌ চাষিরা মৌমাছির বাক্স বসিয়ে মধু সংগ্রহ করছে। পাশাপাশি প্রকৃতিপ্রেমিরা সরিষা ক্ষেতে ও পাশে নানা ভঙিতে ছবি, সেলফি ও ভিডিও ধারণ করছে।

 

পেশাদার মধু সংগ্রহকারী কালাম, রাজিব, আব্দুল হকসহ অনেকেই জানান, তারা দেশের অন্য এলাকা থেকে এ জেলায় মধু সংগ্রহ করতে এসেছেন। এখানকার কোনো কোনো কৃষক তাদের সহযোগিতা করলেও অধিকাংশ কৃষক ক্ষেতে মৌ-বাক্স বসাতে দেন না। অথচ সরিষা ক্ষেতে মৌমাছির কলরব থাকলে ফলন বেশি হয়। এটা অনেকেই বুঝতে চান না।

 

টাঙ্গাইল পৌর সভার ঘোষপাড়ার আমিনুর রহমান একযুগ ধরে মৌচাষ করেন। তিনি এটাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। তিনি জানান, এ বছর তিনি সরিষা ক্ষেতে শতাধিক মৌ-বাক্স স্থাপন করেছেন। এ পর্যন্ত তিনি (ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি ১ সপ্তাহ) প্রায় এক টন মধু সংগ্রহ করতে পেরেছেন। সরিষা ক্ষেতে বছরে চার মাস মধু আহরণ করা যায়। বছরের অন্য ৬ মাস কৃত্রিম পদ্ধতিতে চিনি খাইয়ে মৌমাছিদের রাখা হয়।

 

টাঙ্গাইল জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (খামার বাড়ি) উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. আহসানুল বাসার জানান, দেশের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহতম জেলা হচ্ছে টাঙ্গাইল। এ জেলায় চলতি মৌসুমে ৫২ হাজার ১২০ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় ও কৃষিমন্ত্রীর আহব্বান ভোজ্যতেলের ঘাটতি মেটাতে শতকরা ১৫ ভাগ সরিষা উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে আরো ছয় হাজার হেক্টর জমিতে অতিরিক্ত সরিষা আবাদ করা হয়েছে।

 

জেলায় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক পর্যায়ে প্রায় ৩০ হাজার কৃষকের মাঝে উচ্চ ফলনশীল জাতের সরিষা বীজ ও সার বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। আবহাওয়া অনুক‚লে থাকলে চলতি মৌসুমে কৃষকরা কাক্সিক্ষত ফলন পাবে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version