-->
১০ বছর পর ঘুম ভাঙল কর্তাদের

হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি হয়েও বহাল তবিয়তে শিক্ষক ফারুক

উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে সখ্যর অভিযোগ

খুলনা ব্যুরো
হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি
হয়েও বহাল তবিয়তে শিক্ষক ফারুক

ফারুক শেখ ওরফে মো. ফারুক ইসলাম। বাড়ি খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার গাজীরহাট ইউনিয়নের পদ্মবিলা গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক শেখের পুত্র। কর্মরত আছেন উপজেলার ১৫ নম্বর হাজীগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পদবি- সহকারী শিক্ষক। সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু ঈদের দিন প্রকাশ্যে ঘটে যাওয়া এলাকার একটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এজাহারভুক্ত আসামি হন শিক্ষক ফারুক। টানা ৩৮ দিন কারাগারেও ছিলেন। বিধি অনুযায়ি তার সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার কথা থাকলেও হতে হয়নি। এমনকি চারবার আদালতে দাখিলকৃত চার্জশিটে নাম থাকলেও পড়তে হয়নি কোনো বিড়ম্বনায়। কারণ : উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজসে পুরো বিষয়টিই ধামাচাপা দিতে সক্ষম হন ফারুক।

 

এদিকে, ধামাচাপা পড়ে যাওয়া বিষয়টি দীর্ঘ ১০ বছর পর ফাঁস হয়েছে। স্কুল পরিচালনা কমিটির একজন সদস্যের অভিযোগের সূত্র ধরে ঘটনার সত্যতা পেয়েছে জেলা শিক্ষা অফিস। তবে, শিক্ষক ফারুক শেখের বিরুদ্ধে মামলা এবং কারাগারে যাওয়াসহ সংশ্লিষ্ট প্রমাণপত্র যাচাই করে দ্রুত তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানিয়েছেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. তৌহিদুল ইসলাম।

 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১২ সালের ২০ আগস্ট ছিল পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন। রমজান মাস শেষে সবাই ঈদের জামাতে শরিক হতে খুশি মনে ঈদগাহের দিকে যাচ্ছিলেন। স্থানীয় পদ্মবিলা গ্রামের ওলিয়ার মুন্সিও (৩০) স্বজনদের সঙ্গে ঈদগাহের দিকে রওনা হন। তিনি স্থানীয় রফিক দারোগার বাড়ির কাছে পৌঁছালে পূর্ব শত্রুতার জেরে প্রতিপক্ষের লোকজন তার ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়। এক পর্যায়ে তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার তিনদিন পর ২৩ আগস্ট নিহতের কন্যা দোলেনা বেগম বাদী হয়ে ২৩জনের নাম উল্লেখ পূর্বক দিঘলিয়া থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন (মামলা নং-৭। ওই মামলায় হাজীগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফারুক শেখ ওরফে মো. ফারুক ইসলামকে ১৩ নম্বর আসামি করা হয়। পরবর্তীতে দিঘলিয়া থানার ওসি (তদন্ত) মো. আলী নওয়াজ, জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পরিদর্শক মো. মামুনুর রশিদ, সিআইডি পরিদর্শক প্রবীর কুমার বিশ^াস এবং সর্বশেষ খুলনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এ-সার্কেল) মোহাম্মদ বদিউজ্জামান তদন্ত পূর্বক ২০১৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। মামলাটি বর্তমানে খুলনার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ দ্বিতীয় আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।

 

এদিকে, আলোচিত এ হত্যা মামলার সব অভিযোগপত্রেই শিক্ষক ফারুকের নাম থাকলেও না জানার ভান করে রহস্যজনক কারণে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শাহনাজ বেগম বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে রাখেন।

 

অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, শিক্ষক ফারুক ইসলাম উল্লিখিত মামলায় ২০১৮ সালে ৩৮ দিন খুলনা জেলা কারাগারে ছিলেন। এর আগে তিনি একই বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি ছয় সপ্তাহের মেডিকেল ছুটি চেয়ে তিনি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে আবেদন করেন। ওই আবেদনের সঙ্গে তৎকালীন খুলনা জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মেডিকেল অফিসার সবুজ সাহা স্বাক্ষরিত মেডিকেল সনদ দাখিল করা হয়। যাতে ফকিরহাটের বেতাগা বাজারের তৈয়েবুর রহমান মার্কেটের ‘হেমা মেডিকেল হল’ নামক একটি ফার্মেসির প্যাড ব্যবহার করা হয়। পরবর্তীতে কারাগার থেকে বের হয়ে তিনি বহাল তবিয়তে শিক্ষকতা করে আসছেন।

 

এদিকে, ঘটনা ফাঁস হওয়ার প্রেক্ষিতে শিক্ষক ফারুকের বিরুদ্ধে অভিযোগের সকল প্রমাণপত্রসহ ৩ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে গত ৬ ডিসেম্বর চিঠি দেন জেলা শিক্ষা অফিস। সে মোতাবেক তাড়াহুড়ো করে শুধুমাত্র মামলার কাগজ পাঠালেও কারাগারে থাকার কাগজ পাঠাননি বলে জানা গেছে।

 

ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে দিঘলিয়া উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শাহনাজ বেগম বলেন, মামলা ও কারাগারে থাকার বিষয়টি অনেক আগের ঘটনা, বিষয়টি আমার জানা ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় জেলা শিক্ষা অফিস থেকে শিক্ষক ফারুক ইসলামের মামলা ও কারাগারে থাকার বিষয়ে তার কাছে কাগজপত্র চাওয়া হয়। মামলার কিছু কাগজপত্র ইতিমধ্যেই জেলা শিক্ষা অফিসে প্রেরণ করা হয়েছে। তবে কারাগারে থাকার কাগজটি দ্রুত প্রেরণ করা হবে।

 

তিনি আরো উল্লেখ করেন, শিক্ষক ফারুক ইসলাম ২০১৮ সালে কারাগারে ছিলেন, কিন্তু তিনি এই তথ্য গোপন করে মেডিকেল সনদ জমা দিয়ে ছুটি গ্রহণ করেন। ফলে বিষয়টি গোপন থেকে যায়। শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির মধ্যে দ্বন্দ্বের জের ধরে এ তথ্য ফাঁস হয়। তবে অভিযুক্ত শিক্ষক ফারুক ইসলামের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক বা তাকে কোনো ধরনের সেল্টার দেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।

 

খুলনা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. তৌহিদুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, বিষয়টি জানার পর শিক্ষক ফারুক ইসলামের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত হত্যা মামলার কপি এবং কারাগারে থাকার প্রমাণপত্র চেয়ে দিঘলিয়া উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে চিঠি দেয়া হয়েছ। সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র পাওয়ার পরই শিক্ষক ফারুক ইসলামকে সামরিক বরখাস্ত করা হবে। একই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হবে। আর হত্যা মামলায় তিনি দুই বছরের অধিক সাজাপ্রাপ্ত হলে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে। তবে তিনি হত্যা মামলা থেকে খালাস পেলে অভিযোগ থেকেও অব্যাহতি পাবেন। তবে তথ্য গোপন করায় তার বিরুদ্ধে অন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version