-->

থামছে না রামগতি-কমলনগরে মেঘনার ভাঙন, আতঙ্কে স্থানীয়রা

লক্ষীপুর প্রতিনিধি
থামছে না রামগতি-কমলনগরে মেঘনার ভাঙন, আতঙ্কে স্থানীয়রা
লক্ষীপুরের রামগতি-কমলনগরে মেঘনার ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। ছবিটি সোমবার তোলা ভোরের আকাশ

লক্ষীপুরের রামগতি-কমলনগরে মেঘনার ভয়াবহ ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। কর্তৃপক্ষ আশ্বাস দিলেও বাস্তবে নদীর তীররক্ষা বাঁধের কাজের কোনো অগ্রগতি নেই। আশ্বাস আর প্রতিশ্রুতিতে বছর পার হয়েছে। চরম আতঙ্কে রয়েছেন স্থানীয়রা।

 

চলতি বছরের জানুয়ারিতে এ কাজের উদ্বোধন করেন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল জাহিদ ফারুক শামিম। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাজের কাজ কিছুই হয়নি। মুহূর্তের মধ্যে ভেঙে তছনছ হচ্ছে বসতবাড়ি, কৃষিজমিসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।

 

মেঘনার ভাঙনে এই দুই উপজেলা ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে। মেঘনার তান্ডব লীলা -জলাবদ্ধতা ও অস্বাভাবিক জোয়ারে বিপর্যস্ত কমলনগর-রামগতি উপজেলার লাখো মানুষ। দীর্ঘ তিন দশক ধরে এমন অবস্থা চলছে নদী পাড়ে বসবাসকারী মানুষগুলোর। ভাঙনের ভয়াবহতায় এখানকার মানুষের দুঃখ-কষ্টের শেষ নেই। সারাবছর ধরে মেঘনা ভাঙছে।

 

লক্ষীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের জুন মাসে একনেক সভায় রামগতি-কমলনগরের মেঘনা নদীর তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের জন্য তিন হাজার ৮৯ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

 

চলতি বছরের জানুয়ারিতে কমলনগরের সাহেবেরহাট ইউনিয়নের মেঘনা নদী এলাকায় বাঁধ নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল জাহিদ ফারুক শামীম। এ সময় উপস্থিত ছিলেন লক্ষীপুরে-৪ (রামগতি-কমলনগর) আসনের সংসদ সদস্য মেজর (অব.) আবদুল মান্নান। বাঁধ নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করা হলেও এখন পর্যন্ত কাজ শুরু হয়নি। তবে ভাঙন কিন্তু থেমে থাকেনি। প্রতিদিনই ভাঙছে মেঘনা নদী। ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে রামগতি-কমলনগর উপজেলার মানচিত্র।

 

 

স্থানীয়রা বলেছেন, সেনাবাহিনীর মাধ্যমে নদীতীর রক্ষা বাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবি থাকলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাজ উদ্বোধন করা হয়। নয়ছয় করার জন্য গত জানুয়ারি মাসে উদ্বোধন করা হয় এই বিশাল প্রকল্পের কাজ। কিন্তু কাজ শুরু হয়নি এখন পর্যন্ত। বালু সংকটসহ নানা অজুহাত দেখিয়ে ঠিকাদাররা কাজ বন্ধ রাখেন। এতে প্রতিনিয়ত ভাঙছে মেঘনা নদীর তীরসহ আশপাশের লোকালয়।

 

জানা গেছে, প্রকল্প বাস্তবায়নে ৩৬টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দিয়েছিল সরকার। বালু সংকট ও বরাদ্দের টাকা ছাড় না পাওয়ায় তারা কাজ বন্ধ রেখেছে। এদিকে ক্ষতির মুখে পড়া এখানকার মানুষ মেঘনার তীররক্ষা বাঁধের নির্মাণকাজ দ্রুত বাস্তবায়নের দাবিতে বিভিন্ন সময় মানববন্ধন করে আসছেন।

 

তারা এই দুই উপজেলা ভাঙনের হাত থেকে রক্ষার দাবি জানান। চলতি মাসে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক নদীভাঙন এলাকা পরিদর্শনে রামগতি ও কমলনগর আসেন।

 

পরিদর্শনে এসে তিনি স্থানীয় জনতাকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, বালু সংকটের কারণে আমরা কাজ শুরু করতে পারিনি। এখন মেঘনা নদীর চরকাঁকড়া এলাকা থেকে বালু টেস্ট চলছে। মানসম্মত বালু পাওয়া গেলে আমরা দ্রুত নদীর বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু করব।

 

এদিকে তীব্র ভাঙনে প্রতিদিনই বিলীন হচ্ছে ঘরবাড়ি, হাট-বাজার, ফসলি জমিসহ সরকারি-বেসরকারি বহু স্থাপনা। ভয়াবহ ভাঙন পরিস্থিতিতে বাড়িঘর সরিয়ে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। মানুষ সব হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে। পাঁচ-সাতবার ভাঙনের শিকার হয়ে এখন অনেকেই পথের ভিখারি। ভাঙনে আতঙ্কিত নদীপাড়ের লাখো মানুষ। ইতোমধ্যে রামগতি উপজেলার দাসপাড়া, রঘুনাথপুর, আসলপাড়া, বাংলাবাজার, সেবাগ্রাম, আলেকজান্ডার ইউনিয়ন ও পশ্চিম বালুরচর এবং কমলনগর উপজেলার সাহেবেরহাট, তালতলী বাজার, লুধুয়া বাজার, কাদিরপÐিতের হাট, মাতাব্বরহাট, মতিরহাট, হাজীগঞ্জ, নবীগঞ্জ, নাছিরগঞ্জ, বাঘারহাটসহ অসংখ্য বাজার, গ্রাম ও সরকারি-বেসরকারি বহু স্থাপনা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।

 

বর্তমানে আরো কয়েকটি স্কুল-মসজিদ-মাদরাসা, হাটবাজার, সরকারি-বেসরকারি কয়েকটি স্থাপনা হুমকির মুখে রয়েছে। জানা গেছে, কাজ পাওয়া ঠিকাদাররা প্রথমে স্থানীয় কিছু দালালের মাধ্যমে জিও ব্যাগ ডাম্পিংয়ের কাজ শুরু করে। তাদের মধ্যে দরদাম ও কমিশনবাণিজ্য নিয়ে ঝামেলা দেখা দেয়। পরে বালু সংকটের অজুহাত দেখিয়ে তারা কাজটি বন্ধ রাখেন। তা এখন পর্যন্ত বন্ধ রয়েছে। এখন আবারো নির্মাণ কাজ শুরু করার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও স্থানীয় সংসদ সদস্য।

 

সাহেবেরহাট এলাকার মাসুম বিল্লাহ ও কালকিনি এলাকার বাসিন্দা শাহ আলম বলেন, তাদের বাড়ি নদী ভাঙনে বিলীন হয়ে গেলে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে বসবাস করেন তারা। নদী ভাঙন অব্যাহত থাকায় তাদের বাড়ি এখন আবারো হুমকির মুখে। নদীর তীর রক্ষা বাঁধ না হলে তাদের বাড়িঘর এবারও বিলীন হওয়ার আশঙ্কা করেন তারা।

 

রামগতির চরগাজী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তাওহিদুল ইসলাম সুমন জানান, মেঘনার ভাঙন রোধে আমরা লক্ষীপুর ও ঢাকায় ব্যাপক আন্দোলন করেছি। দুই উপজেলার সর্বস্তরের মানুষের কথা চিন্তা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেড়িবাঁধ নির্মাণকল্পে একটি বিশাল প্রকল্প অনুমোদন দেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা এই প্রকল্পের কোনো অগ্রগতি দেখছি না। নানা অজুহাত দেখিয়ে বারবার শুধু কাজ পিছিয়ে রেখেছে।

 

কমলনগরের সাহেবেরহাট ইউপি চেয়ারম্যান মাস্টার আবুল খায়ের ও কালকিনি ইউপি চেয়ারম্যান মাস্টার সাইফুল্লাহ বলেন, নদী ভাঙনে তাদের ইউনিয়নের অর্ধেকেরও বেশি জনপদ বিলীন হয়ে গেছে। এখন জোয়ার এলেই ডুবে যায় পুরো এলাকা। বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু না হওয়ায় কঠোর সমালোচনা করেন তারা।

 

লক্ষীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ফারুক আহমেদ বলেন, কাজ পাওয়া ঠিকাদাররা চাঁদপুর থেকে বালু এনে জিও ব্যাগ ডাম্পিংয়ের কাজ করত। কিন্তু সেখানে বালু সংকটের কারণে কাজটি বন্ধ হয়ে যায়। পরে সব ঝামেলা মিটিয়ে আমরা বিশেষ ব্যবস্থায় বালু আনার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এখন পুনরায় কাজ শুরু করা হলো।

 

স্থানীয় সংসদ সদস্য মেজর (অব.) আবদুল মান্নান বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। টেন্ডার দেয়া হয়েছে। এখন ঠিকাদাররা কাজ করবে, তারা কীভাবে করবে সেটা তাদের বিষয়।

 

ভোরের আকাশ/নি

 

মন্তব্য

Beta version