-->

পেরিলা চাষে সফল শাহজাহান

নীলফামারি প্রতিনিধি
পেরিলা চাষে সফল শাহজাহান
নিজ বাগানে পেরিলা চাষি শাহজাহান মিয়া

সারি সারি এক থেকে দেড় ফুট উচ্চতার গাছ। পাতার ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে সাদা রঙের ফুল। দেখে মনে হতে পারে কোনো শাকসবজির ক্ষেত। তবে এটি তেলজাতীয় ফসল পেরিলা, যা তেলবীজ হিসেবে দেশে ভ‚মিকা রাখতে যাচ্ছে। এটি সুপারফুড হিসেবে পরিচিত।

 

নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের মাগুরা মাস্টারপাড়া এলাকায় ৪৫ শতক জমিতে পেরিলা চাষ করেছেন কৃষক শাহজাহান মিয়া। গত মৌসুমে উপজেলা কৃষি অফিসের পরামর্শ নিয়ে ও বীজ সংগ্রহ করে ৩০ শতাংশ জমিতে ভেষজগুণসমৃদ্ধ ফসল পেরিলার পরীক্ষামূলক চাষ ও ঘানিতে তেল উৎপাদন করে সফলতা পেয়েছেন তিনি।

 

প্রথম বছর আশানুরূপ ফলন ও অর্থনৈতিক সাফল্য পাওয়ায় চলতি বছর ৪৫ শতাংশ জমিতে চাষাবাদ করেছেন। নতুন এ ফসলে আগ্রহ দেখাচ্ছেন স্থানীয় কৃষকরাও। তারা স্বপ্ন দেখছেন বাণিজ্যিকভাবে পেরিলা চাষের। কৃষক শাহজাহান মিয়া অপ্রচলিত ফসল চাষে আগ্রহী। তিনি উপজেলায় সমতল জমিতে চা, কফি ও আগর চাষে সফলতা পেয়েছেন। বর্তমানে মেক্সিকোর চিয়া ও কিনোয়া চাষেও সফলতা পেয়েছেন। তাছাড়া বর্তমানে কমোলা, বিষমুক্ত বেগুনসহ অন্যান্য ফসল চাষ করছেন।

 

সরেজমিনে দেখা যায়, সবুজ সমারোহে ভরে উঠেছে ফসলি মাঠ। সবুজের ক্যানভাসে থোকায় থোকায় শস্যদানার শীষ উঁকি দিচ্ছে। শস্যদানাগুলো যেন কৃষককে দিন বদলের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পেরিলা তেল দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, জাপান, থাইল্যান্ড, ভারত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে ব্যবহার হয়।

 

২০২০ সালে শেরে বাংলা কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের অনুক‚লে এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক সাউ পেরিলা-১ (গোল্ডেন পেরিলা বিডি) নামে দেশে প্রথম পেরিলার জাত নিবন্ধিত হয়। এর তেল হৃদযন্ত্র, মস্তিস্ক, ত্বক ও ডায়াবেটিস প্রতিরোধ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও দৃষ্টিশক্তি বাড়ায়। হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ এবং ঝুঁকিও কমায়।

 

২০২০ সালে ১৪ জেলায় পরীক্ষামূলক চাষ হয় পেরিলা। গত বছর প্রথমবারের মতো নীলফামারীসহ দেশের ৫০ জেলায় বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয়। চলতি বছরেও বেশ কিচু জেলায় পেরিলার চাষ হয়েছে। পেরিলার তেল আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি লিটার দুই থেকে আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি হয়। সরিষা ভাঙার মেশিনে তেল উৎপাদন সম্ভব। পানি জমে না এমন উঁচু জমিতে এর ফলন ভালো হয়। পেরিলা চাষে বেলে দোআঁশ ও দোআঁশ মাটি বেশি উপযোগী।

 

উচ্চগুণাগুণ সম্পন্ন এই তেল আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যে প্রতি লিটার ২ হাজার ১০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। তেল ভাঙা সরিষার মিলগুলোতে পেরিলা তেল বের করা যায়। ফসল সংগ্রহ পর্যন্ত আনুমানিক ব্যয় হয় প্রায় পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা। প্রায় দশ লাখ টাকার মতো তেল ফসল পেরিলা বিক্রি করা সম্ভব। খুব কম সময়ের ফসল পেরিলা। তিন থেকে সাড়ে তিন মাসের মধ্যে ফসল সংগ্রহ করা যায়। উচ্চ গুণাগুণসম্পন্ন ও উচ্চ মূল্যের একটি ভোজ্যতেল জাতীয় ফসল পেরিলা।

 

কৃষক শাহজাহান মিয়া বলেন, এমন নানা গুণ সমৃদ্ধ ফসল পেরিলার পরীক্ষামূলক চাষ ও ঘানিতে তেল উৎপাদন করে সফলতা পেয়েছি। গত বছর উপজেলা কৃষি অফিসের পরামর্শ ও বীজ সরবরাহে ৩০ শতাংশ জমিতে কোরিয়ান পেরিলার চাষ করে ৩ হাজার টাকা খরচ করে ১২০ কেজি বীজ পেয়েছি। প্রথম বছরে আশানুরূপ ফলন ও অর্থনৈতিক সাফল্য পাওয়ায় চলতি বছর ৪৫ শতাংশ জমিতে এর চাষাবাদ করেছি।

 

তিনি আরো বলেন, এই ফসল ঝুঁকিমুক্ত, রোগবালাই কম হয়। চাষাবাদ ও খরচ সরিষার মতোই। অন্যান্য তেল জাতীয় ফসলের চেয়ে লাভ বেশি। এই ফসল সাড়ে তিন মাসে উত্তোলন করা যায়। সরিষার মতো দানা হওয়ায় গ্রামীণ ঘানিসহ অটো অয়েল মিলে ভাঙানো যায়। তেমন কোনো রোগ বালাই আক্রমণ না করায় এ বছরও ফলন ভালো হয়েছে। সব ঠিক থাকলে কয়েক দিনের মধ্যে ফসল ঘরে তুলতে পারব। আগামীতে আরো বেশি জমিতে চাষ করার চিন্তা-ভাবনা আছে।

 

পেরিলা গবেষক মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ুম বলেন, দেশের সব অঞ্চলেই পেরিলার পরীক্ষামূলক চাষ হয়েছে এবং ভালো ফলাফল এসেছে। ফলনও ভালো। ফসলটিকে তেলজাতীয় প্রকল্পে যুক্তের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে কৃষকদের বিনা মূল্যে বীজ ও সার দেয়া হবে। বিদেশে এর প্রচুর চাহিদা রয়েছে।

 

উপজেলার অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা তুষার কান্তি রায় বলেন, তেলের আমদানি নির্ভরতা কমাতে ফসলটির চাষ স¤প্রসারণের লক্ষ্যে শেরে বাংলা কৃষি বিশ^বিদ্যালয় থেকে পরীক্ষিত জাত সংগ্রহ করে ওই কৃষকের কাছে সরবরাহ করা হয়। এখন পেরিলা চাষে তিনি সফল। পেরিলা তেলে ৫০-৫৫ ভাগ ওমেগা-৩ ফ্যাট থাকে যা মানবদেহের জন্য উপকারী। এই তেলে ক্ষতিকর ইরুসিক অ্যাসিড নেই। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে।

 

কিশোরগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা লোকমান আলম বলেন, এ অঞ্চলের মাটি ও আবহাওয়া পেরিলা চাষের জন্য খুবই উপযোগী। ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা কমাতে স্থানীয়ভাবে পেরিলার বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ করে কৃষকদের মাঝে সরবরাহ করার পরিকল্পনা আছে। তেল প্রক্রিয়াজাতকরণের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনা সম্ভব। এর চাষ ছড়িয়ে দিতে মাঠ পর্যায়ে কাজ করা হচ্ছে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version