-->
সাড়ে ৫ বছর ধরে নাফ নদীতে মাছ ধরা বন্ধ

অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার জেলেপল্লির ২৫ হাজার বাসিন্দা

এ এইচ এম ফরিদুল আলম শাহিন
অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার জেলেপল্লির ২৫ হাজার বাসিন্দা

এ এইচ এম ফরিদুল আলম শাহিন, কক্সবাজার: রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ও ইয়াবা পাচার রোধ করতে সাড়ে ৫ বছর ধরে নাফ নদীতে মাছ ধরা বন্ধ রয়েছে। এ কারণে নাফ নদীতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহকারী জেলে পরিবারের ২৫ হাজার লোকের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

 

টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ থেকে উখিয়ার পালংখালী পর্যন্ত ৭০ কিলোমিটার নাফ নদীতে দীর্ঘ সাড়ে ৫ বছর ধরে মাছ ধরা বন্ধ। হাজার হাজার জেলে বেকার। মানবেতর জীবনযাপন করছেন ২৫ হাজার জেলে। অনাহারে-অর্ধাহারে থাকতে থাকতে অনেকে পেশা পরিবর্তন করেছে। কেউ কেউ কাজের সন্ধানে গ্রাম ছেড়েছে। অনেকে বয়সের ভারে অসুস্থ হয়ে বিনা চিকিৎসায় বিছানায় কাতরাচ্ছে। সব মিলিয়ে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার নাফপাড়ের পেশাদার জেলেরা।

 

এসব হতদরিদ্র জেলেদের অভিযোগ, গত সাড়ে ৫ বছরে কেউ তাদের খবর রাখেনি। সরকার, জনপ্রতিনিধি, এনজিও, আইএনজিও কর্তৃক কোনো সহায়তা তারা পায়নি। তাদের সন্তানরা অধিকাংশই শিক্ষাদিক্ষা থেকে বঞ্চিত। পেটের তাগিদে অনেক শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে এক মুঠো অন্ন জোগাতে নিরন্তর সংগ্রাম করছে।

 

শত শত শিশু গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি দিয়েছে। এ অবস্থায় কেউ কেউ জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে সাগর পথে মালয়েশিয়া চলে যাচ্ছে। নাফ নদীতে মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয় ২০১৭ সালে। সেই থেকে পেশাজীবী জেলেরা পড়েন মহাসংকটে। তাই ভাতের অভাব আর বিনা চিকিৎসায় কাটছে জেলেদের জীবন। টেকনাফে নাফ নদীতে মাছ শিকারের সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার জেলে।

 

২০১৭ সালে রোহিঙ্গা ঢল ও ইয়াবা পাচারের অজুহাতে বাংলাদেশ-মিয়ানমারকে ভাগ করা নাফ নদীতে মাছ ধরা বন্ধ করে দেয় সরকার। এরপর থেকেই অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটছে জেলেদের। নদীর পাড়ের জেলেরা জানায়, তাদের পূর্বপুরুষ সূত্রে পাওয়া একমাত্র পেশা মাছ ধরা। কিন্তু হঠাৎ মাছ ধরা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের জীবনে নেমে এসেছে ঘোর অন্ধকার। স্থানীয় শ্রম বাজারও রোহিঙ্গারা দখল করায় সবদিক থেকে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন তারা। অর্থাভাবে তাদের বেঁচে থাকাটাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে ভাতের অভাব দূর করতেই চিন্তা করতে হয়, সেখানে সন্তানদের পড়াশোনা করানোর কথা ভাবতে পারেন না।

 

টেকনাফ জেলে পাড়ার স্থানীয় জেলে সাধনদাস বলেন, নাফ নদীর কিনারায় বসতি হওয়ায় বাপ-দাদার আমল হতেই আমাদের পরিবার মাছ শিকার করেই সংসার চালিয়ে এসেছে। নাফ নদীতে সবসময় পর্যাপ্ত মাছ পাওয়া যায়। তাই মাছ শিকার ছাড়া অন্য কোনো পেশায় অভ্যস্ত হইনি। এখনো নতুন পেশায় অভ্যস্ত হতে না পেরে বিগত সাড়ে ৫ বছর আমাদের মতো শত শত জেলে পরিবার মানবেতর জীবন পার করছে। এসব জেলেদের ফরিয়াদ নাফ নদীর তীর ঘেঁষে থাকা পাঁচ সহস্রাধিক পরিবারের দুঃখ-দুর্দশার কথা চিন্তা করে সরকার নাফ নদীতে মাছ শিকারের সুযোগ দিক।

 

আরেক জেলে আব্দুল করিম বলেন, রোহিঙ্গাদের কথা সবাই চিন্তা করে কিন্তু আমাদের কথা চিন্তা করার কেউ নেই। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ও ইয়াবার অজুহাতে নাফ নদীতে মাছ শিকারের নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়, কিন্তু এখনো কি ইয়াবা পাচার বন্ধ হয়েছে। উল্টো আরো বেড়েছে। এখনো কোনো না কোনো সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করছে। যারা পার হতে পারছে না তারা শূন্য রেখায় জড়ো হচ্ছে। সেখান থেকেই করছে যতো অপকর্ম।

 

টেকনাফ হোয়াইক্ষ্যং কানজর পাড়ার নবী হোসেন নামে এক জেলে বলেন, প্রায় সাড়ে ৫ বছর ধরে মাছ শিকার বন্ধ। তার মধ্যে তেমন সরকারি সহায়তাও পাইনি। এতদিন আমরা কীভাবে চলছি সেটার খবর কেউ রাখেনি। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনাও বন্ধ। ঠিকমতো ছেলেমেয়েদের মুখে খাবারও দিতে পারি না।

 

এক বেলা খেলে আরেক বেলা না খেয়ে থাকতে হয়। যদি সরকার নাফ নদীতে মাছ শিকারের নিষেধাজ্ঞা তুলে না নেয়, তাহলে না জানি আমাদের কপালে আরো কত দুঃখ আছে। টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মোহাম্মদ আলী বলেন, যে কারণে মাছ ধরা বন্ধ করা হয়েছিল সেই ইয়াবা পাচার এখনো বন্ধ হয়নি নাফ নদীতে। তাহলে কেন টেকনাফ উখিয়ার ২৫ হাজার জেলে না খেয়ে থাকবে? দ্রæত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার দাবি জানান তিনি।

 

এদিকে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বদরুজ্জামান বলেন, নাফ নদীর জেলেদের সহায়তার জন্য এখন পর্যন্ত আলাদা করে কোনো কর্মসূচি নেয়া হয়নি। আমরা প্রতিনিয়ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জেলেদের বিষয়টি অবগত করছি।এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, নাফ নদীর নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়ার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।

 

বর্তমানে সীমান্ত পরিস্থিতি খুব উত্তপ্ত। এ মুহূর্তে নাফ নদী খুলে দেয়া যৌক্তিক সময় না। জেলেদের দাবি, নাফ নদীতে নিষেধাজ্ঞার ৫ বছর পেরিয়ে গেলেও ২৫ হাজার জেলের একবারও খোঁজখবর নেয়নি কোনো জনপ্রতিনিধি ও সরকার। নিরাপত্তা জোরদার করে জেলেদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হোক নাফ নদী এমন দাবী স্থানীয়দেরও।

 

কারণ নদীতে মাছ ধরা বন্ধ করে দিলেই যে, ইয়াবা পাচার বন্ধ হবে এমন ধারণা মোটেই যুক্তি সংগত নয় বলে মনে করেন উখিয়া টেকনাফের জনপ্রতিনিধিরা। তারা মনে করেন নাফ নদীতে নৌযান চলছে, সীমান্ত বাণিজ্য সচল রয়েছে। স্থলবন্দর চালু আছে। মায়ানমার সীমারেখায় মাছ ধরা বন্ধ হয়নি। শুধু বাংলাদেশি সীমান্ত পারের জেলেরা পড়েছেন নিষেধাজ্ঞার কবলে।

 

এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের উচ্চপর্যায়ের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন জেলেরা।

 

ভোরের আকাশ/নি

মন্তব্য

Beta version