-->

দীর্ঘ হচ্ছে ক্ষুধার্ত মানুষের সারি, ত্রাণের জন্য হাহাকার

রুদ্র মিজান, সুনামগঞ্জ থেকে ফিরে
দীর্ঘ হচ্ছে ক্ষুধার্ত মানুষের সারি, ত্রাণের জন্য হাহাকার

ত্রাণ বিতরণ শেষ। তখনো ঘরের বারান্দায় কাঁদছেন এক নারী। তার কাঁন্না কিছুতেই থামছে না। কাঁদছেন আর বলছেন, ‘আমার ঘরবাড়ি হকলতা ডুবি গেছে। পিন্দের কাপড়ও নাই। আমারে কিচ্ছু দেউ। না দিলে খাইমু কিতা, বাচ্চাইনতেরে কিতা খাওয়াইমু।’ এভাবেই ত্রাণ না পেয়ে কাঁদছিলেন এক নারী।

গতকাল ব্যক্তিগত উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছিল সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলা সদরে। সেখানেই ঘটে ঘটনাটি। উদ্যোক্তারা জানান, তাদের পরিকল্পনার চেয়ে বেশি বিতরণ করেছেন। কিন্তু এত মানুষ ক্ষুধার্ত, ক্ষতিগ্রস্ত যে কোনোভাবেই সবাইকে ত্রাণ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। সিলেট থেকে সুনামগঞ্জে যেতে যেতে দেখা গেছে, সড়কের দুই পাশে পলিথিন, কাপড় দিয়ে রাত্রি যাপনের জায়গা করেছেন বন্যার্তরা। পাশেই বেঁধে রাখা হয়েছে গবাদিপশু। বন্যায় মানুষ আর গবাদিপশুর আশ্রয়স্থল একাকার হয়ে গেছে যেন। বন্যার পানি কমলেও নিজেদের ঘরে এখনো পানি। পানিতে ডুবে আছে রাস্তাঘাট। এরমধ্যে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক থেকে পানি সরে যাওয়ায় গাড়ি চলাচল করছে। কিন্তু জেলা সদর থেকে উপজেলাগুলোতে এখনো সড়ক যোগাযোগ গড়ে উঠেনি। সড়ক ডুবে আছে পানিতে। কোথাও কোথাও সড়ক ভেসে উঠলেও ভেঙ্গে গেছে বিভিন্ন স্থানে। সড়ক ভেঙ্গে প্রবল গতিতে এপার থেকে ওপারে যাচ্ছে পানি। ভেসে উঠা সড়কে ক্ষুধার্ত মানুষের দীর্ঘসারি। নতুন কাউকে দেখলেই ভিড় করছেন তারা।

দিরাই উপজেলার ভাঙ্গাডহর গ্রামে ত্রাণ বিতরণ করেছে ওব্যাট হেল্পপারস। নৌকায় করে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছে ত্রাণসামগ্রী। ঘর পানির নিচে থাকলেও বিভিন্নস্থানে আশ্রয় নেয়া মানুষ এখনো রান্না করার সুযোগ পাচ্ছে। তাই ত্রাণ হিসেবে ওব্যাট দিয়েছে চাল, ডাল, তেল, লবণ, আলু। ত্রাণ পেয়ে ওই গ্রামের আলতাব আলীর স্ত্রী জানান, বন্যায় ঘরে রাখা ধান নষ্ট হয়ে গেছে। ভেসে গেছে অনেককিছু। এই অবস্থায় চিড়া, মুড়ি, গুড় খেয়ে ছিলেন গত এক সপ্তাহ ধরেই। ত্রাণ পেয়ে খুশি এই নারী বলেন, অনেকদিন পর ভাত খেতে পারব।

সুনামগঞ্জ সদরেও দেখা গেছে একই দৃশ্য। সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ শহরে গাড়ি যোগাযোগ চালু হলেও শহরের কোনো কোনো স্থানে এখনো বন্যার পানি রয়ে গেছে। কোনো গাড়ি দেখলেই রাস্তার দু’পাশে ভিড় করেন বন্যার্তরা। পিকআপের খাবারের প্যাকেট খালি হয়ে যায় কিন্তু অপেক্ষমাণ মানুষের সারি কমে না। খালি হাতেই ফিরে যেতে হয় অনেককে। ওই এলাকায় সেনাবাহিনী রান্না করা খাবার খাওয়াচ্ছে। তাতে অনেকের ক্ষুধা নিবারণ হচ্ছে। দক্ষিণ সুনামগঞ্জের মদনপুর থেকে গনিগঞ্জ যেতে কয়েকবার গাড়ি বদল করতে হয়। বন্যার প্রবল স্রোতে বিভিন্নস্থানে সড়ক ভেঙে গেছে। ওই সড়ক দিয়ে যাওয়া-আসা করা কঠিন। প্রবল স্রোতে অনেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছেন। ওই সড়ক দিয়ে দিরাই উপজেলায় যাওয়া আরো কঠিন। দিরাই উপজেলা সদর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে শাল্লা উপজেলা। যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌকা। কিন্তু দিরাই পৌঁছানো যেখানে কঠিন সেখানে শাল্লা আরো দুস্কর। এসব কারণেই দুর্গম এসব এলাকায় ত্রাণ নিয়ে যেতে চান না অনেকে।

ব্যক্তিগত উদ্যোগে কেউ কেউ সেখানে ত্রাণ বিতরণ করছেন। শাল্লা উপজেলার বাসিন্দা বেনু মোহন দাশ জানান, সরকারি কোনো ত্রাণ তারা পাননি। ব্যক্তিগত উদ্যোগে কেউ কেউ সেখানে খাবার বিতরণ করছেন।

দিরাই উপজেলায় ত্রাণ বিতরণ প্রসঙ্গে ওব্যাট থিংক ট্যাংকের বাংলাদেশের ইনচার্জ মাহমুদ ইসলাম আকাশ বলেন, যেখানে ত্রাণ পৌঁছায়নি আমরা সেখানেই গিয়েছি। যাওয়ার সময় অনেকবার গাড়ি বদল করে বুক পরিমাণ পানি ঠেলে যেতে হয়েছে। দিরাই বাজার থেকে খাদ্যসামগ্রী কিনে আমরা প্যাকেট করে বিতরণ করেছি নৌকাযোগে। ফেরার সময় নৌকায় করে সিলেট-সুনামগঞ্জের ডাবর হয়ে ফিরেছি।

এখন বন্যা কবলিত ওই এলাকার সর্বত্রই দীর্ঘ হচ্ছে ক্ষুধার্ত মানুষের সারি। নারী ও শিশুরা ক্ষুধায় কাঁদছে। অসহায় অবস্থায় পুরুষরা। দক্ষিণ সুনামগঞ্জের বাসিন্দা খালেদ আহমদ বলেন, সুনামগঞ্জ মূলত কৃষিনির্ভর এলাকা। বছরে একবারই ফসল ফলে। বন্যার পানিতে ঘরে রাখা সেই ধান নষ্ট হয়েছে। যে কারণে এখানে গরিব-ধনী সবার একই অবস্থা। পানি কমে গেলেও খাবার ও চিকিৎসার কষ্টের শেষ হবে না এই এলাকার মানুষের। এজন্য সরকারকে জরুরিভাবে বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বিত্তবানদের ওই এলাকার মানুষের পাশে দাঁড়াতে অনুরোধ জানান তিনি।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version