-->

স্বপ্ন জয়ের পথে ওরা তিনকন্যা

কামরুজ্জামান মিন্টু, ময়মনসিংহ 
স্বপ্ন জয়ের পথে ওরা তিনকন্যা
ফুটবল প্র্যাকটিস করছেন সিনহা জাহান শিখা ও স্বপ্না আক্তার ঝেলি

ময়মনসিংহের নান্দাইলে অভাব-অনটনে বেড়ে ওঠা ফুটবল কন্যা সিনহা জাহান শিখা, স্বপ্না আক্তার ঝেলি ও তানিয়া আক্তার তানিশার পায়ের জাদুতে মুগ্ধ ফুটবলপ্রেমীরা। এবার তারা স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে দেশের সেরা ফুটবলার হতে চান। পেয়েছেন সেই সুযোগও। প্রশিক্ষণের জন্য পর্তুগাল যাওয়ার জন্য চূড়ান্ত হয়েছে এই তিনকন্যা।

যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ ক্রীড়া পরিদপ্তরের উদ্যোগে বঙ্গমাতা নারী ফুটবলের সেরা ৪০ খেলোয়াড়কে নিয়ে বিকেএসপিতে দুই মাসের প্রশিক্ষণ করে। তাদের মধ্য থেকে ১৬ জনের একটি দল ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর দেশ ইউরোপের পর্তুগালে যাবে।

এর মধ্যে পাঁচজন অতিরিক্ত এবং ১১ জন খেলবে মূল দলে। ওই এগারোজনের দু’জন হচ্ছে শিখা ও ঝেলি। আর তানিশা রয়েছে অপেক্ষমাণ পাঁচজনের কাতারে। সেখানে গিয়ে তারা ফুটবল খেলার ওপর প্রশিক্ষণ নেবে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী জুলাইয়ে তারা উড়াল দেবে স্বপ্নের আকাশে।

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে ২০১৮ সালে রানার আপ ও পরের বছর চ্যাম্পিয়ন হওয়া নান্দাইলের পাঁচরুখী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টিমের সদস্য ছিল এই তিনকন্যা। বর্তমানে শিখা নান্দাইল পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণির, ঝেলি ও তানিয়া অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী।

উপজেলার শেরপুর ইউনিয়নের রাজাবাড়িয়া গ্রামের টমটম (অবৈধযান) চালক বিপ্লব মিয়ার মেয়ে শিখা ল্যাফট উইং পজিশনে এবং একই ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এলাকা ইলাশপুরের কৃষক ফয়জুদ্দিন ফকিরের মেয়ে ঝেলি দলের গোলরক্ষক হিসেবে খেলে আসছে। আর মোয়াজ্জেমপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ কুতুবপুর গ্রামের দিনমজুর দুলাল মিয়ার মেয়ে তানিয়ার ওপর দলের রক্ষণভাগ সামলানোর দায়িত্ব থাকে।

এই তিন ফুটবলারের সঙ্গে কথা বলেছে দৈনিক ভোরের আকাশ। নানা ঘাতপ্রতিঘাত পাড়ি দিয়ে ফুটবলার হয়ে ওঠার গল্পসহ জানিয়েছেন ফুটবলকে নিয়ে তাদের ভবিষ্যৎ স্বপ্নের কথাও।

সিনহা জাহান শিখা (বামে) তানিয়া আক্তার তানিশা (মাঝে) স্বপ্না আক্তার ঝেলি (ডানে)

আলাপচারিতার ফাঁকে সিনহা জাহান শিখা বলেন, ‘আমি যখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি তখন মা মারা যান। পরে বাবা দ্বিতীয় সংসার পাতেন। সেই সংসারে ঠাঁই হচ্ছিল না আমরা তিন বোন ও এক ভাইয়ের। তবে বাবা আমাদের ভরণপোষণের খরচ জুগিয়েছেন ঠিকমতোই। এদিকে আমাদের দেখভালসহ পড়াশোনার দায়িত্ব নেন বিধবা নানী হালিমা খাতুন।

শিখা বলেন, পাঁচরুখি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময়ই ফুটবল খেলায় জড়িয়ে পড়ি। পথটা মোটেও সহজ ছিল না। তারপরও সহজ করে নিয়েছি, খেলেছি। নানির ছেলে সন্তান নেই। ফলে আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো না থাকায় অতিকষ্টে নানি আমাদের বড় করেছেন, নানি ডিম বিক্রি করেও টাকা দিয়েছেন, আর বাবা যতটুকু পেরেছেন খরচ জুগিয়েছেন।

শিখা আরো বলেন, এমনও সময় কাটে- আমাদের বাড়িতে তিন বেলা রান্না হয় না। পেটে ক্ষুধা নিয়ে বল খেলতে মাঠে গিয়েছি। এভাবে ধীরে ধীরে নিজেকে তৈরি করেছি। আমি পর্তুগাল যাব এমন খবরে পরিবারের সবাই আনন্দিত। জাতীয় দলে খেলতে পারলেই আমার স্বপ্ন পূরণ হবে।

স্বপ্না আক্তার ঝেলি দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে আমি সবার ছোট। ভাইবোনেরা গার্মেন্টে শ্রমিকের কাজ করে। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় দেখতাম অনেক মেয়েরা ফুটবল খেলছে। তখন আমার ভালো লাগত। তখন আমিও ফুটবল খেলতে নামি। সেই থেকেই মনে স্বপ্ন জাগে একদিন দেশসেরা ফুটবলার হব।

তিনি বলেন, ‘প্র্যাকটিস করতে দুই কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে ও ১২ কিলোমিটার রাস্তা গাড়ি দিয়ে যেতে হতো। মানুষও অনেক খারাপ কথা বলত, কিন্তু আমি ওসব কথায় কান দেইনি। কোনোদিন খেয়ে গেছি, কোনো দিন না খেয়েও গেছি। অনেক সময় বাবা-মা ধার করেও খরচ জুগিয়েছে। ভালো খেলি বলে প্রতি সপ্তাহে চন্ডীপাশা মাঠে আমার খেলা দেখতে যেতেন বাবা। এজন্য মনে আরো বেশি সাহস পেয়েছি। জাতীয় পর্যায়ে যেন খেলতে পারি এবং দেশের সুনাম যেন বয়ে আনতে পারি এই লক্ষ্য নিয়ে খেলে যাচ্ছি।’

তানিয়া আক্তার তানিশা বলেন, বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময় মায়ের উৎসাহে ফুটবল খেলায় নাম লিখিয়েছি। এদিকে বাবা অন্যের জমিতে কাজ করে সংসার চালান। ফলে তিন বেলা খাবার জোটেনি। টাকার জন্য অনেক সময় প্র্যাকটিসে যেতে পারিনি। তবে, অনেকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিলেও খারাপ লোকের অভাব ছিল না। অনেকে বাবা-মাকে বলেছে, ফুটবল খেললে মেয়েকে বিয়ে দিতে পারবে না। মেয়েদের এসব খেলাধুলা করা ঠিক না। কিন্তু আমার পরিবার তাদের কটূ কথায় কান দেয়নি। ফলে আমিও আপন গতিতে প্র্যাকটিস চালিয়ে গেছি।

তিনি বলেন, আমাদের ছনের একটি ঘর বহুবছর আগে ঝড়ে উড়িয়ে নেওয়ার পর থেকে চাচার জরাজীর্ণ টিনের ঘরটিতে আশ্রিত হই। বৃষ্টি হলেই ঘরের ভেতরে অঝরে টপটপ পানি পড়ে। এছাড়া আমার মায়ের গলার দুই রগে টিউমার হয়েছে। চিকিৎসক বলেছেন, অপারেশন করলে সুস্থ হবে। কিন্তু টাকার অভাবে অপারেশন হচ্ছে না। যদি ভালো কিছু করতে পারি, টাকা ইনকাম করতে পারি, তাহলে অপারেশন করে প্রথমে মাকে সুস্থ করব।

এই তিন নারী ফুটবলারকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন মকবুল হোসেন। তিনি দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, এরা কষ্টকে কখনো কষ্ট মনে করেনি। অভাব-অনটনসহ নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও এ পর্যন্ত আসতে পেরেছে। এই তিনজন ছাড়াও নান্দাইলের ১৫ সদস্যের একটি ফুটবল টিমকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। তারাও ওই তিনজনকে দেখে উৎসাহ নিয়ে খেলছে। এরা একদিন দেশসেরা খেলোয়াড় হয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে- এমনটাই প্রত্যাশা করি।

এদিকে পর্তুগালে যাওয়ার জন্য তিনকন্যার নাম চূড়ান্ত হওয়ায় আনন্দিত শিক্ষকরাও। নান্দাইল পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল খালেক বলেন, বিদেশে যাওয়ার খবরটা শুনেই সব শিক্ষক অনেক খুশি হয়েছে। কারণ আমরা সবাই সবসময় তাদের উৎসাহ দিয়েছি। আমার বিশ্বাস, এরা একদিন সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছবে।

মন্তব্য

Beta version