-->

সড়কে চরম বিশৃঙ্খলা!

বিশেষ প্রতিনিধি
সড়কে চরম বিশৃঙ্খলা!

ঢাকা: মুগদা পেট্রলপাম্প সংলগ্ন মূল সড়কে দাঁড়িয়ে যাত্রী উঠানোয় পেছনে যানবাহনের জটলা। প্রায় ৫ মিনিট ধরে এ পরিস্থিতিতে বিরক্ত হন আটকে থাকা যানবাহনের চালকসহ যাত্রীরা। একের পর এক হর্ন বাজতে থাকায় গোটা এলাকায় শব্দ দূষণ ছড়িয়ে যায়। এমন অস্বাভাবিক শব্দে অনেকেই হাত দিয়ে কান চেপে ধরে রাখেন। এক প্রাইভেট কারচালক বাসচালকের কাণ্ডজ্ঞানহীন এ কাজের প্রতিবাদ করায় দুই পক্ষের কথা কাটাকাটি শেষে ঘটনা শেষ পর্যন্ত হাতাহাতিতে গড়ায়! ঘটনা গত বৃহস্পতিবার সকালের। একই দিন প্রায় ৮ থেকে ১০ মিনিট শাহবাগ সিগন্যালে আটকে থাকার পর মিডলাইন পরিবহনের বাসটি যাচ্ছিল সায়েন্সল্যাবের দিকে। সিগন্যাল পার হয়েই নির্দিষ্ট স্টপেজ ছাড়াই শুরু হয় যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতা। অন্য একটি বাসের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকায় মূল সড়ক বন্ধ হয়ে যায়। ফলে পেছনের যানবাহনগুলো চলতে পারে না। একপর্যায়ে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ এসে বাসগুলোকে সরিয়ে দেয়।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (বিআরটিএ) বলছে, গত ১৩ মাসে মামলা হয়েছে প্রায়ে ১০ হাজার। আদায় করা হয়েছে ১ কোটি ৯০ লাখ টাকার বেশি জরিমানা। ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয়েছে ১৬৮টি যান। কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে ১১৬ চালক ও সহকারীকে। বসে নেই পুলিশও। ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করায় গত ৬ মাসে অন্তত দেড় লাখ মামলা হয়েছে। চলমান অভিযানেও গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরেনি। তবে পরিস্থিতি আগের চেয়ে উন্নতি হয়েছে বলছেন সংস্থাটির দায়িত্বশিল কর্তাব্যক্তিরা। আর পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়কে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে হলে জোরদার করতে হবে বিআরটিএ ও পুলিশের অভিযান। সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ কার্যকর করার কোনো বিকল্প নেই। সেইসঙ্গে প্রয়োজন পরিবহন সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বন্ধ করতে হবে চুক্তিভিত্তিক বাস চালানো। বিআরটিএ জনবল বাড়ানোর তাগিদও দিয়েছেন তারা। রাস্তায় বিশৃঙ্খলার দিক থেকে প্রথম নাম ‘বাস’।

 

পরিবহন নেতারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে এ সেক্টরে অরাজগতা চলে আসছে। ইচ্ছা করলেই রাতারাতি সবকিছু বদলে দেয়া সম্ভভ নয়। সবাই মিলে এ সেক্টর নিয়ে কাজ করতে হবে। তাহলেই পরিবহনে বিশৃঙ্খলা নিয়মে আনা সম্ভব।

বছরজুড়ে মামলা : পরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে বছরজুড়ে মোবাইলকোর্ট পরিচালনা করে বিআরটিএ। মাসভিত্তিক হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৩ মাসের হিসাবে জানা যায়, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ২৪৩টি মোবাইলকোর্ট পরিচালনায় ২ হাজার ৩০৪টি মামলা, ৩৩ লাখ ৯৬ হাজার ১০০ জরিমানা ও ৪০ জনকে দণ্ড ও ১৪টি গাড়ি ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয়েছে। আর অক্টোবর মাসে ২১৪টি মোবাইলকোর্ট পরিচালনায় ১ হাজার ৭৬১টি মামলা জরিমানা আদায় হয়েছে ৩২ লাখ ৪০ হাজার ১০০ টাকা, বিভিন্ন অপরাধে ৩৬ জনকে দণ্ড ও ১২টি গাড়ি ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয়েছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ১৬৫টি মোবাইলকোর্ট পরিচালনায় মামলার সংখ্যা ১ হাজার ১২৬, ২৭ লাখ ২৬ হাজার ৯৫০ টাকা জরিমানা, ১৫ জনকে দণ্ড ও ৩৫টি যানবাহন ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয়েছে। জুলাই মাসে ২৩৩টি মোবাইলকোর্ট পরিচালনায় ১ হাজার ৩৩২ মামলা, ৩৮ লাখ ৭৪ হাজার ৮০০ টাকা জরিমানা, ৪ জনকে দণ্ড ও ৪৭টি গাড়ি ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয়। আগস্টে ২৬৩টি মোবাইলকোর্ট পরিচালনায় ১ হাজার ৯৮৬টি মামলা, ৭ লাখ ১৩ হাজার ২০০ জরিমানা, ১১ জনকে দণ্ড ও ৩৩টি গাড়ি ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয়েছে।

সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মিলিয়ে ২০৭টি মোবাইলকোর্ট পরিচালনায় ১ হাজার ৩২১ টি মামলা, ৫১ লাখ ৩৫ হাজার ৩০০ জরিমানা আদায়, ১০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও ২৭টি যানবাহন ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয়। চলমান অভিযানেও পরিবহনে শৃঙ্খলা না ফেরায় করণীয় জানতে চাইলে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, একক অভিযানে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব নয়। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানের মধ্য দিয়ে আমরা চালকদের সতর্কও করছি। তাদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। পাশপাশি মালিক, শমিক, যাত্রীসহ সবাইকে এ বিষয়ে কাজ করতে হবে বলেও মত দেন তিনি।

 

বিআরটিএ জানায়, ঢাকাসহ সারা দেশে তাদের নিবন্ধিত বৈধ যানবাহনের সংখ্যা ৫৪ লাখ ৬৬ হাজার ৯৫৪। এর মধ্যে সাড়ে ৫ লাখের মতো ফিটনেসবিহীন গাড়ি রয়েছে বলে দাবি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের। ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা ৪ লাখ ৮১ হাজার ২৯টি বলে জাতীয় সংসদকে জানান সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নতুন ১৮টি ওয়ার্ড এলাকা নিয়ে পুরো শহরে অলিগলি ও প্রধান সড়ক মিলিয়ে এখন প্রায় ৩ হাজার কিলোমিটার রাস্তা রয়েছে। বিআরটিএর চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেয়া তথ্যানুযায়ী, এসব সড়কে চলাচলের জন্য ঢাকায় নিবন্ধন রয়েছে ২০ ধরনের ১৯ লাখ ২১ হাজারের বেশি মোটরযানের। এর মধ্যে ব্যক্তিগত যাত্রিবাহী গাড়ি রয়েছে ৩ লাখ ১৭ হাজার ৫০৯টি। মোটরসাইকেল আছে ৯ লাখ ৯২ হাজার ১৪৮টি। আর ঢাকা থেকে বাস-মিনিবাসের নিবন্ধন নেয়া হয়েছে ৪৭ হাজার ৪৮৪টি। এর মধ্যে বাস ৩৭ হাজার ৫৯৩টি এবং মিনিবাস ৯ হাজার ৮৯১টি, যা নিবন্ধিত মোট মোটরযানের মাত্র ২.৬২ শতাংশ। তবে নিয়মিত সড়কে চলছে ৮-৯ হাজার বাস-মিনিবাস। মোট নিবন্ধন নেয়া পরিবহণের তুলনায় তা মাত্র দশমিক ৪৯ শতাংশ। অথচ সংশ্লিষ্টরা শহরের যানজটের জন্য অন্যতম দায়ী হিসাবে বিবেচনা করেন এ গণপরিবহনকে।

রাজধানী ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থা পরিচালিত হয় ডিএমপির ৮টি বিভাগের তত্ত্বাবধানে। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে গত ৮ মাসে ট্রাফিক আইন ভঙ্গের জন্য দেড় লাখের বেশি মামলা করেছেন তারা। বাসগুলোকে শৃঙ্খলায় আনতে পুরো শহরে বাস থামানোর জন্য ১২০টি ‘স্টপেজ’ নির্ধারণ করে দিয়েছে ট্রাফিক বিভাগ। যাত্রীদের সুবিধার্থে অনেক স্টপেজে সিটি করপোরেশন নির্মাণ করেছে যাত্রীছাউনি। অথচ কোনো উদ্যোগই সমস্যার সমাধান করতে পারছে না। ঢাকার বিভিন্ন স্থানের অন্তত ২০টি স্টপেজ পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, যাত্রী নামানোর সময় কখনো কখনো স্টপেজে গাড়ি থামানো হলেও উঠানোর সময় তা একেবারেই মানা হচ্ছে না। বেশিরভাগ সময়ে এ স্থানগুলোয় পৌঁছানোর আগেই যাত্রীদের বাস থেকে ডেকে নামানো হচ্ছে। এতে অনেকটা রাস্তা হেঁটে পৌঁছতে হচ্ছে স্টপেজে। এর মধ্যে একই কোম্পানির অন্য বাস যাতে সামনে যেতে না পারে, সেজন্য আটকে রাখা হচ্ছে সড়ক। সাম্প্রতিক সময়ে দুই বাসের রেষারেষিতে একাধিক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ও আহতের ঘটনা ঘটলেও পরিস্থিতি বদলায়নি।

বিষয়টি নিয়ে রমনা ট্রাফিক বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার জয়দেব চৌধুরী বলেন, গাড়ির ফিটনেস সনদ দিয়ে থাকে বিআরটিএ। আমরা নিয়মিত সড়কে অভিযান চালিয়ে থাকি। ফিটনেসবিহীন গাড়ি পেলে ডাম্পিং করা হয়, মামলাও দেয়া হয়। আমরা রাস্তায় বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছি। তবে অভিযানের পাশাপাশি চালকদের দক্ষ প্রশিক্ষণ যেমন জরুরি তেমনি রাস্তাও বাড়াতে হবে।

 

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালত যথাযথ প্রক্রিয়ায় পরিচালিত না হওয়ায় পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। লাখ লাখ বাস চলাচল করছে সড়কে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক যান ফিটনেসবিহীন। মাত্র ১০-১১টি ভ্রাম্যমাণ আদালত দিয়ে কী এত বিপুলসংখ্যক গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব? অবৈধ অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে বিষয়টি দেখভাল করার দায়িত্বে থাকা মহলকে ম্যানেজ করে চলছেন মালিকরা। এখন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে কে?

 

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা আনতে নানামুখী উদ্যোগ নিয়ে মাঠে নামতে হবে। শুধু জরিমানা করে সড়কে শৃঙ্খলা আসবে না। কিন্তু বিআরটিএ বা পুলিশের পক্ষ থেকে অভিযান ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া এ ধরনের অরাজকতা বন্ধ করা যাবে না। এজন্য একটি বড় পরিকল্পনা প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version