-->

কিশোর সাহিত্য শূন্যতার সম্মোহন

জাকিয়া জেসমিন যূথি
কিশোর সাহিত্য শূন্যতার সম্মোহন

১আঁখি, রুনা আর শান্ত তিনজন একই গ্রামে কাছাকাছি বাড়িতে থাকে। ওরা প্রতিদিন এক সাথে বিদ্যালয়ে যায় আবার ফিরেও আসে এক সাথেই। সবসময় এক সাথে ঘুরাফিরা করে। রুনা পড়ে তৃতীয় শ্রেণিতে। আর বাকি দুজন পঞ্চম শ্রেণিতে। ভিন্ন শ্রেণিতে পড়া সত্তেও ওরা পরস্পরের খুব ভালো বন্ধু। প্রত্যেকেই মনযোগি ছাত্রছাত্রী বলে বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিকটও খুব পছন্দের।

 

এসেম্বলীর সময় বিদ্যালয়ে ছোট শ্রেণির বাচ্চারা লাইনে ছন্দোবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে পারে না। আঁখি আর শান্ত তাদেরকে সঠিকভাবে লাইনে দাঁড়াতে সাহায্য করে। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া দুই জমজ বোন সুরাইয়া আর মাসুমা ভালো কোরআন তেলাওয়াত করে বলে সবসময় তাদের ডাক পড়ে। ভালো আদব-কায়দা ও মিষ্ট ব্যবহারের জন্য বিদ্যালয়ের ছোট বড় সবাই সুরাইয়া, মাসুমা, শান্ত, আঁখি আর রুনাকে পছন্দ করে। কোনো শ্রেণিতে সব ছাত্রছাত্রী পড়াশুনায় ভালো হয় না। দুর্বল সহপাঠীকে কোনো বিষয় বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করে শান্ত আর আঁখি।

 

বিদ্যালয়ে বার্ষিক বনভোজন ও শিক্ষাসফরের আয়োজন হচ্ছে। সবাই এই শিক্ষাসফরে যাওয়ার জন্য আনন্দে ভাসছে। সুরাইয়া ও মাসুমার মা নেই। সংসারে দাদি আছে আর বাবা। বাবা গঞ্জে ট্রাক্টরের ব্যবসা করে। সকালে যায় ফেরে সেই রাতে। তারা গিয়ে দাদির কাছে আবদার জানাল বনভোজনে যাওয়ার। দাদি বলে দিলেন বাবার কাছে অনুমতি নিতে। অবশেষে বনভোজনে যাওয়ার দিন ঘনিয়ে এলো, সকাল সাতটায় বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে সবাই একসাথে মিলিত হয়ে বাসে উঠবে। দাদিকে সুরাইয়া আর মাসুমা এক সাথে বল উঠল, ‘বু চলে গেলাম’, বলে সালাম দিল। দাদি বিদায় দিলেন।

 

শান্ত এই প্রথম বাবা-মাকে ছেড়ে দূরে কোথাও যাচ্ছে। বাড়ি থেকে বেরোবার সময় বাবা তার নিজের মোবাইল ফোনটা তার হাতে দিয়ে দিল। ছেলে এক দল বাচ্চার সাথে বনভোজনে যাচ্ছে। মনটা তার কিছুতেই সায় দিচ্ছে না। এতগুলো চঞ্চল বাচ্চা ছেলেমেয়ের সঠিক খেয়াল কি কয়েকজন শিক্ষক নিতে পারবে? মন সায় দেয় না কিছুতেই কিন্তু সন্তানের আনন্দে বাধা দিতেও মনে চায় না। ইচ্ছা করে নিজেরও সাথে যেতে।

 

কিন্তু একদিকে ঘরে অসুস্থ বউ, নিজের গৃহস্থালী কাজ আরেকদিকে বিদ্যালয়ের বনভোজনে অভিভাবকের যাওয়ার নিয়ম নাই। ছোট একটা বাস ভাড়া করা হয়েছে। তার মতো যদি সব বাবা-মা সাথে যেতে চায় তাহলে কর্তৃপক্ষের হয়তো বাসের সংখ্যা বাড়াতে হবে। এত কিছু চিন্তা করে ছেলেকে মোবাইল ফোনটা সাথে দেয়াই যুক্তসংগত মনে করল। বাস পর্যন্ত ছেলের সাথে গেলো সেও। বাসে উঠিয়ে দিয়ে পরে কাজে যাবে।

 

রুনা এদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। সংসারে শুধু বিধবা মা আছে। নিকটস্থ এনজিও তে কাজ করে মেয়েকে শিক্ষিত করার স্বপ্ন দেখে। মেয়েকে ডাক্তার বানাতে চায় সে। শনিবার সকালে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বাসে মেয়েকে উঠিয়ে দিয়ে নিজের কাজে চলে যায় রুনার মা লিপি খাতুন। মেয়েকে একশটা টাকাও দিয়ে দিয়েছে সে যদি তার কিছু খেতে মনে চায়। অনেক ছাত্রছাত্রী এসে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ ভরে গেছে। বাসও এসে গেছে আগেই।

 

অভিভাবকদের আশ্বস্থ করে সব শিক্ষার্থী নিয়ে বাসে উঠে পরলেন সম্মানিত শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ। এই আনন্দ আয়োজনে প্রকৃতি আড়ালে বসে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। গোমরামুখো সে হাসিতে আনন্দের ছিটেফোঁটাও নেই। দিন শেষে ঘন মেঘ নেমে আসবে। সেই প্রস্তুতিই নিচ্ছে প্রকৃতি।

 

ফাল্গুনের মিঠে মিঠে রোদ আর ধুলোর ঝড় ছিল কয়েকদিন। আজ সকাল থেকেই আকাশ গোমড়া। যশোরের চৌগাছা-মহেশপুর সড়ক। স্থানীয় কৃষক ও বীজ ব্যবসায়ীরা লাল শাকের বীজ বের করার জন্য পর্যাপ্ত রোদ পাচ্ছে না। সামনে কয়দিন মেঘলা আবহাওয়া থাকবে বলা যাচ্ছে না। আজ রাতে বোধহয় খুব মেঘ করবে। দুপুরেই এক ঝলক বৃষ্টি হয়ে গেছে। স্থানীয় গ্রামবাসী সামনের বাসের বড় সড়কটার উপরে লাল শাক শুকানোর জন্য বিছিয়ে দিয়েছে।

 

প্রকৃতি আরেকবার মুচকি হাসলো। মানুষের বুদ্ধিতে মাঝেমাঝে নিজেদের বিপদ নিজেরাই ডেকে আনে। গ্রামের দিকের মানুষ সন্ধ্যার পরেই ঘুমিয়ে যায়। মেঘলা মেঘলা আবহাওয়া মাঘের শীত নামিয়ে দিয়েছে সারা এলাকা জুড়ে। তাই প্রধান সড়কের উপরে বিছিয়ে দেয়া শাকের স্তপকে কেউ আর সরায়নি। ভেবেছে সকাল হলেই তুলে নেয়া যাবে। এত রাতে নিশ্চয়ই আর বাস টাস আসবে না। গ্রামের মানুষের নির্বুদ্ধিতায় প্রকৃতির এবার সত্যি কষ্ট হতে থাকে।

 

৩ রাত আটটা পেরিয়ে গেছে। বাস চলছে। বেনাপোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষার্থী ও দশজন শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়ে বাসটি দিন শেষে বনভোজন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সুসম্পন্ন করে ফিরে চলে গন্তব্যে। রাত দশটায় সমস্ত অভিভাবক তাদের সন্তানদের ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে উপস্থিত থাকবে বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে। শান্ত বাবার সাথে কিছুক্ষণ আগেই মোবাইলে কথা বলেছে।

 

আজকের সারাদিনের সমস্ত অভিজ্ঞতা সে বাসায় গিয়ে বাবাকে আরও খুঁটিনাটি জানাবে। রাতে ঘুমানোর আগেই অথবা ভোরবেলা উঠে বনভোজনে বিস্তারিত লিখে প্রধান শিক্ষকের কাছে জমা দেবে। বনভোজন বিষয়ে রচনা প্রতিযোগিতায় ও পুরস্কার নিয়েই ছাড়বে। প্রতিটা ঘটনা ও খুব সুন্দর করে মনের ভেতরে গুছিয়ে নিয়েছে। কিছু কিছু জায়গার নাম ছোট খাতায় লিখেও এনেছে। এরকম স্বপ্নে রঙিন বাসের বাকি শিক্ষার্থীরাও।

 

সবার মনেই বিরাজ করছে একই ধরনের স্বপ্ন সবাই বাড়িতে গিয়ে নিজ নিজ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করবে সেই আনন্দে উজ্জ্বল। এক গাঁদা ছাত্রছাত্রীকে প্রয়োজনের তুলনায় ছোট বাসে গাদাগাদি করার কষ্টটা ওরা ভুলে গেছে নতুন আনন্দময় অভিজ্ঞতার কারণে।

 

৪মেহেরপুরের মুজিবনগর থেকে বনভোজন ও শিক্ষাসফরের বাসটি সন্ধ্যার আগেই ফিরতি পথে স্কুলের দিকে যাত্রা শুরু করেছে। বাসের ড্রাইভার করিমুল প্রথম থেকেই কিছুটা বিরক্ত। এতগুলা বাচ্চা ছেলেমেয়েকে একটা বাসে নেয়া হয়েছে। এদের কিচিরমিচির থামেই না। শিক্ষক-শিক্ষিকারাও কিছু বলছে না। তার উপর বিরূপ প্রকৃতি। মনের ভেতরে কুঁ ডাক দিচ্ছে। বার বার অমঙ্গলের আশঙ্কা আসছে। যেই রাস্তাটা দিয়ে ওকে পার হতে হবে সে রাস্তাটা খুব নির্জন থাকে। অনেক সময় ডাকাতরা ওঁত পেতে থাকে। দুঃশ্চিন্তার ছায়া পড়তে থাকে ড্রাইভারের মনে।

 

বাস চলতে থাকে। ঝাউতলায় বাসটি পৌঁছালে হঠাত বিকট শব্দ শুনে ড্রাইভার হতচকিত হয়ে যায়। মৃদু ভীত কণ্ঠে ড্রাইভার হেল্পারের দিকে চেয়ে বলে উঠে ডাকাত! ডাকাত! হেল্পার বাসের যাত্রীদের মধ্যে শিক্ষকদের কাছে গিয়ে আস্তে করে বলে-‘স্যার, বাসে মনে অয় ডাকাইত পরছে!’ শিক্ষকরা জবাব দেয়ার আগেই বাসের ভেতরে লাইট নিভে যায়।

 

অন্ধকারে মনে হতে থাকে সমস্ত বাস উলটে যাচ্ছে। কারো কাছে টর্চ লাইট নেই! বাচ্চাদের কথা ভেবে শিক্ষিক-শিক্ষিকাদের দলটা হঠাৎ ভীষণ শঙ্কিত হয়ে উঠে। বাচ্চাগুলোও কান্নাকাটি শুরু করেছে। কারো কারো ব্যথায় গোঙানি কণ্ঠস্বরও ভেসে আসে। এই রাস্তায় ডাকাতির কোনো নিশানা আছে বলে জানা ছিল না তো! তাহলে এতগুলো বাচ্চার ঝুঁকি নিয়ে কিছুতেই এদিকে তারা আসতো না।

 

৫ ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪। রবিবারের সকাল। বেনাপোল বলফিল্ড মাঠ। আজকে থেকে সাতদিন ধরে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা চলবে। সপ্তাহ শেষে প্রতিযোগিদের পুরস্কার বিতরণী উৎসব হওয়ার কথা। বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শতশত শিক্ষার্থী অভিভাবকের মুখে আনন্দের বদলে নেমেছে শোকের ছায়া। গতকাল শনিবার রাতে বনভোজন থেকে ফেরার সময় যশোরের চৌগাছা-মহেশপুর সড়কের ঝাউতলায় বাস উলটে খাদে পরে গেলে এই বিদ্যালয়ের সাতটি মেধাবী মুখ ঝরে যায়।

 

শার্শা উপজেলার পাশাপাশি তিনটি গ্রাম নামাজ, ছোট আঁচড়া ও গাজীপুর। ছোট আঁচড়া গ্রামেরই পাঁচজন শিশু- সুমাইয়া, মাসুমা, রুনা, শান্ত, আঁখি। বাকি দুজনের একজন নামাজ গ্রামের হোসেন আর গাজীপুর গ্রামের মিথিলা। সাতজনের মরদেহ জানাজার জন্য খাটিয়ায় রাখা হয়েছে পাশাপাশি। জানাজার পরে তাদের মরদেহ নিজ নিজ গ্রামে দাফন করা হবে। পরিবার, স্বজন, বিদ্যালয়ের সমস্ত সহপাঠী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, প্রতিবেশীরা ছুটে এসেছে এই অকালমৃত্যুতে শোকবিহবল হয়ে।

 

বেনাপোল পৌরসভাসংলগ্ন গ্রাম ছোট আঁচড়া গ্রামের কাছাকাছি বাসিন্দা আঁখি, রুনা ও শান্ত সবসময় এক সাথে সময় কাটাতো। মৃত্যুও তিন বন্ধুকে এক সাথেই নিয়ে গেল না ফেরার দেশে।

 

একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে শান্তর মা-বাবা ঘন ঘন ফিট লেগে যাচ্ছে। শান্তর বাবা ছেলের মরদেহের পাশে বসে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলে- ‘ও শান্তরে! তোর সাথে তো কিছুক্ষণ আগেও কথা কইলাম রে শান্ত। তুই আমাগোরে রাখি কই চলে গেলি? আমার শান্ত ছেলেটারে ক্যান নিয়া গেলা রে আল্লা!’ বলে বিলাপ করতে থাকে শান্তর বাবাটা। একই অবস্থা বাকি পরিবারগুলোতেও।

 

রুনার বিধবা মা লিপি খাতুনের কষ্টের আহাজারিতে সারা গ্রামে শোকের ছায়া নেমে এলো। স্বামী নেই। একমাত্র মেয়েটাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেল একটা বনভোজনেই। একটা দুর্ঘটনা সেই স্বপ্নটাকে দূর অতীত করে দিল। এখন রুনার মা বার বার কেঁদে বুক ফাটাচ্ছে বাচ্চা মেয়েটাকে কেন একা অন্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছিল এই বলে বলে। যদি শিক্ষিকাদের হাতে ছেড়ে না দিত তাহলে এখন তাকে সন্তানহারা হতে হতো না।

 

সুরাইয়া ও মাসুমার দাদি ও বাবাও কেঁদে কেঁদে বিলাপ করতে থাকলো-‘বু চলে গেলাম বলে সেই যে চলে গেল আর ফিরে এল না! সারা দিন তাগের সাতে কথা বলতে পারলাম নারে!’

 

দুর্ঘটনায় আহত শিক্ষার্থীদের যশোরের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। একজন শিক্ষক ও দুজন শিক্ষিকার অবস্থাও আশঙ্কাজনক। বেনাপোল পৌর শহরে সকাল থেকে নেমে এসেছে নীরবতা। মাঝেমধ্যে মাইকে শোনা যাচ্ছে- নিহতদের জন্য বেনাপোল পৌরসভায় তিন দিনের শোক দিবস পালনের ঘোষণা। এক সাথে সাতজন শিক্ষার্থী হারিয়ে বেনাপোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শোকের চিহ্ন বহন করছে একটি কালো পতাকা।

 

সুনশান বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষগুলো ফাঁকা। শিক্ষক-শিক্ষিকার কক্ষটিতেও বিরাজ করছে নীরবতা! প্রকৃতিদেবী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এবার ব্যস্ত হয়ে উঠতে থাকে শীতের আবহ ছাড়িয়ে রোদের আভা ছড়াতে দশদিগন্তে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version