-->

সাধের জনম

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ
সাধের জনম

এখানে চাকরি নেওয়ার পর গার্মেন্টসের ছেলে-মেয়ে সম্পর্কে ধারণাই পাল্টে গেছে। এরা যে পরিশ্রম করে জীবন ধারণ করে, দেশের অর্থনীতিতে এরা যে অবদান রাখে তাতে সবার আগে এদেরই স্যালুট দেয়া উচিত।

 

পাঁচটার পরপরই মলিনা, ময়না ও টিয়া বের হয়ে যায়। ওদের সঙ্গে রয়েছে বজলু। বজলু তার মায়ের সাথে এই বস্তিতেই থাকে। সে মলিনার প্রেমিক। হালকা-পাতলা গড়নের বজলু দেখতে সুদর্শন। ছয় ফুটের বেশি লম্বা। বাঁশির মতো লম্বা নাক। ভাসা ভাসা চোখ।

 

যে কোনো মেয়ে দেখলেই তার প্রেমে পড়ে। সে আনসারের চাকরি করে। আর কিছুদিন পরেই ওদের বিয়ে। সেই কারণে ইদানীং তাদের ঘোরাঘুরিও বেড়েছে। বজলুর সঙ্গে রুপালির পরিচয় আছে। দেখলেই সালাম দিয়ে হাসিমুখে কথা বলে। ভালো-মন্দ জানতে চায়।

 

বহুদিন পর আজ একা রয়েছে রুপালি। অন্য ছুটির দিনগুলোতে মলিনা, ময়না, টিয়া ও রেবেকার সাথে আড্ডা দেয়া হয়। কিন্তু আজ ময়না, টিয়া ও মলিনা ঘরে নেই। রেবেকা গত সপ্তাহে চাকরি ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে গিয়েছে। ছুটির দিনে খুব একটা বাইরে বের হতো না রেবেকা।

 

ফলে এই দিনগুলোতে তার সঙ্গেই বেশি সময় কাটত রুপালির। খুব ভালো মেয়ে রেবেকা। তার মনটা অনেক ভালো। রুপালির কাছে সে জীবনের অনেক কিছু শেয়ার করেছে। অনেক গল্প করছে। রেবেকাকে খুব মনে পড়ে রুপালির। ভাবে, তাকে একটা ফোন করবে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ চলে যায়। অন্যদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে গেছে। ফলে সারা বস্তি অন্ধকার।

 

বিদ্যুৎ না থাকলে বস্তিতে গরমটা একটু বেশি। যেখানে গাদাগাদি করে অনেক মানুষের বাস, সেখানে গরম বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক। সেজন্য বিদ্যুৎ না থাকলে বস্তির ছেলে-মেয়েরা অনেকেই পাশের মাঠে চলে যায়। সেখানে গল্প আড্ডা জমায়। বিদ্যুৎ এলে আবার ঘরে ফিরে আসে।

 

রুপালি ওদের থেকে আলাদা। এখানে থেকেও কিছু বিষয়ে নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা করে রাখতে চায়। বিদ্যুৎ গেলে সে মাঠে যায় না। ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে থাকে। আজও বিদ্যুৎ যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধ করে দেয় রুপালি। রেবেকাকে কল করার কথা ভুলে যায়।

 

খাটের ওপর গিয়ে জানলার পাশে বসে রুপালি। বাড়ির কথা মনে পড়ে। এই সময়ে কখনও বিদ্যুৎ চলে গেলে তারা পুকুরঘাটে চলে যেত। বুজি, সীমান্ত, কবির ভাই, বানু সবাই মিলে আড্ডা চলত। বুজি এখন কেমন আছেন, কে জানে। ভালো আছেন তো! নিশ্চয়ই ভালো থাকবেন। বয়স হলেও বুজির তো তেমন রোগ-বালাই নেই। আবার ভাবে বয়স্ক মানুষ। কখন কী হয়, বলা মুশকিল। এই পৃথিবীতে যিনি তাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন, তিনি হচ্ছেন বুজি। বুজিই তার জন্য সবচেয়ে বেশি ভাবেন। চিন্তা করেন।

 

সে চলে আসার পর বুজি নিশ্চয়ই অনেক দিন ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করেননি। অনেক কষ্ট পেয়েছেন। তারপর হয়ত আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে গেছে। পৃথিবীটাই এমন। সবকিছু মানানসই। যাকে ছাড়া একটা দিনও ভাবা যায় না, একদিন তাকে ছাড়াও মানুষের অনন্তকাল বাঁচতে হয়।

 

সব ধরনের টানটান অনুভূতি একদিন বিলিন হয়ে যায়। সে নিজে যখন বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিল, তখন তারও এমন হয়েছিল। এখন অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এটা না হলে মানুষ হয় পাগল হয়ে যেত, না হয় মারা যেত। সবকিছু স্বাভাবিক করে দেয়া সৃষ্টির এক অদ্ভূত রহস্য।

 

ছোট ভাই সীমান্তকে কত্তদিন দেখে না রুপালি। ভাইটার জন্য প্রায় তার মন কেমন করে। খুব কান্না পায়। কখনও মনে হয়নি সীমান্ত তার আপন ভাই নয়। সীমান্তও কখনও তেমনটি ভাবেনি। ভাই-বোন যেন হরিহর আত্মা। ছোটবেলা সীমান্ত প্রায় বলত, বুবু তোমাকে কিন্তু কখনও বিয়ে দেব না। বিয়ে দিলে মেয়েদের পরের বাড়ি গিয়ে থাকতে হয়। সেটা কিছুতেই হতে দিব না। সীমান্তর এই পাগলামি দেখে সবাই হাসত।

 

রুপালি নিজেও ভাবত সময়ের সাথে সাথে সীমান্তর এই ভাবনাগুলোও বদলে যাবে। কিন্তু বদলায়নি। যখন সে বুঝতে শিখেছে তখন তার ভাবনা অন্য রকম। বুবু তোকে বিয়ে দেব ঠিকই কিন্তু ওই ছেলেকে ঘরজামাই থাকতে হবে। এই শর্তে কেউ রাজি না হলে তোর কোনো দিন বিয়ে হবে না। তার কথা শুনে হাসত রুপালি। ভাইয়ের পাগলামিটা খুব উপভোগ করত।

 

রুপালি রাহাতকে ভালোবাসে বাড়িতে যখন এই কথাটা জানাজানি হয় তখন সারা বাড়ির লোক একদিকে আর সীমান্ত একদিকে। আজগর চেয়ারম্যান কিছুতেই রাহাতের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবেন না। তার স্ত্রীরও এক কথা। রুপালিকে রাহাতের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে কৃত্তিখাড়া করবেন না। তবে রাজি ছিল তার বুজি মরিয়ম বেগম। তার কথা ‘আমার রুপার যেখানে সুখ’ আমারও সেখানে সুখ।

 

তবে সবচেয়ে খুশি হয়েছিল সীমান্ত। তার খুশির কারণ রাহাত ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে হলে বুবুর স্বামীকে ঘরজামাই না থাকলেও চলবে। তাছাড়া সীমান্তর চোখে রাহাত তাদের গ্রামের সবচেয়ে ভালো ছেলে। যেদিন রাহাত খুন হয়, সেদিন সীমান্তর কী কান্না। অথচ আজগর চেয়ারম্যানের লোকের হাতে খুন হয় রাহাত। দুই পক্ষের লড়াইয়ের বলি হয় সে। সেদিন সীমান্তর কান্না দেখে সবাই হতবাক হয়ে গিয়েছিল।

 

কারণে-অকারণেই ভাইয়ের কথা মনে পড়ে রুপালির। তার মুখটা দেখতে ইচ্ছে হয়। একটু অগোছালো স্বভাবের সীমান্ত। তাকে রুপালিই দেখে রাখত। সেই ভাইটাকে কতদিন ছুয়ে দেখে না ভাবতেই রুপালির চোখে পানি জমে ওঠে। সে জানে তার ভাইটাও তাকে এভাবেই অনুভব করে। আসলে ভাই-বোনের সম্পর্কটাই এমন। একেবারেই অন্যরকম। এর কোনো সংজ্ঞা হয় না।

 

রুপালি যখন এসব ভাবনায় মগ্ন তখন হঠাৎ করেই দরজা খুলে যায়। কেউ একজন বাইরে থেকে দরজা খুলে ফেলেছে। কিছু বুঝে উঠার আগেই তার সামনে দাঁড়ায় দুই যুবক। রুপালির বুঝতে সময় লাগে না সে বিপদে পড়েছে। অন্ধকারের মধ্যেই সম্রাট আর রয়েলকে চিনতে পারে।

 

রুপালি কিছু বলার আগেই সম্রাট বলে চিৎকার করবি না। চিৎকার করলে তোর প্রাণও চলে যেতে পারে। আর এই বস্তিতে কেউ নেই, যে তোকে বাঁচাতে আসবে। এটা দেখিছিস, এক্কবারে ঢুকাইয়া দেবো। দেশলাই জ্বালিয়ে চাকু দেখায় সম্রাট। তার হাতের চাকুটা বেশ বড়। আলো পড়ে চকচক করছে।

 

রুপালি কী করবে, বুঝতে পারছে না। তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। সাহস সঞ্চার করার চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতে শক্তি পাচ্ছে না।

 

সম্রাট আরও কাছে এগিয়ে আসে। বলে, শোন সাফ সাফ কথা কই। আমরা তোর সাথে একটু ফূর্তি করব। একঘণ্টা দুঘণ্টা যতটুকু সময় লাগে। ফূর্তি করে চলে যাবো, কেউ কিছু জানতে পারবে না। মনে কর, স্বামী স্ত্রীকে যেমন আদর করে সেইভাবে তোকেও আমরা দুজন আদর করব। কোনো ক্ষতি করব না। আর যদি রাজি না হস, তাহলে ফূর্তির নামে যা হবে তার নাম ধর্ষণ। আমরা তোর ক্ষতি করতে চাই না।

 

এবার কিছুটা শক্তির সঞ্চার হয় রুপালি। সে বলে, প্লিজ তোমরা আমার কোনো ক্ষতি করো না। তোমরা আমার ভাইয়ের মতো।

 

ভাইয়ের মতো, ভাই তো আর নয়। শোন সবাই যদি বোন হয় তাহলে ফূর্তি করুম কার সাথে। শখ মেটাবো কোথায়! কথাগুলো বলতে বলতে রয়েলও তার কাছে এগিয়ে আসে। দেশলাই নিভিয়ে মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে দেয়।

 

আবারও বাঁচার চেষ্টা করে রুপালি। সে বুঝতে পারে এদের সাথে জোর খাটিয়ে কিংবা চালাকি করে কোনো লাভ হবে না। তবুও শেষ চেষ্টা করে। তোমরা আমার ক্ষতি করো না ভাই। বাড়িতে আমারও একটা ভাই আছে। আমি তোমাদের তার মতো মনে করি। তোমাদেরও নিশ্চয়ই আমার মতো কোনো বোন রয়েছে। দয়া করে আমার সর্বনাশটা করো না। তোমাদের বোন যদি কখনও এমন বিপদে পড়ে, তোমাদের কেমন লাগবে বল?

 

কথায় মন গলে না সম্রাটের। সর্বনাশ ভাবোস কেন। আমরাও মজা লমু, তুইও মজা পাবি। রাজি হয়ে যা। আর রাজি না হইলে মজা তো পাবি না উল্টে যন্ত্রণা ভোগ করবি। আমরা কিন্তু মজা ঠিকই লমু। রসের হাঁড়ি সামনে থাকবে অথচ রস খাব না এতটা বোকা আমরা না।

 

বিশ্রী এই কথাগুলো কানে বাজতে থাকে রুপালির। এর মধ্যেই তাকে জাপটে ধরেছে স¤্রাট। তার গায়ে কোনো পোশাক নেই। রুপালি ভাবে, সে সম্ভবত মরে যাচ্ছে। এটাই তার জীবনে ঘটে যাওয়া শেষ ঘটনা। এর পর আর কিছু নেই।

 

রাত দশটার দিকে বস্তিতে ফিরে আসে মলিনারা। ঘরে ঢুকে দেখে রুপালি মেঝোতে পড়ে আছে। তার পোশাক এলোমেলো। তারা চমকে যায়। কী হলো রুপালির! মলিনা রুপালির কপালে হাত রাখে। জ¦রে গাঁ পুড়ে যাচ্ছে। ঘটনা কী ঘটেছে অনুমান করতে সময় লাগে না। ঘটনাটা কারা ঘটিয়েছে, তাও বুঝতে পারে।

 

ময়না, টিয়া ও মলিনার সেবায় ঘণ্টাখানেক পর জ্ঞান ফেরে রুপালির। ওদের সামনে মুখ দেখাতে লজ্জা করছে। বারবার ভাবছে, কেন মরে গেলো না সে। স্বাভাবিক হতে আরও ঘণ্টাখানেক সময় নেয় রুপালি। কিছুক্ষণ আগে তার মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু এখন তার উল্টো। তাকে ভেঙে পড়লে চলবে না। ঠিক করে আইনের আশ্রয় নিবে। হয়তো এতে কোনো কাজ হবে না কিন্তু তারপরও পদক্ষেপ নিতে হবে। ওদের ছেড়ে দেওয়া মানে প্রশ্রয় দেয়া। সেটা হতে দেয়া যাবে না। এতক্ষণ পর কথা বলে রুপালি।মলিনা আমার সাথে থানায় যেতে পারবে?

 

সে না হয় গেলাম, কিন্তু থানায় গিয়ে কী হবে। আমরা তো বিচার পাবো না।

 

আগে থেকে কেমন করে শিওর হলে বিচার হবে না?

 

রুপালি আমরা বহুদিন থেকে এই বস্তিতে আছি। আর কারা তোমার এই অবস্থা করেছে, সেটাও বুঝতে বাকি নেই। ওদের নামে থানায় অনেক অভিযোগ। ওদের আজকে পুলিশে নিয়ে যায় তো কাল আবার দিয়েও যায়। অভিযোগ করে কী হবে?আমি তবুও যাবো।

 

মলিনা বলে, তাহলে এক কাজ করি। এত রাতে আমরা রাস্তায় বের হলে বিপদ হতে পারে। বরং বজলুকে একটা ফোন করে দেখা যায়। ও আমাদের সাথে যাবে।

 

কথাটা মনে ধরে ময়নার। মলিনার জন্য অপেক্ষা না করে নিজেই বজলুকে ফোন দেয়।

 

নয়

ডিউটি অফিসার আনিসুর রহমান সিগারেট টানছেন। এত রাতে সাধারণত কেউ থানায় আসেন না। তাই পরিবেশটা পারিবারিক হয়ে যায়। যারা ডিউটিতে থাকেন তারা কেউ গান শুনে কেউ তাস খেলে সময় পার করেন। আনিসুর রহমান এসবের মধ্যে নেই। তিনি সুযোগ পেলেই গুনগুন করেন আর সিগারেট টানেন। আজও তাই করছেন। পায়ের ওপর পা তুলে সুখটান দিচ্ছেন। ইদানীং তার সিগারেট খাওয়ার মাত্রাটা বেড়েছে। এর একটা বিশেষ কারণ আছে।

 

বউয়ের সঙ্গে ঝামেলা চলছে অফিসারের। তিনি বুঝতে পারছেন বউটা পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েছেন। পরকীয়া চলছে তার একমাত্র ছেলে সংকেতের গৃহ শিক্ষকের সঙ্গে। সংকেত এবার ক্লাস ফোরে পড়ছে। তার শিক্ষকের নাম জাহিদ হোসেন। সে বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্র। এবছর লেখা-পড়া শেষ হয়ে যাবে। জাহিদ ছাত্র ভালো কিন্তু দেখতে সুশ্রী নয়। কালো বেটে হালকা-পাতলা গড়নের এক যুবক। এই যুবকের মধ্যে তার স্ত্রী এমন কী দেখেছে, ভেবে পান না আনিসুর রহমান।

 

এখনও যদি আনিস সাহেব ও জাহিদকে দাঁড় করানো হয় সবাই আনিসুর রহমানকেই বেঁছে নেবেন। আনিসুর রহমানের প্রেমের বিয়ে। একসময় স্ত্রী তার জন্য পাগল ছিল। কিন্তু হঠাৎ কী হলো, মেলাতে পারেন না এই পুলিশকর্তা। তিনি মাঝে মাঝেই ভাবেন, নারীর মন বোঝে এমন সাধ্য কার। আনিসুর রহমান স্ত্রীকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু হয়নি। শেষ পর্যন্ত সংসারটা ভেঙে দেবেন কি না, তা নিয়ে নিজের সঙ্গে নিজে লড়াই করছেন। প্রতিদিন তিনি কত রকমের কেস দেখেন।

 

কত্ত ঘটনা শোনেন, তার ঠিক নেই। কিন্তু তার নিজের জীবনে যে কেস, তার খবর কেউ রাখেন না। এসব ভাবতে ভাবতে সিগারেটে শেষ টানটা দেন আনিসুর রহমান। চেয়ার ছেড়ে ওঠেন। এর মধ্যে তার রুমে পাঁচজন লোক প্রবেশ করে। তাদের একজন পুরুষ।

 

রাত বারোটার সময় চারজন মেয়েকে থানায় দেখে ঘটনা কী ঘটেছে, অনুমান করতে সময় লাগে না অফিসারের। তিনি বলেন, আপনারা বসুন, আসছি।

 

রুপালিরা বসে। আনিসুর রহমান চোখে মুখে পানির ছিটা দিয়ে চেয়ারে আসেন। বজলুকে উদ্দেশ্য করে বলেন, জি বলুন কী ঘটনা?আমি বলছি অফিসার। বলে রুপালি।

 

ওকে। বলুন, কী হেল্প করতে পারি?আমি একটা মামলা করতে চাই অফিসার।

 

কী বিষয়ে বলুন তো? তার আগে বলুন, আপনার নাম কী, থাকেন কোথায়?আমার নাম রুপালি আক্তার। খালেকের বস্তিতে থাকি।

 

খালেকের বস্তি! আপনারা সম্রাটের রিরুদ্ধে অভিযোগ করতে আসেননি তো?

 

জি অফিসার, আপনি ঠিকই ধরেছেন। আমি সম্রাটের আর রয়েলের নামে কেস করতে চাই।

 

ওদের নামে তো থানায় বিশ-ত্রিশটা কেস আছে। চুরি, ছিনতাই, মাদক, ইয়াবা, প্রতারণা, ধর্ষণ বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু ওদের তো থানায় এনে রাখা যায় না। মামাবাড়ি বেড়ানোর মতো বেড়িয়ে চলে যায়। ওদের হাত অনেক লম্বা। আপনাদের কেসটা কী?ধর্ষণ। আমি ওদের শাস্তি চাই। বলে রুপালি।ভিকটিম কী আপনি?

 

জি?ঘটনা কখনের?আজকের। সন্ধ্যা সাতটার দিকে।

 

ওরা দুইজনই ছিল?হ্যাঁ, ওরা দুইজনই ছিল।

 

কী করেন আপনি?গার্মেন্টসে চাকরি করি।

 

সাথের এনাদের সাথে আপনার সম্পর্ক?ওরা আমার কাছের মানুষ।

 

ও আচ্ছা। আপনারা দয়া করে বাইরে যাবেন। ওনার সঙ্গে আলাদা কথা বলতে চাই।অফিসারের কথা শুনে বজলুসহ অন্য সবাই বাইরে চলে যায়। ওরা চলে যাওয়াতে ভয় পায় রুপালি। অফিসার তাকে কী বলবেন, ভাবতে থাকে। সে শুনেছে এইসব, অফিসাররা অনেকেই অন্য টাইপের হয়। খুটিয়ে খুটিয়ে ধর্ষণের বর্ণনা শুনতে চান। যেটা দরকার না, সেটাও। এ সবের আবার ভিডিও করে রাখেন। তাছাড়া এসব ঘটনায় টাকা পয়সা লেনদেনের অভিযোগও শোনা যায় অহরহ। কিছু পুলিশের কাছে যৌনতাও নাকি ঘুস!

 

রুপালির নীরবতা দেখে আনিসুর রহমান বলেন, কি ভয় পাচ্ছেন?না না, ভয় পাবো কেন? কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর দেয় রুপালি।

 

ওকে, ভয় পাননি তাহলে। আপনাকে একটা কথা বলব। পুলিশ অফিসার হিসেবে নয়। মনে করুন আপনার বড় ভাই, বন্ধু কিংবা বাড়ির লোক হিসেবে বলছি।রুপালির সাহস হয়। অফিসারকে যেমন ভেবেছিল মনে হচ্ছে তেমন নয়। সে বলে ঠিক আছে বলুন।

 

দেখুন, যদি ওদের নামে কেস করেন তাহলে কিছু ঝামেলার মধ্যে দিয়ে আপনাকে যেতে হবে। এই ধরেন মেডিকেল টেস্ট, মিডিয়া এসব। পত্রপত্রিকায় এই নিয়ে নিউজ বের হবে। সেটা হয়তো আপনার জন্য ভালো নাও হতে পারে। না মানে আমাদের সমাজের কথা ভেবে বলছি। এসব কি আপনি সামলাতে পারবেন? তাছাড়া আপনার তো একটা স্বাভাবিক জীবন আছে। বিয়ে-শাদি করবেন, সামনে তো পুরো জীবনটা পড়েই আছে।

 

আপনার কথা ঠিক অফিসার কিন্তু আমি ওদের শাস্তি চাই। সব ভেবেই আপনার কাছে এসেছি। আজ যদি ওদের শাস্তি না হয় ভবিষ্যতে এই কাজটা করতে ওরা দুইবার ভাববে না। আপনি আপনার মতো করে ব্যবস্থা করুন, প্লিজ।রুপালির কথা শুনে আনিসুর রহমান কিছুক্ষণ নীরব থাকেন। পরে সহকারিকে ডেকে সব ব্যবস্থা করতে বলেন।

 

মনে মনে অফিসারকে ধন্যবাদ জানায় রুপালি। সত্যিই লোকটা অনেক ভালো। আসলে সব অফিসার তো এক রকম নয়। সব ডিপার্টমেন্টে যেমন খারাপ লোক রয়েছে তেমনি আনিসুর রহমানের মতো সৎ মানুষও রয়েছেন। তাই একজনকে দিয়ে অন্যজনকে মাপা ঠিক নয়।সম্রাটের ও রয়েলের কোনো ভাবনা নেই। তারা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। গতরাতের ঘটনা নিয়েও কোনো অনুশোচনা নেই। বরং কাজটা করতে পেরে নিজেদের হিরো হিরো লাগছে। অবশেষে হিরামন পাখিটাকে খাঁচায় বন্দি করা গেছে।

 

এই বস্তিতে তারা আগেও এমন বহু ঘটনা ঘটিয়েছে। কাউকে ফাঁদে ফেলে কাউকে বা তুলে নিয়ে ধর্ষণ করেছে তারা। এসব ধর্ষণের বেশিরভাগ ভিডিও তাদের মোবাইলে রয়েছে। এটা দেখিয়ে বøাকমেইল করে দিনের পর দিন মেয়েগুলোকে ধর্ষণ করে আসছে।

 

এই নিয়ে তেমন কিছু হয়নি। বস্তির কারও সেই সাহস নেই। থানায় তাদের নামে যে ধর্ষণ মামলা রয়েছে, সেগুলো বস্তির বাইরের। সুতরাং রুপালিও মুখ খুলবে না, এটা নিশ্চিত। কিন্তু তাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। পরের দিন রাতেই পুলিশ এসে কোমরে দড়ি বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে যায় সম্রাটের ও রয়েলকে। বস্তির কেউই বিষয়টিতে গুরুত্ব দেননি। কারণ, এটা নতুন কোনো ঘটনা নয়। দুই-একদিনের মধ্যে তারা আবারও বস্তিতে এসে হাজির হবে। বস্তির লোকের চিন্তা রুপালিকে নিয়ে। এই মেয়ের সাহস তো কম নয়।

 

ওরা বেরিয়ে এসে তো তাকে গিলে খেয়ে ফেলবে। কিন্তু রুপালি ভয় পাচ্ছে না। যা হবার হবে। যে দিন সে বকুলগঞ্জ থেকে পালিয়ে এসেছে, সেদিনই তো মরে গেছে। আবার নতুন করে মরার কী ভয়। যা হবার হবে।

 

পরের দিন খুব সকালে বজলু এসে হাজির। বস্তিবাসী এখনো জেগে ওঠেনি। বজলুর হাতে সংবাদপত্র। তাকে দেখে রুপালির প্রশ্নকী ব্যাপার বজলু ভাই, এত সকালে কী মনে করে?

 

আপা উচিত বিচার হয়েছে।কী বিচার, বজলু ভাই?

 

সম্রাটের আর রয়েল ক্রস ফায়ারে মারা পড়েছে।বলেন কী!ঘটনা সত্যি। এই যে দেখেন, পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। রুপালি, মলিনা, ময়না, টিয়া সবাই অবাক হয়। তারা ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।

 

বজলু চলে যাওয়ার পর পত্রিকার পাতায় চোখ বুলায় রুপালি। প্রথম পাতার দ্বিতীয় কলামে সম্রাট-রয়েলের খবর ছেপেছে। খবরের শিরোনাম - ‘খালেকের বস্তির দুই শীর্ষসন্ত্রাসী ক্রসফায়ারে নিহত’।

 

অবশেষে ক্রসফায়রে নিহত হয়েছে ঢাকার খালেকের বস্তির শীর্ষ দুই সন্ত্রাসী সম্রাট ও রয়েল। গত সোমবার রাতে তাদের খালেকের বস্তি থেকে গ্রেপ্ততার করা হয়। নিহতদের বয়স ২৪/২৫ বছরের মধ্যে। তাদের নামে থানায় প্রায় ত্রিশটি মামলা রয়েছে।

 

দীর্ঘদিন থেকে তারা বস্তিতে মাদকদ্রব্য কেনা-বেচা, নারী পাচারসহ বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করে আসছিল। এছাড়া তাদের নামে খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, প্রতারণাসহ নানান ধরনের মামলা ছিল।

 

গ্রেপ্তারের পর তাদের যখন থানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন মাঝপথ থেকে তাদের ছিনিয়ে নিতে পুলিশের ওপর গুলি চালায় সম্রাটের বাহিনী। পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। এতে ঘটনাস্থলেই মারা পড়ে এই দুই বস্তির ত্রাস। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সম্রাটের লাশ কেউ নিতে আসেনি। এসেছিলেন অন্য সন্ত্রাসী রয়েলের মা। তবে তিনি ছেলের মৃতদেহ নিতে রাজি হননি। আলাপকালে তিনি বলেন, ওর বাবা মারা যায় ওর অনেক ছোট্টকালে। হেরে আমি অনেক কষ্ট কইরা বড় করেছি। মানুষের বাসায় কাম করছি। হেরে কইছি ভালা মানুষ হইতে, লেখাপড়া শিখতে, হে আমার কথা শুনি নাই। অমানুষ মইরা গেছে ভালা হইছে। এতে মানুষগুলো শান্তিতে থাকপার পারবে।

 

পত্রিকা পড়া শেষে কিছুক্ষণ মলিনার দিকে তাকিয়ে থাকে রুপালি। তারপর বলে এটা কী হলো মলিনা?কী আর হবে, ঠিক কাজ হয়েছে। এখন সবাই শান্তি পাবে। পুরো বস্তিটারে ওরা জ¦ালিয়ে শেষ করে দিচ্ছিল।

 

আমি এটা মানতে পারছি না মলিনা। আমি তো ওদের মৃত্যু চাইনি শাস্তি চেয়েছিলাম।এবার কথা বলে ময়না। এসব নিয়ে কেন ভাবছো রুপালি, ওদের নামে থানায় হাজারো অভিযোগ। কোথা থেকে কী হয়েছে, আমরা কেউ জানি না।

 

কিন্তু ওদের তো গ্রেপ্তার করেছিল আমার মামলায়। সেজন্য খারাপ লাগছে।শোনো, পুলিশ তো ওদের নিয়ে যাচ্ছিল। সমস্যা করেছে ওদের বাহিনী। তারা কেন পুলিশের ওপর গুলি চালাতে গেল। তারা গুলি চালিয়েছে বলেই তো আত্মরক্ষায় পুলিশও গুলি চালিয়েছে। আপদ মরেছে সেই ভালো। এবার বস্তিতে শান্তির বৃষ্টি নামবে।

 

কিছু সময়ের মধ্যে সম্রাটে আর রয়েলের মৃত্যুর খবর রাষ্ট্র হয়ে যায়। সবাই বিষয়টা জেনে গেছে। সবাই খুশি। রিকশাচালক আক্কাস উদ্দীন মিষ্টি নিয়ে এসেছেন। তিনি সবাইকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন। তার মনে বহুদিনের ক্ষোভ। কারণ সম্রাটে ও রয়েল একবার তার মেয়েকে তুলে নিয়ে এক সপ্তাহ পরে ফেরত দিয়ে গিয়েছিল। গরিব মানুষ, ভয়ে কিছু বলতে পারেননি। শুধু আক্কাস উদ্দীন নয়, বস্তির অনেকেই তাদের শিকার।

 

কেউ বলছেন কেউ বলছেন না। তবে সবাই যে খুশি, তা বোঝা যাচ্ছে। বহুদিন পর যেন খালেকের বস্তিতে শান্তি নেমে এসেছে। নিরীহ মানুষ গুলো এত দিন ধরে যেন এই দিনের অপেক্ষায় ছিলেন। বস্তির মানুষ সবাই রুপালিকে বাহবা দিচ্ছেন। নিরীহ মানুষগুলোর হাসিমুখ দেখে শান্তি পাচ্ছে রুপালিও।

 

কিন্তু অন্য চিন্তাও হচ্ছে তার। সবচেয়ে বড় চিন্তা, এখানে থাকা তার জন্য কতটা নিরাপদ হবে। মলিনা, ময়না, টিয়া ওরাই বা কতটা নিরাপত্তা পাবে। রুপালি তাদের কোনো বিপদে ফেলে দিলো না তো।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version