-->

বাঁধন কেটে যা

জোবায়ের রাজু
বাঁধন কেটে যা

গানের প্রতিযোগিতায় উইনার হওয়ার মধ্য দিয়ে তানিয়ার জীবন রাতারাতি বদলে গেছে বটে, তবে সংসারে অশান্তির সূত্রপাত যেন সেখান থেকেই। স্বামী রুবেল ছাড়া শ্বশুরবাড়ির আর কেউ চায় না তানিয়া গায়িকা হিসেবে মিডিয়া ভুবনের একজন হয়ে উঠুক।

 

শ্বশুর, শাশুড়ি, দেবর ও ননদ কেউ চায় না তানিয়া গানটাকে জীবনের সাথে জড়িয়ে নিয়ে শিল্পী হোক। শাশুড়ির মন্তব্য- ঘরের বউ ঘরে হাঁড়িপাতিল ধুবে, শিল্পী হবে কেন? শ্বশুর বলে গেলেন- আমার রক্ষণশীল পরিবারে কেউ গান গেয়ে পুরো গোষ্ঠী নরকে নেবে, এ আমি সহ্য করব না।

 

তানিয়া সবার মন্তব্য নিরবে শুনে গেছে। দেশের মানুষ যেহেতু তার কণ্ঠ এখন চিনে গেছে, অতএব সেখান থেকে আর ফিরে আসার কোনো পথ নেই। লাখো মানুষের ভালোবাসার প্রমাণ হিসেবে সে প্রতিটি রাউন্ডে অবিশ্বাস্য ভোট পেয়ে উইনার হয়েছে।

 

সংগীতবোদ্ধারা তাকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে। বিভিন্ন কোম্পানির বড় বড় ফাংশনে গাইবার ডাক আসছে। জীবনের এই সেরা অর্জনগুলোকে তো আর হেলাফেলা করতে পারবে না তানিয়া। তাছাড়া ছোটবেলা থেকে সে স্বপ্ন দেখেছে গায়িকা হবার। দীর্ঘদিনের সাধনায় তৈরি করেছে গানের গলা। প্রতিযোগীতায় গিয়ে কেড়ে নিয়েছে স্রোতাদের নজর। এখন তীরে এসে তরি ডুবানোর কোনো মানে হয় না। সুরের জগৎ তাকে হাতছানি দিয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছে।

 

অতএব তানিয়া নিজেকে গায়িকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবেই। শ্বশুরালয়ের সবাই যখন ফাইনালি জেনে গেল তানিয়া গানের ভুবন থেকে ফিরবে না, তখনই সবাই কঠোর হতে থাকে। রুবেল স্ত্রীকে মনোবল দেয়। ছেলে স্ত্রীর তালে তাল মেলাচ্ছে দেখে রুবেলের বাবা-মা প্রতিবাদী হয়ে উঠে। তারা সাফ জানিয়ে দেন হয় বউকে গান ছাড়তে হবে, নয়তো এ বাড়ি ছেড়ে বউ নিয়ে চলে যেতে হবে।

 

বাবা মায়ের হুকুমের কাছে নিরুপায় ছিল রুবেল ও তানিয়া। ফলে তানিয়াকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে শহরে চলে আসে রুবেল। দুর্দিন খুব একটা দীর্ঘায়িত হয়নি দুজনের। তানিয়া টিভিতে কয়েকটি সংগীতানুষ্ঠান করে আর্থিকভাবে সচ্ছল হতে থাকে। সুকণ্ঠী তানিয়াকে একে একে একাধিক গানের সুযোগ করে দেন মিউজিক ডিরেক্টররা। ফলে অল্পদিনে সে গানের ভুবনে নিজের একটি শক্ত জায়গা তৈরি করে নেয়।

 

অতি সাধারণ বাসা ছেড়ে নিজের কেনা ফ্ল্যাটে উঠে আসে তানিয়া। এই পথচলায় অনুপ্রেরণাকারী হিসেবে রুবেলকে সবসময় পাশে পায় সে। স্ত্রীর এমন পপুলারিটি রুবেলকে বেশ স্বস্তি দিতে থাকে। দিন দিন দেশ বিদেশে গমন করে দুজন। দেশের বড় বড় কোম্পানির কনফারেন্স প্রোগ্রামে তানিয়া তার সুরেলা গলায় সবাইকে মত্ত করে রাখে। বিনিময়ে পায় লাখ লাখ টাকা। ততদিনে শহরে আলিশান বাড়ি গড়ে তোলে তানিয়া। আর গাড়িতো কিনেছে অনেক আগেই। রাতারাতি বদলে যেতে থাকে তানিয়ার জীবনগতি।

 

একটা সময়ে এসে রুবেল টের পেতে থাকে তানিয়া তাকে এভোয়েড করে চলছে। রাতারাতি তারকাখ্যাতি তাকে কিছুটা অহংকারী করে তুলছে। কথাবার্তায়ও একধরনের বড়াই লক্ষ্য করা যায়। রুবেল সবকিছু বুঝেও না বোঝার ভান করে। আগে তানিয়া যে কোনো জায়গায় যেতে সফরসঙ্গী হিসেবে রুবেলকে পাশে রাখলেও দিন দিন সেটারও পরিবর্তন হতে থাকে। রাতদুপুরে একা একা রেকর্ডিং স্টুডিও থেকে ফিরে তানিয়া। স্ত্রীর এই পরিবর্তনের আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারে না রুবেল।

 

তারপর একদিন পত্রিকার মাধ্যমে আসল খবরটি প্রথম জানতে পারে রুবেল। দেশের বিখ্যাত সুরকার জিসানের সাথে প্রেম তানিয়ার। মাথা ঘুরে উঠে রুবেলের। পত্রিকাতে ভুল নিউজ ছাপেনি তো! এই ব্যাপারে রুবেল সরাসরি প্রশ্ন করে তানিয়াকে। কিন্তু তানিয়া সঠিক জবাব না দিয়ে প্রসঙ্গ বদলে ফেলে।

 

২.

গভীর রাত। তানিয়া এখনো বাসায় ফেরেনি। রুবেল চিন্তিত। কারণ অনেকবার কল করেও তানিয়ার নাম্বারে সংযোগ পাচ্ছে না। হঠাৎ বালিশের পাশে একখানা চিঠি পায় রুবেল।

 

তানিয়া লিখেছে, ‘আমাকে মাফ করে দিও। আমার গানের জন্য তুমি তোমার পরিবার ত্যাগ করে আমাকে শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছ। সেটা কখনো যেমন অস্বীকার করতে পারব না, তেমনই অস্বীকার করতে পারব না সুরকার জিসানের সাথে আমার সম্পর্কের কথাও।

 

আজ আমি জিসানের কাছে চলে গেলাম। তোমার কাছে আর ফিরব না রুবেল। বাস্তবতা মেনে নিতে শেখো। আমার আয়ে কেনা যে বাড়িতে এখন আছো তুমি, সেটি তোমাকে দিয়ে দিলাম। নতুন সাথী খুঁজে নিও। কখনো টাকার দরকার হলে আমাকে জানাইও।

 

জিসানকে বিয়ে করে নতুন সংসার সাজাতে চলে গেলাম তোমার জীবন থেকে। ভালো থেকো।’ তানিয়ার চিঠি পড়ে রুবেলের পায়ের তলার মাটি যেন সরে গেল। এমন অঘটনের জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। কি হবে এখন! তানিয়াকে গানের ভুবনে প্রতিষ্ঠিত করতে রুবেল তার বাবা মাকে মূল্যায়ন না করে তাদেরকে ত্যাগ করেছে, অথচ আজ তানিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়ে তাকেই ত্যাগ করেছে। এই ঘটনা মেনে নেয়া যায় না। সুরের পাখি তানিয়া রুবেলের ভালোবাসার বাঁধন কেটে চলে গেছে আরেক আকাশে। রুবেলের গলা ফাটানো চিৎকার আসছে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version