-->

সাধের জনম

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ
সাধের জনম

সাধের জনম

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ

 

পাঁচ.বকুলগঞ্জ অনেকটা শান্ত। পুলিশের কার্যক্রম দেখে সকলে হতবাক। অল্প সময়ের মধ্যে আসামিদের সবাইকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছেন তারা। এর আগে গ্রামে কখনও এমন দেখা যায়নি। পুলিশ ঘটনাস্থলে আসার আগেই আসামিরা খবর পেয়ে গেছে। ফলে যে যার মতো করে চম্পট দিতে পেরেছে। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম।

 

সব আসামিকে কোমরে দড়ি বেঁধে টানতে টানতে জেলে নিয়ে গেছে পুলিশ। এখন কাসেম মুন্সিদের রুই-কাতলা শ্রেণির কেউ বাইরে নেই। চেলারা যারা বাইরে আছে তারাও গা ঢাকা দিয়েছে। একপক্ষ নেই বলেই গ্রামটার এই অবস্থা। কোনো ঝুট-ঝামেলা নেই। এতে গ্রামের সাধারণ মানুষের মধ্যেও স্বস্তি নেমে এসেছে।

 

কারণ এই দুইপক্ষের কোন্দলের কারণে তারা শান্তিতে থাকতে পারে না। উল্টো তাদেরই বলির পাঁঠা হতে হয়। সাধারণ মানুষ থেকেই খুন-জখম হয় বেশি। এই গ্রামে কেউ নিজের ইচ্ছেমতো থাকবে তার উপাই নেই। কোনো না কোনো দল করতেই হবে। তা না হলে ওই পরিবারকে দুই দলেরই রোষানলে পড়তে হয়। এটা শুধু বকুলগঞ্জ গ্রামেই নয়, বাংলাদেশের সকল গ্রামের অবস্থাই এ রকম। বকুলগঞ্জ এসব গ্রামের প্রতিনিধি মাত্র।

 

আজগর চেয়ারম্যান খুব মজায় আছেন। প্রতিপক্ষ নেই। তিনি ফুরফুরে মেজাজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কাসেম মুন্সিকে জব্দ করতে পেরে তিনি এখন বিশ্ব কাপ বিজয়ী অধিনায়ক। চেলারা সারাদিন বাড়িতে পড়ে আছে। তারা ইচ্ছেমতো তোষামত করছে। সবার কথার সারমর্ম, চেয়ারম্যান সাহেব খুব ভালো কাজ করেছেন। উচিত শিক্ষা হয়েছে মুন্সিদের।

 

চেয়ারম্যান এখন শুধু অপেক্ষা করছেন মুন্সিদের লোক কবে তার কাছে নতি স্বীকার করতে আসবে। সে জানে, খুনের মামলা থেকে ছাড়া পেতে হলে আপোস-মীমাংসার বিকল্প নেই। উকিল-মোক্তার যতই ধরুক না কেন, আজ হোক বা দুদিন পরে হোক প্রতিপক্ষকে তার কাছে আসতেই হবে।

 

বানু এ বাড়িতে আছে। এখন অনেক স্বাভাবিক সে। কাজকর্ম শুরু করেছে। সে সবসময় সাজুগুজু করতে পছন্দ করে। স্বামীর মৃত্যুর পর দু চারদিন তা কমে ছিল। এখন আবার সাবেক অবস্থায় ফিরে গেছে। একটু একটু করে সাজগোজ বেড়েছে। বানুর বাড়ির লোক তাকে নিতে এসেছিল। কিন্তু যায়নি। তার সাফ কথা, এ বাড়িতে থাকবে। আজগর চেয়ারম্যান তার মা-বাবা। এ বাড়ি ছেড়ে সে কোথাও যাবে না। বিয়ে-শাদিও করবে না।

 

সীমান্ত বাড়িতে নেই। সকালে খাওয়ার পর কেউ তার দেখা পায়নি। গুলজান ভেবেছিলেন ছেলে হয়তো বাজারে গিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। এটা ভালো, ছেলে মানুষ সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকা ঠিক নয়। তাছাড়া সে চেয়ারম্যানের ছেলে, তার ঘরে বসে থাকা মানায় না। বাবার পর তাকেই ক্ষমতা নিতে হবে। তার তো এখন থেকেই জনসমর্থন দরকার। এমনিতেই ছেলেটা অন্য করম।

 

এক্কেবারে বাপ-দাদার মতো হয়নি। নিজের মতো থাকতে ভালোবাসে। কারও সাতেও নেই,পাঁচেও নেই। গুলজানের মতে ছেলেটা এমন হয়েছে রুপালির জন্য। এই মাগী তার মাথা খেয়েছে। এখন রুপালি নেই। ছেলেটাকে এখনই পথে আনার সুযোগ।

 

দুপুরের পর সীমান্তর খোঁজ পড়ে। খোঁজ নিলেন চেয়ার‌্যমান নিজে।

 

গুলজান সীমান্ত কোথায়? সকাল থেকে তাকে দেখছি না।

 

কী জানি। বাজারে আছে হয়তো।

 

সে এতক্ষণ বাজারে থাকা ছেলে নয়। তাছাড়া আমি কিছুক্ষণ আগে বাজার থেকে এলাম। তাকে কোথাও দেখিনি। অন্য কোথাও গেছে। তার মোবাইলও বন্ধ পাচ্ছি।অন্য আর কোথায় যাবে? গুলজান উত্তর দেন।

 

তোমাকে কিছু বলে যায়নি?

 

না, কখন বের হয়েছে সেটাও তো জানি না।

 

মাকে ডাকো, উনাকে বলে যেতে পারে। ছেলেটা হয়েছে বোন আর দাদি ঘেঁষা। মাঝে মাঝে মনে হয় ওই ছেলেটা কি আমার জন্মের।

 

মরিয়ম বেগমকে ডাকতে হয় না। তিনিই আজগর চেয়ারম্যানের ঘরের বারান্দায় আসেন। তাকে দেখে ঘর থেকে বের হয়ে আসেন আজগর।

 

মা, তোমার নাতি কোথায় জানো?

 

কার কথা বলছিস, সীমান্ত?

 

হ্যাঁ, তোমার তো আর দশটা নাতি নেই। সীমান্ত কিছু বলে গেছে তোমায়?

হ্যাঁ, সে তো তার বড় ফুফুর বাড়িতে গেছে।

 

মদিনা বুজির বাড়ি গেছে! হঠাৎ সে বাড়িতে কেন। তাছাড়া তাদের সাথে তো আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। জমিজমা যা ছিল, বিক্রি করে নিয়ে গেছে। ঝামেলা শেষ।বাবা রে তাগের ভাগেরটা তারা নিয়ে গেছে। তাছাড়া তাদের যা পাওনা, তারা তার চেয়ে অনেক কম নিছে। আর বাবার বাড়ির সম্পত্তি বুঝে নিলেই কি সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়, যায় না। সম্পর্ক এক জিনিস আর সম্পত্তি আরেক জিনিস। একটার সঙ্গে আর একটাকে মিলাতে নেই।

 

মায়ের সঙ্গে তর্ক করার ইচ্ছে হয় না চেয়ারম্যানের। অনুমান করতে পারেন সীমান্ত তার বুবুর খোঁজ নিতে গেছে। এই মুহূর্তে তার মেজাজটা চড়া। কিন্তু মাকে বুঝতে দিচ্ছেন না। শান্ত স্বরে মায়ের কাছে জানতে চান,কখন আসবে, কিছু বলে গেছে?

 

মদিনার বাড়ি থেকে বের হয়ে নাসিমার বাড়ি হয়ে আসবে। আমি বলেছি নাসিমাকে দেখে আসতে। আবার নাসিমার বাড়ি! আচ্ছা মা ও কীভাবে গেল সেখানে, বাইক তো বাড়িতে।

 

দাউদের ছেলের মোটরগাড়ি নিয়ে গেছে। বলেছে, সন্ধ্যার আগেই চলে আসবে। আর কিছু বলবি?না। আচ্ছা মা, একটা কথা বলব?বল, কী বলবি?

 

তুমি কি আমার ওপর কোনো কারণে রাগ?বাপ রে তোর ওপর আমি রাগ করব কেন। আমি তোকে পেটে ধরেছি। মা কখনও ছেলের ওপর রাগ করে না।

 

কিন্তু ইদানীং তুমি কেমন বদলে গেছো।বয়স হচ্ছে তো সেই জন্য হতে পারে। যা-ই হোক, এখন তোর সাথে কথা বলতে পারব না। আমার গোসলের সময় হয়ে গেছে, গোসলে যাবো। মরিয়ম বেগম পুকুরের দিকে চলে যায়।

 

সীমান্ত বাড়ি ফিরে সন্ধ্যার পর। দুই ফুফুর কোনো বাড়িতে রুপালি নেই। তাই মন খুব খারাপ। তাহলে কোথায় গেলো বুবু। ফিরে আসার ইচ্ছে থাকলে তো এতোদিনে ফিরে আসত। মামার বাড়িতে খোঁজ নেয়া হয়েছে, সেখানেও বুবু নেই।

 

রাতে খাবার টেবিলে চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা হয় সীমান্তর। সেখানে তার মাও রয়েছেন। মরিয়ম বেগম আগেই খেয়ে নিজের ঘরে চলে গেছেন। খেতে খেতে আজগর চেয়ারম্যান ছেলেকে প্রশ্ন করেন,তুমি নাকি তোমার ফুফুদের বাড়িতে গিয়েছিলে?হ্যাঁ। সীমান্ত উত্তর দেয়।

 

কেন গিয়েছিলে?বুবুকে খুঁজতে।খোঁজ পেলে?না।

 

তোমার ফুফুদের বাড়ি যাওয়া উচিত হয়নি।কেন?ছেলের পাল্টা প্রশ্ন শুনে অবাক হন আজগর চেয়ারম্যান। সে তো এভাবে কথা বলে না। তাহলে কি অন্য কোনো ঘটনা আছে। তিনি চেপে যান। ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন, তোমার ফুফুদের সাথে আমার সম্পর্ক ভালো নেই। আর আমার সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলে তো তোমার সঙ্গেও থাকে না, তাই না। তাছাড়া তুমি তো ফোনেও খোঁজ নিতে পারতে?

 

আমি যতটুকু জানি, আপনার কাছে ফুফুদের কারও মোবাইল নাম্বার নেই। আর আমার মোবাইল থেকে কিছুদিন আগে সব নাম্বার ডিলিট হয়ে গেছে। রুপালির ফোন থেকে নিতে, সে তো ফোন নিয়ে যায়নি।বুবুর ফোনটা লক করা।

 

সিম খুলে তোমার মোবাইলে নিয়ে নিতে, তাহলেই তো নাম্বার পাওয়া যেতো।আমার এত কিছু মাথায় ছিল না। তাছাড়া ফুফুদের খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল। আমি বুঝি না ফুফুদের বাড়ি গেলে সমস্যা কী। তারা তো এ বাড়িরই মেয়ে আমাদের আপনজন।

 

তুমি বাচ্চা মানুষ। এই বয়সে আবেগটা বেশি থাকে তাই বুঝতে পারছো না। শোনো তারা তোমার ভালো চায় না। ভালো চাইলে কি সব জমি বিক্রি করে নিত পারত, ভেবে দেখেছো একবার?

 

আব্বু, ফুফুরা আমাকে ভালোবাসে না এই কথাটা আমি মানতে পারি না। এই আজকে আমি গিয়েছি, বড় ফুফু আমাকে জড়িয়ে ধরে কী কান্না। যতক্ষণ ছিলাম ফুফু আমার পাশে বসে ছিলেন।

 

গুলজান এতক্ষণ বাবা-ছেলের কথা শুনছিলেন। এবার আর চুপ থাকতে পারলেন না। বললেন, তুই এসব বুঝবি কীভাবে মানুষের মাথা কী করে খেতে হয় তোর ফুফুরা তা ভালো করেই জানে। এই যে তোকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে না, সব অভিনয়। তোর চোখে আমাদের শত্রু বানাতে চায়।

 

ভুলভাল কথা কেন বলছেন আম্মু। ফুফুরা কিন্তু আপনাদের নামে কোনো খারাপ কিচ্ছু বলেননি। আর আমি বুঝতে পারি না তাদের জমি তারা বিক্রি করে নিয়ে গেছেন, এতে সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার কী আছে। আচ্ছা আব্বু আপনি বলেন তো, ফুফুরা কি তাদের সব সম্পত্তি নিয়ে গেছেন। সঠিক হিসাব করলে তারা এখনও অনেক সম্পত্তি পান। আর সম্পত্তি নিয়ে আমার মাথাব্যাথা নেই। কী হবে এত্ত সম্পত্তি দিয়ে। সম্পত্তি বড় না সম্পর্ক বড়, বুঝি না।ছেলের পরিবর্তন দেখে চেয়ারম্যানের চোখ চড়কগাছ। কেমন গুছিয়ে বড়দের মতো কথা বলছে সীমান্ত। ছেলেকে আর চটাতে চান না চতুর আজগর চেয়ারম্যান। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন।

 

সীমান্ত এসব কথা এখন থাক বাবা, তোমাকে অন্য একটা কথা বলি।বলেন।

 

তোমার বুবুর আর খোঁজ করো না। সে কারও সাথে পালিয়ে গেছে, এটা আমি নিশ্চিত। ইতিমধ্যে দশ গ্রামের লোক বিষয়টা জেনেও গেছে। তার জন্য আমি বাইরে মুখ দেখাতে পারছি না। তাই বলছি, তোমার এসব নিয়ে ঘাটাঘাটি করার প্রয়োজন নেই। পড়াশোনায় মন দাও।

 

কিন্তু আব্বু, আমার তা মনে হয় না। কার সঙ্গে পালাবে বুবু?তা জানি না। তবে এমন কিছুই ঘটেছে। তা না হলে এতো দিন ফিরে আসত। তাই বুবুকে নিয়ে আর চিন্তা করো না। সে একদিন না একদিন ফিরে আসবে। এখন যাও নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ো।

 

বিছানায় গিয়ে ছটফট করতে থাকে সীমান্ত। তার মাথায় রাজ্যের চিন্তা। এই ছোট্ট জীবনে এক সঙ্গে এত প্রশ্ন এত ভাবনা কখনো আসেনি। বারবার নিজেকে প্রশ্ন করে, কী হচ্ছে তাদের পরিবারে। সম্পর্কগুলো কেন এমন হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন সম্পর্কগুলো খসে খসে পড়ছে। ফুফুরা তো এই পরিবারের মেয়ে। আব্বু, বড় ফুফু, ছোট ফুফু সবাই তো এক পরিবারে বড় হয়েছেন। একই হাঁড়ির ভাত খেয়েছেন। আনন্দ দুঃখ সব ভাগাভাগি করে নিয়েছেন।

 

কতটা বছর এক সঙ্গে থেকেছেন উনারা। কিন্তু সামান্য সম্পত্তির জন্য তাদের আজ মুখ দেখাদেখি বন্ধ। স্বার্থের হানাহানি। আব্বু তো বুজিরই ছেলে। সেই ছেলেকেও ইদানীং সহ্য করতে পারেন না তিনি। পরিবার থেকে মুক্তি চান। অথচ এই সংসারটা বুজি নিজের হাতেই সাজিয়েছেন। কয়েক বছর আগেও বুজি বলতেন আমার রঙের সংসার। তাহলে রংগুলো আজ ফিকে হয়ে গেল কেন। এমন কী হয়েছে, যার জন্য বুজি আমার বড় হওয়ার অপেক্ষায় আছেন। কবে চাকরি পাবো সেই অপেক্ষায় আছেন। কী কষ্ট লুকিয়ে আছে বুজির মনে। কেন সব খুলে বলছেন না তিনি।

 

হঠাৎ করেই বুবু উধাও হয়ে গেল। যার কোনো কারণ জানা গেলো না। কী হয়েছিল বুবুর। বুবু কি সত্যিই নিজের ইচ্ছেতে কোথাও চলে গেছে। নাকি বড় কোনো বিপদ হয়েছে তার। যদি চলেই যায় এর পেছনে বড় কোনো কারণ রয়েছে। প্রথম কারণ আম্মু। আম্মু কখনো বুবুর ভালো চান না, কখনো চাইবেন বলেও মনে হয় না। কিন্তু বুবু তো আম্মুকে সহ্য করে নিয়েছিল। আম্মুর সকল অত্যাচার মেনে নিয়েছিল। তাহলে এমন কী হলো। তবে কি আব্বুর সঙ্গে কিছু হয়েছিল? কোনো প্রশ্নর উত্তর মেলাতে পারে না সীমান্ত। সে ভাবতে থাকে, মানুষ সম্ভবত এভাবেই পাগল হয়ে যায়।

 

 

ছয়.

টয়লেটে যাওয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে আছে রুপালি। তার খুব তাড়া। সাড়ে সাতটার মধ্যে অফিসে ঢুকতে না পারলে গালি শুনতে হবে। বেতনও কাটা যেতে পারে। কিন্তু কিছু করার নেই। তার আগে আরও দুইটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারাও গার্মেন্টসে চাকরি করে। এই বস্তির সবাই ব্যস্ত মানুষ। কেউ ফেরিওয়ালা, কেউ রিকশাচালক, কেউ ঝাড়–দার, কেউ ড্রাইভার, কেউ গামের্ন্টেসে, কেউ বাসা-বাড়িতে, কেউ বা কারখানায় কাজ করে। খেটে খাওয়া মানুষের আবাসস্থল এই বস্তি।

 

তবে এর মধ্যে আরও কিছু মানুষ এখানে বাস করে। তারা নানান অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। তারা মদ, গাঁজা, ইয়াবা এসবের ব্যবসা করে। দেহ ব্যবসাও এখানে হয়। টোকাই, মাস্তানদের আনাগোনাও এই বস্তিতে বিরাজমান। মাস্তানরা প্রায় বস্তির মেয়েদের তুলে নিয়ে যায়। ইচ্ছেমতো ভোগ করে তবেই ফেরত পাঠায়। কেউ বা আপসেই রাজি হয়। এই ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।

 

ঢাকা শহরে সবার আগে জেগে ওঠে বস্তি। বস্তির মানুষ যখন নিজ নিজ কর্ম করে ঘাম ঝরান, সাহেব শ্রেণির মানুষেরা তখন গভীর নিদ্রায় মগ্ন। প্রথম প্রথম এই বস্তিতে এসে খুব কষ্ট হয়েছে রুপালির। বিশেষ করে লাইনে দাঁড়িয়ে টয়লেটে যাওয়া, গোসল করা এসব ভালো লাগেনি। বাথরুমগুলো ছালার চট দিয়ে বানানো। বাতাস এলেই তা নড়ে ওঠে। সেখানে ওত পেতে থাকে বদ ছেলেরা। মেয়েরা গোসল করতে গেলেই তারা হ্যাংলার মতো তাকিয়ে থাকে। এখন এসব সয়ে গেছে রুপালির। মানুষ সত্যিই মানানসই প্রাণী। ইচ্ছে করলে যে কোনো জায়গায় মানিয়ে নিতে পারে।

 

রুপালির দেরি দেখে মলিনা তার খোঁজে আসে। দেখে এখনও দাঁড়িয়ে আছে রুপালি। মলিনা তাড়া দেয়। তাড়াতাড়ি কর, দেরি হয়ে যাচ্ছে তো?

 

কীভাবে তাড়াতাড়ি করি বলো তো, জোর করে তো ঢোকা যাবে না।

 

মলিনা তার কথায় কান তোলে না। বলে তাড়াতাড়ি এসো, আমি তোমার খাবার রেডি করছি।

 

বাথরুম থেকে বেরিয়ে সম্রাট আর রয়েলকে দেখতে পায় রুপালি। এরা বস্তির মাস্তান। সব ধরনের অপকর্মই তারা করে বেড়ায়। রুপালি কখনও ওদের সঙ্গে কথা বলেনি। মলিনার কাছ থেকে ওদের সম্পর্কে জেনেছে। এসব ছেলেদের থেকে যতই দূরে থাকা যায় ততই ভালো। সম্রাট আর রয়েলকে না দেখার ভান করে চলে যায় রুপালি। যেতে যেতে তার কানে যায় ওদের কথোপকথন।

 

সম্রাট রয়েলকে বলছে, মালটা হেব্বি তাই না দোস্ত? এই বস্তিতে এর থেইক্যা ভালো মাল আর হয় না। ওরে দেখলেই শরীরটা গরম হয়ে যায়। হেব্বি গরম। তখন ইচ্ছে হয়--।

 

তোর তো সঙ্গে সঙ্গে শরীর গরম হয় আর আমার--। আরও একটি বিশ্রী বাক্য বলে ওরা।

 

এসব নিয়ে এখন ভাবার সময় নেই রুপালির। ঘরে গিয়ে মলিনার সঙ্গে অফিসের উদ্দেশ্য বের হয়ে যায়।

 

অফিসে গিয়ে দম ফেলার সময় থাকে না। এখানে খুব কড়াকড়ি। গার্মেন্টসের চাকরির ধরনই এমন। শ্রমিকদের ইচ্ছেমতো খাটাবে কিন্তু সে অনুযায়ী বেতন দেবে না। হাতে গোনা কিছু প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যসব গার্মেন্টসের একই অবস্থা। অফিসে ঢুকলে সবাই যেন জেলখানার কয়েদি।

 

রুপালি কাজ করছে সুপারভাইজার হিসাবে। গার্মেন্টেসে প্রথমেই সুপারভাইজার হওয়া কঠিন। রুপালি ইন্টারমিডিয়েট পাস। তার রেজাল্টও ভালো। সেজন্যই চাকরিটা পেয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা, এই পোস্টটা ফাঁকা ছিল। না হলে তাকে হয়তো হেলপার থেকেই শুরু করতে হতো। এখানে রুপালির একটি লাইনের দায়িত্ব পালন করতে হয়। সুপারভাইজাররা কাজে ফাঁকি দিচ্ছে কি না তা দেখার জন্য অন্য লোক রয়েছেন। ফ্যাক্টরি পরিচালনা করার জন্য লাইন চীপ, ফ্লোর ইনচার্জ, পিএম সবাইকে যার যার দায়িত্ব পালন করতে হয়। ফলে যার যার কাজে সে ব্যস্ত থাকে।

 

লাঞ্চের সময় অন্যদের মতো রুপালির অবসর মেলে। বাসা থেকে আনা আটার রুটি আর ডিম মামলেট খেতে খেতে সম্রাট ও রয়েলের কথা মনে পড়ে। মেয়েদের নিয়ে পুরুষের কী বিশ্রী মন্তব্য ভাবতেই তার বমি চলে আসে। মনে হচ্ছে সামনের খাবারটুকু আর পেটে যাবে না। বাকি খাবারটুকু বাটিতেই পড়ে থাকে।

 

রুপালি ভাবে তাকে সর্তক থাকতে হবে। বস্তিটা দিন দিন তার জন্য বিপদজ্জনক হয়ে উঠছে। এখানে বেশিদিন থাকা মানে নিজেকে ভয়ঙ্কর পরিবেশের মধ্যে রাখা। সেটা হতে দেবে না রুপালি। কিন্তু এর জন্য কিছুটা সময়ের দরকার। এছাড়া তার কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। অন্য একটা চাকরির চেষ্টা করছে। চাকরিটা পেলে কিছুটা প্রশান্তি পাবে। বেতনটাও বেশি হবে।

 

সবচেয়ে বড় সুবিধা হবে নিজের জন্য কিছু সময় পাবে। ওই অফিসে নয়টা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত ডিউটি। এই সময়টা লেখাপড়ার কাজে ব্যয় করতে চায় রুপালি। কিন্তু সবার আগে চাকরিটা পাওয়া দরকার। যত দিন না পাওয়া যাচ্ছে, তত দিন ধৈর্য ধরতেই হবে।

 

রুপালি ভালো ছাত্রী। এক বছর আগে ইটারমিডিয়েট পাস করেছে। এ বছর ভর্তি হতে না পারলে আর অনার্সে ভর্তির সুযোগ থাকবে না। এমনিতেই পড়াশোনায় গ্যাপ রয়েছে। এটা হয়েছে তার বাবার জন্য। তিনি চাননি মেয়ে আর পড়–ক। তার যুক্তি, বিদ্যাধরী হলে মেয়েদের পাখা গজায়। আর পাখা গজালেই উড়তে শুরু করে। এটা পছন্দ না তার। তাই মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ ছিল।

 

নিয়মিত পড়াশোনা করতে পারলে এখন রুপালি অনার্স থার্ড ইয়ারে থাকত। কিন্তু সেটা হয়নি। এইট পর্যন্ত পড়ে তাকে মা-বাবার চাপে দুই বছর লেখাপড়া বন্ধ রাখতে হয়। বিষয়টা মেনে নিতে পারেনি রুপালি। তার দুই ফুফুই বিএ পাস। আগের প্রজন্মে যে বাড়ির মেয়েরা বিএ পাস করেছে তাদের পরের প্রজন্ম আরও বেশি পড়াশোনা করবে, এটাই স্বাভাবিক।

 

কিন্তু রুপালির বেলায় উল্টো হয়েছে। মাঝপথেই থামতে হয় তাকে। এ নিয়ে সারাক্ষণ মন খারাপ থাকত রুপালির। কাউকে কিছু বলতে পারত না। নিজের অনলে নিজেই পুড়ে মরত। পরে মরিয়ম বেগমের শক্ত অবস্থানের কারণে আবার লেখাপড়া শুরু করতে পারে রুপালি। মরিয়ম বেগমের সাফ কথা, তার নাতনিকে স্কুলে ভর্তি না করালে তিনি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন। পাশাপাশি তার নামে যে জমি রয়েছে, সব রুপালির নামে লিখে দেবেন। বাধ্য হয়েই আজগর চেয়ারম্যান তাকে আবার স্কুলমুখী হতে দিয়েছিলেন।

 

দুই বছরের গ্যাপ দিয়ে নাইনে সায়েন্সে ভর্তি হয় রুপালি। ফলাফল ভালো করে । এসএসসি-ইন্টারমিডিয়েট দুইটাতেই এ প্লাস পায়। কিন্তু আবারও পরিবারের বাঁধা। অনেক হয়েছে এবার ক্ষেমা দাও। এবার আর ফাইট করে ঠিকে থাকতে পারেননি মরিয়ম বেগম। ফলে জীবন থেকে একটা বছর চলে গেছে রুপালির। কিন্তু এখন কোনো বাঁধা নেই। এখন সে নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে পারবে।

 

বাড়ি থেকে পালানোর সময় সে সার্টিফিকেট, মার্কশিট কিছুই সঙ্গে আনতে পারেনি। এসব কাগজপত্রের ছবি তুলে তা মেইলে রেখে দিয়েছিল রুপালি। এখন এটাই ভরসা। এসব দিয়েই জিডি করে মূল কাগজপত্র জোগাড় করা যাবে। এগুলো করতে হবে তাকেই। এখন পৃথিবীর প্রতিটি অলিগলি তার জন্য উন্মক্ত।

 

তবে প্রতিটি রাস্তায় পা ফেলতে হবে খুব হিসাব করে। পৃথিবীতে যে একা চলে, তার জন্য প্রতিটি রাস্তাই পিচ্ছিল।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version