দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ ছিল মার্চ মাস। মার্চের শুরুতেই পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। স্বাধীনতা আন্দোলনের দাবিতে জনতা রাজপথে নামে। এ মাসের প্রতিটি দিনই ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। যার ঘটনাপ্রবাহে আসে বাঙালি জাতির স্বাধীনতা।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ হঠাৎ এক হটকারী সিদ্ধান্তে পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করলে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে বাংলার আপামর জনতা। অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
এরপর ২৫ মার্চ পর্যন্ত নানান ঘটনার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন রূপ নেয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে। অসহযোগ আন্দোলনের সপ্তদশ দিবসে সরকারি- বেসরকারি ভবনের শীর্ষে কালো পতাকা উড়িয়ে, অফিস-আদালতে অনুপস্থিত থেকে সর্বশ্রেণির কর্মচারীরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘোষিত সংগ্রামের কর্মসূচিকে সফল করে তোলেন।
মুজিব-ইয়াহিয়া পরবর্তী বৈঠকের কোনো সময় নির্ধারণ না হওয়ায় জনমনে উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত উৎসুক জনতা তাদের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক বঙ্গবন্ধু বাসভবনে ভিড় জমান। পহেলা মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনটি কেবল সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী যে জনগণ, তাদের পরিচালন কেন্দ্রেই পরিণত হয়নি, সেই সঙ্গে হয়ে ওঠে মুক্তিকামী মানুষের মিলনক্ষেত্রও।
এদিন সকাল থেকে বিভিন্ন সংগঠন মিছিল সহকারে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে এসে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে বৈঠক থেকে বঙ্গবন্ধুকে বিরত থাকার আহব্বান জানায় এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘোষণা দাবি করে। সারাদিন ধরে মিছিলের পর মিছিল করে বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়কের প্রতি তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন জানাতে এলে বঙ্গবন্ধু সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনার ফাঁকে বারবার উঠে এসে শোভাযাত্রাকারীদের উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন।
ভাষণে তিনি বলেন, তোমরা চরম প্রস্তুতি নিয়ে ঘরে ঘরে সংগ্রামী দুর্গ গড়ে তোল। যদি তোমাদের ওপর আঘাত আসে তা প্রতিহত করে শত্রুতার ওপর পাল্টা আঘাত হেনো। জনতাকে চূড়ান্ত লড়াইয়ে প্রস্তুত থাকার আহব্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, মুক্তি সংগ্রামের পতাকা আরো ওপরে তুলে ধরো। সাত কোটি শোষিত-বঞ্চিত বাঙালির সার্বিক মুক্তি না আসা পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাও।
বিদেশি সাংবাদিকরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারা দেশের এই রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনা জানতে চান। বঙ্গবন্ধু বলেন, বাঙালি জাতি আজ জেগে উঠেছে। তারা স্বাধীনতার জন্য জীবন দিতে শিখেছে। জাগ্রত জনতার এই গণবিস্ফোরণকে স্তব্ধ করার শক্তি কোনো মেশিনগানের নেই। আমার দেশের মাটিতে যা কিছু ঘটছে, তার সব খবরই আমি রাখি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ওয়ালী ন্যাপ প্রধান ওয়ালী খান একঘণ্টাব্যাপী রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি গাউস বক্স বেজেঞ্জোও উপস্থিত ছিলেন। রাতে সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়, আগামীকাল সকাল এগারোটায় প্রেসিডেন্ট ভবনে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ও আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের মধ্যে বর্তমান রাজনৈতিক সংকট সম্পর্কে তৃতীয় দফা আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে।
সেনাবাহিনীর সদস্যরা তেজগাঁও ও মহাখালীতে শ্রমিকদের ট্রাকে হামলা চালায়। সৈন্যরা এই দুই স্থানে নিরস্ত্র আরোহীদের নির্মমভাবে প্রহার করে এবং তাদের টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেয়। এসব ঘটনায় নগরীতে জনসাধারণের মধ্যে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
রাতে এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির উপনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম সংবাদপত্রে বিবৃতি দেন। তিনি বিবৃতিতে বলেন, আমরা পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিতে চাই, নিরস্ত্র মানুষের ওপর উস্কানিমূলক আচরণ, তা যে কোনো মহলেরই হোক না কেন, আমরা আর সহ্য করব না। এর ফলাফলের দায়িত্ব উস্কানিদাতাদেরই সম্পূর্ণ বহন করতে হবে।
১৮ মার্চ স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এক বিবৃতিতে স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে বিশ্ব নেতৃত্বের সমর্থন কামনা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, চীন প্রভৃতি দেশের সরবরাহকৃত অস্ত্রের দ্বারা বাঙালি নিধনের প্রয়াস বন্ধ করার আহব্বান জানানো হয়। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর কাছে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত সামরিক বাহিনী ও অস্ত্রের চালানবোঝাই উড়োজাহাজের চলাচল বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হয়।
১৮ মার্চ রাতে সরকারি প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, আগামীকাল বেলা ১১টায় আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের মধ্যে বর্তমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে তৃতীয় দফা আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য