-->
শিরোনাম

অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতিতে কৃষিতে জোর দিতে হবে

মো. কবীর মোল্লা
অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতিতে কৃষিতে জোর দিতে হবে

করোনা মহামারি, অর্থনৈতিক মন্দা এবং ইউক্রেন যুদ্ধ- মানবজাতির ওপর উপর্যুপরি এই তিন আঘাতের ঘটনায় বিশ্বপরিস্থিতি ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। করোনা সংক্রমণ দিয়ে শুরু, আর এখন বিশ্ব পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। এই দুই ঘটনার অবধারিত ফল হিসেবে প্রচন্ড ভার হয়ে চেপে বসেছে অর্থনৈতিক মন্দা। অর্থনৈতিক মন্দা ও এর সংশ্লিষ্ট ঘটনায় গত প্রায় তিন বছর ধরে বিশ্ব মূল্যস্ফীতির কালো ঘোড়ার সঙ্গে পেরে উঠছে না সাধারণ মানুষ।

 

বিশ্বের কোথাও কোথাও পণ্য উৎপাদন বেড়ে মূল্য কমার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বটে, তবে এর বিস্তৃতি প্রসার হতে এখনো অনেক সময় বাকি রয়েছে। হতে পারে তা আরো কমসে কম বছর দুয়েক। বাংলাদেশের মতো অর্থনীতির দেশের জন্য যা একটি কঠিন বার্তাই বটে।

 

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনাও প্রায় একই রকম আশংকা প্রকাশ করেছেন। তিনি একজন প্রাজ্ঞ রাজনীতিক। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি দেশবাসীকে এ ব্যাপারে সতর্ক করে আসছিলেন। অর্থনৈতিক মন্দা ও মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় এর আগেই শেখ হাসিনা দেশবাসীকে সতর্ক করেছেন এবং পরিস্থিতি মোকাবিলায় কিভাবে অগ্রসর হতে হবে তার পরামর্শও দিয়েছেন।

 

তিনি জীবন যাত্রার ব্যয় নির্বাহে বিভিন্ন স্তরে সংযমী পন্থা অনুসরণের পরামর্শ দিয়েছেন। রোববার জাতীয় সংসদে ভাষণ দিতে গিয়েও সেই বার্তার কথা পুনরুল্লেখ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘সারা বিশ্বে খাদ্যমন্দা, মুদ্রাস্ফীতি, পরিচালনা ও পরিবহন ব্যয়, বিদ্যুতের ঘাটতিতে প্রত্যেকটি মানুষের জীবনকে অসহনীয় করে তুলেছে। বিশ্বের এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি আর কতদিন চলবে তা কেউ বলতে পারে না।’ হয়তো বিশ্ব পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে।

 

তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাসের অতিমারি, এরপর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে সমগ্র বিশ্বে যে খাদ্যমন্দা, মুদ্রাস্ফীতি, পরিচালনা ও পরিবহন ব্যয়, বিদ্যুতের ঘাটতি এটা প্রত্যেকটি মানুষের জীবনকে অসহনীয় করে তুলেছে। বাংলাদেশে আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি।’

 

বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য যে, একটি ভালো সময়ে দেশের অর্থনীতি অনেক অনেক কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হচ্ছে। এই সময়ে দেশে নেই পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা। করোনা মাহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধ এর জন্য দায়ী হলেও দেশের অসৎ কর্মকর্তারাও কম দায়ী নয়। সরকারের বিভিন্ন তথ্যেই তা দেখা গেছে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংকের টাকা অনেকটা লুটপাটই হয়েছে। কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা ফেরত না দেয়া লুটপাট ছাড়া আর কীই বা হতে পারে।

 

সে ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের ভূমিকা সুধী সমাজের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া অস্বাভাবিক নয়। একই সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান তথ্য প্রকাশ করেছে যে বাংলাদেশ থেকে কোটি কোটি ডলার পাচার হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে জানানো হয়েছে পাচার করা এসব অর্থ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।

 

অর্থাৎ পাচার হয়েছে এটা সত্য। আজ দেশের ব্যাংকগুলোর অবস্থা যদি আরো ভালো থাকত, টাকা নিয়ে মেরে দেয়া লোকের সংখ্যা যদি কম থাকত বা ডলার চুরি যদি কম হতো, তাহলে দেশের অর্থনীতি নিশ্চয় আজকের এই দিনটির তুলনায় আরো বেশি মজবুত থকত। করোনা মহামারি বা ইউক্রেন যুদ্ধ- আমরা যাই বলি না কেন, দেশের অর্থনীতি মজবুতের জন্য এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অনেক বেশি দেশপ্রেমিক মানসিকতা প্রয়োজন, দরকার আইনের কঠোর বাস্তবায়ন।

 

বিশ্বে এখন এমন এক অবস্থা বিরাজ করছে যে, নগদ অর্থ দিয়েও অনেক প্রয়োজনীয় নিত্যসামগ্রী পাওয়া দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে আরো বলেছেন, ‘জ্বালানি তেল, কয়লা বা গ্যাসের অভাব সারা বিশ্বব্যাপী। এখন তো কেনাটাই অনেকটা মুশকিল। ক্রয় করাটা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তারপরও আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। ইতোমধ্যে কাতার ও ওমানের সাথে আমাদের চুক্তি সই হয়ে গেছে।

 

আমরা জলবিদ্যুৎও আমদানির ব্যবস্থা নিয়েছি। কয়লা কেনার জন্য ইতোমধ্যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। যাতে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো আমরা আবার চালু করতে পারি।’ সংসদে আলোচনায় অংশ নিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মানুষের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছি।’

 

আজ জ্বালানির জন্য পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে বিদ্যুতের লোডশেডিং ক্রমেই মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। অথচ বিদ্যুৎ উৎপাদনের সব আয়োজন এই সরকার সম্পন্ন করেছে। বিএনপি সরকারের আমলে দেশে জ্বালানি উৎপাদন ছিল সাকুল্যে তিন হাজার মেগাওয়াট। সেই জায়গায় আজ বাংলাদেশের সক্ষমতা হয়েছে ২৪ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের। সম্প্রতি রাজধানী ঢাকাবাসী প্রায় ভুলেই গিয়েছিল লোডশেডিং কী। সেখানে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আবার লোডশেডিংয়ের ধকল সইতে হচ্ছে দেশবাসীকে। তবে সরকারকে ধন্যবাদ দিতে হয়, তারা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দেশের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছে।

 

ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ, স্যাংশন, পাল্টা স্যাংশন, বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি, জ্বালানি তেলের অভাব, যার জন্য এখন শুধু বাংলাদেশ নয়, উন্নত দেশগুলোও হিমশিম খাচ্ছে। ইউরোপ তো পুরো শীতকালজুড়ে ভয়াবহ জ্বালানি সংকট মোকাবিলা করেছে। তাদের অনেক উচ্চমূল্য দিয়ে জ¦ালানি কিনতে হয়েছে। এখনো আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে জ্বালানির অভাব হচ্ছে। ইউরোপ-আমেরিকায় লোডশেডিং বা বিদ্যুৎ ব্যবহার সীমিত করা হচ্ছে।

 

খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। উন্নত দেশেও বহু মানুষ চাকরি হারাচ্ছে। এমন একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সারা বিশ্বব্যাপী। যুদ্ধ যেকোনো সময়ের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে দুর্ভিক্ষ হয়েছে বিশ্ব ব্যাপী। এই ভারতবর্ষ, বিশেষ করে বাংলা প্রচন্ড ভাবে ভুগেছে দুর্ভিক্ষের কারণে।

 

তবে বাংলাদেশের জন্য এখনো সবচে বড় আশার কথা এ দেশের পরিশ্রমী কৃষক শ্রেণি এবং উর্বর মাটি। এই দেশে সুবিধাবাদী জনগোষ্ঠী বারবার জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করলেও এই কৃষক আর মাটি কখনো দেশের জনগণের সঙ্গে বিশ্বাস ঘাতকতা করেনি। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক এই প্রচন্ড চাপের সময়ে খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করা গেলে এবং আমদানি কমানো গেলে নিশ্চিতভাবেই তা অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

 

আওয়ামী লীগ সরকার সব সময় কৃষকবান্ধব প্রণোদনা দিয়ে দেশের কৃষিকে এগিয়ে নিয়েছে। আমরা আশা করব, এবারের এই কঠোর আর্থিক মন্দা ও মূল্যস্ফীতির সময়ে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা প্রয়োজনীয় সৃজনশীল কর্মসূচি গ্রহণ করে কৃষিকে নিরাপদ রাখার সব কৌশল গ্রহণ করবেন। এর মাধ্যমে দেশও আর্থিকভাবে নিরাপদ থাকবে। তবে সবকিছু সরকারের একার পক্ষে সম্ভব হবে না। জনগণকেও পরিস্থিতি বুঝে চলতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবাইকে সাশ্রয়ী হওয়ার আহব্বান জানিয়েছেন। তিনি সবাইকে বিদ্যুৎসহ অন্য পণ্য ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার আহব্বান জানিয়েছেন।

 

বিশ্বব্যাপী পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়া ও পণ্যপ্রাপ্তির সহজলভ্যতার পথ সংকুচিত হওয়ায় আজ বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্য অনেক দেশই ভুগছে। গত এক দশকে বাংলাদেশ যে মাত্রায় উন্নতি করেছে, সে তুলনায় আজকে জনজীবনে আর্থিক ভোগান্তি সাধারণ মানুষের কাছে কাম্য নয়। সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে যে, দ্রুত পরিস্থিতির উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে কিন্তু একই সঙ্গে সরকারকে আশ্বস্থ করতে হবে যে, দেশের আর্থিক ক্ষয়-ক্ষতি সংগঠনকারীদের যথাযথ আইনের আওতায় আনা হয়েছে। আসছে নির্বাচনের জন্য এ ধরনের কঠিন-কঠোর অবস্থান সরকারের কাছে জনগণ প্রত্যাশা করে। না হলে জনগণের কাছে সঠিক বার্তা যাবে না।

 

এই সরকারের আমলে যে দেশের প্রভূত উন্নতি হয়েছে, সে কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। জাতিসংঘসহ বিশ্বের অনেক সংস্থার কাছেই বাংলাদেশের উন্নয়ন আজ রোল মডেল। এ অবস্থায় সরকারের পক্ষ থেকেও কোনো ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই। সেই উন্নয়নের কথা জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। তবে যতদূর সম্ভব মানুষের জীবনযাত্রায় চলমান কষ্ট দূর করা সম্ভব হলে তা অনেক বেশি ফলদায়ক হবে।

 

এ দেশের মানুষ অল্পতেই সন্তুষ্ট। জনতুষ্টির সেই মাত্রাটি সঠিকভাবে উপলব্ধি করা সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য অতীব প্রয়োজন। আমরা আশা করব, করোনা মহামারি, ইউক্রেন যুদ্ধ বা বিশ্বমন্দা পরিস্থিতি মোকাবিলা করে বাংলাদেশ যথাযথভাবে এগিয়ে যাবে সঠিক গন্তব্যে। এই এগিয়ে যাওয়ার নিশানা ঠিক থাকলে সরকারও এগিয়ে যাবে, জনগণও জিতবে।

 

লেখক: মন্ট্রিয়েল (কানাডা) প্রবাসী সংস্কৃতকর্মী

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version