-->

ইমরান খানের পরিণতি কী?

আলমগীর সাত্তার
ইমরান খানের পরিণতি কী?

১৫-২০ দিন আগে লেখাটা শুরু করে থেমে যাই। ভাবলাম দেখি ইমরান খানকে নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ষড়যন্ত্রের জাল আস্তে আস্তে কেমন করে বিস্তার করে। এই কয়দিন বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর দেখেশুনে মনে হয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ইমরান খানকে ফাঁসি দিতে পারে। যে দেশের রাজনৈতিক নেতা যত বেশি জনপ্রিয় ওই দেশের সেনাবাহিনীর ষড়যন্ত্রের কারণে তার মৃত্যুর শঙ্কাও তত বেশি।

 

পিআইএতে চাকরি উপলক্ষে পাকিস্তানে ছিলাম অনেকদিন। করাচি, লাহোর এবং রাওয়ালপিন্ডিতে ছিলাম পোস্টিংয়ে। তাই পাকিস্তানের অনেক বিষয়েই আমার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে। জুলফিকার আলী ভুট্টো সিন্ধু এবং পাঞ্জাবে ইমরান খানের মতোই জনপ্রিয় ছিলেন। ১৯৭১ সালে একদিন ক্যাপ্টেন তারেক এবং আমি করাচি থেকে মহেঞ্জোদারো হয়ে লায়ালপুর পর্যন্ত একটি ফ্লাইট করেছিলাম।

 

ফেরার সময় আমি ককপিটের বাম দিকের আসনে বসেছিলাম। লায়ালপুর ত্যাগ করার আগেই ওখানকার স্টাফরা জানাল মহেঞ্জোদারো স্টেশন থেকে পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো আমাদের ফ্লাইটে করাচি যাবেন। মহেঞ্জোদারো পৌঁছানোর পর সেখানে আধঘণ্টা যাত্রা বিরতি। সব যাত্রী আসন গ্রহণ করেছে, কিন্তু ভুট্টো তখনো এসে পৌঁছাননি।

 

অন্য কথা বলার আগে বলে নিতে চাই যে, তার পিতা শাহনেওয়াজ ভুট্টো ছিলেন বেশ বড় জমিদার এবং বিয়ে করেছিলেন মুম্বাইয়ের এক নামকরা সুন্দরী বাইজিকে। সেই বাইজির পুত্র হলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। ভুট্টো অনেক লেখাপড়া শিখেছিলেন, কিন্তু তার ব্যবহার এবং কথাবার্তায় প্রকাশ পেত যে, তিনি একজন বাইজিপুত্র। এমনকি যাকে আমরা তার পিতা বলে জানি তিনি আদতেই তার পুত্র ছিলেন কিনা এ বিষয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

 

প্রায় ত্রিশ মিনিট ফ্লাইট ছাড়তে বিলম্ব হলো। তখনো ভুট্টো সাহেব এলেন না। এর কিছু সময় পর প্রত্নতত্ত্ববিদদের খুঁজে পাওয়া ঐতিহাসিক মহেঞ্জোদারোর দিক থেকে কয়েকখানা গাড়ি রাস্তার ধূলি উড়িয়ে আসতে দেখা গেল। আমরা ভেবে নিলাম এটা ভুট্টোর গাড়ির বহরই হবে।

 

এমনিতেই ফ্লাইট ছাড়তে সিডিউল সময় থেকে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। এফ-২৭ অ্যারোপ্লেনে যাত্রী ওঠা-নামার জন্য দুটো দরজা আছে। পেছনের দরজার সঙ্গে সিঁড়ি লাগিয়ে যাত্রীরা ওঠা-নামা করে। আর একটা দরজা আছে ককপিটের কাছেই। ওই দরজা দিয়ে যাত্রীদের জন্য খাবার-দাবার তোলা হয়। মানুষও প্লেনে উঠতে পারে, মাথাটা একটু নত করে। ফ্লাইট ছাড়তে বিলম্ব হয়ে যাওয়ায় ক্যাপ্টেন তারেক সময় বাঁচানোর জন্য ট্রাফিক স্টাফদের সিঁড়ি সরিয়ে নিয়ে পেছনের দরজা বন্ধ করে দিতে বললেন।

 

তাই বাইজিপুত্রকে সামনের ছোট দরজা দিয়ে মাথানত করে প্লেনে চড়তে হলো। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ককপিটের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আমাকে ক্যাপ্টেন মনে করে অশ্রাব্য ভাষায় একটি গালি দিলেন। অথচ দেরি হওয়ার জন্য তারই দুঃখ প্রকাশ করা উচিত ছিল।

 

চীনের চেয়ারম্যান মাও জেদং-এর অনুকরণে ভুট্টোকে তার অনুসারীরা চেয়ারম্যান ভুট্টো বলে সম্বোধন করত। যারা ছিল গোঁড়া সমর্থক তারা ভুট্টোকে শুধু চেয়ারম্যান বলেই সম্বোধন করত। ফ্লাইট যখন হায়দরাবাদ শহরের কাছে পৌঁছল তখন ওখানকার এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলাররা জানতে চাইলেন ‘কনফার্ম চেয়ারম্যান অনবোর্ড’? তাদের জানিয়ে দিলাম চেয়ারম্যান অনবোর্ড আছেন। করাচি শহরের কাছাকাছি আসতেই ওখানকার ট্রাফিক কন্ট্রোলাররা একই কথা জানতে চাইলেন। আমরাও একই উত্তর দিলাম।

 

করাচি বিমানবন্দরে অবতরণ করার পর দেখে অবাক হয়ে গেলাম, হাজার হাজার ভুট্টো সমর্থক তাকে অভ্যর্থনা জানাতে উপস্থিত হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে লজ্জাজনকভাবে হেরে যাওয়ার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী কয়েক বছর একটু চাপে ছিল। তারপর তারা আবার সক্রিয় হলো। ভুট্টোর জনপ্রিয়তার কারণেই তিনি সেনাবাহিনীর বিরাগভাজন হন।

 

পাকিস্তানকে ওই দেশের লোকেরাই এখন নতুন নামকরণ করেছে ‘ফৌজিস্তান’ বলে। আবার কেউ কেউ ওই দেশকে কাঙালিস্থানও বলে। পাকবাহিনী ভুট্টোর এক ছেলেকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে গুলি করে হত্যা করে। আর এক ছেলেকে হত্যা করে দোষ চাপায় বেনজীর ভুট্টোর ওপর। বেনজীর ভুট্টোও খুব জনপ্রিয় ছিলেন। বিশ্বের প্রভাবশালী নেতানেত্রীর মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। সুন্দরী বলেও খ্যাতি ছিল তার।

 

পাকিস্তান রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ওই দেশের পরপর দুজন সেনাপ্রধান ছিলেন ব্রিটিশ। আমাদের জানতে হবে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ব্রিটিশ সেনা অফিসাররা কতটা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতেন। বেতন-ভাতা বাদ দিয়ে একজন সিনিয়র ব্রিটিশ অফিসারকে সেবাদানকারী হিসেবে ২০ জন কর্মী কাজ করত। পাকিস্তান সৃষ্টির পর ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত মুসলমানরা পাক সেনাবাহিনীতে যোগদান করল।

 

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রথম দুজন সেনাপ্রধান ব্রিটিশ বাহিনীতে যে সুযোগ-সুবিধা পেতেন সেটা বহাল রইল। সে অনুযায়ী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সিনিয়র অফিসারদের সুযোগ-সুবিধা নির্ধারিত হলো। ব্রিটিশ দুই সেনাপ্রধানের চলে যাওয়ার পর পাকিস্তানিরাই ওই পদে নিযুক্ত হলো। এসব সিনিয়র পাকিস্তান সেনা অফিসার ব্রিটিশ সেনা অফিসারদের মতো সব সুযোগ-সুবিধা বজায় তো রাখলই, বরং তারা হয়ে পড়ল আরো অনেক বেশি লোভী।

 

পাকিস্তানের বড় বড় ব্যবসা-বাণিজ্যের দখল নিয়ে নিল তারা। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ৩০ থেকে ৪০টি কোম্পানি গঠনের মাধ্যমে পাকিস্তানকেই শোষণ করতে শুরু করল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী শুধু নিজেরা দুর্নীতি করেই ক্ষান্ত হয় না, তাদের তাঁবেদার ক্ষমতাসীন সরকারকেও দুর্নীতি করতে উৎসাহিত করে এবং সবার দুর্নীতির খতিয়ানও রক্ষা করে। এদের কেউ সেনাবাহিনীর বিরাগভাজন হলেই খতিয়ান অনুযায়ী তা প্রকাশ করে ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

 

বাংলাদেশ যতদিন পাকিস্তানের অংশ ছিল ততদিন আমাদের দেশকে শোষণ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের বিলাসবহুল জীবনধারা বজায় রাখে। পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের অবস্থাও ছিল ভালো। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। সেইসঙ্গে সাধারণ মানুষের অবস্থাও আরো হতে থাকে খারাপ।

 

আর্থিক অবস্থা যতই খারাপের দিকে যাক না কেন তারা তাদের প্রতিরক্ষা বাজেট কমায় না। তাদের কাশ্মীর মুক্ত করতে হবে। ভারতের সঙ্গে যুদ্ধংদেহী ভাব বজায় রাখতে হবে চিরকাল। বিদেশ থেকে ঋণ এনে এটা তারা করছিল এতদিন। কিন্তু ঋণের পরিমাণ এতটাই বৃদ্ধি পেয়ে গেল যে, ওই ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে পাকিস্তান এখন পতিত হয়েছে প্রায় দেউলিয়া অবস্থায়।

 

ইমরান খানকে আমি যথেষ্ট পছন্দ করি। তিনি ছিলেন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্রিকেট খেলোয়াড়। লেখাপড়া করেছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেখতে সুদর্শন, সৎ মানুষ। এসবের পরেও চাই পাকিস্তান সেনাবাহিনী ইমরান খানকে ফাঁসি দিক। তারপর পাকিস্তানের অবস্থা কি হবে সেটাও দেখতে চাই। ইমরান খানের জনপ্রিয়তার ব্যাপকতা এতটাই বেশি যে, জুলফিকার আলী ভুট্টোর জনপ্রিয়তাও তাতে অনেক ম্লান হয়ে গেছে।

 

ইমরান খানকে ফাঁসি দিলে পাকিস্তানে যে গণবিস্ফোরণ হবে তা পাক সেনাবাহিনী কিছুতেই দমন করতে পারবে না। সেনাবাহিনীর ক্ষমতা অনেক কমে যাবে। অনেক রদবদল হবে। বর্তমান সরকারের শাহবাজ শরীফ, নেওয়াজ শরীফ এবং শরীফ নামধারীরা বিদেশে চলে যেতে বাধ্য হবে। বিদেশে তাদের শত শত টিলিয়ন ডলার আছে। সবচেয়ে বড় কথা, পাকিস্তান ভেঙে তিন-চারটে স্বাধীন দেশের হবে।

 

বেলুচরা স্বাধীন বেলুচিস্তানের জন্য আমাদের চেয়েও আগে থেকে যুদ্ধ শুরু করেছে। জয়সিন্ধ মুভমেন্টও শুরু হয় বাংলাদেশের যুদ্ধের আগের থেকে। পাকতুনখোওয়ার লোকেরা ইমরান খানের কঠিন ভক্ত। কাশ্মীরের যে অংশ পাকিস্তানের সঙ্গে আছে সে অংশ ভারতীয় কাশ্মীরের সঙ্গে একত্রীভূত হবে।

 

১৯৬৯ সালে পিআইএয়ের আরো দুজন পাইলটের সঙ্গে সোমালিয়ার এয়ারলাইন্সে এফ-২৭ প্লেনের কো-পাইলট হিসেবে ডেপুটেশনে চাকরি নিয়ে আমার ওই দেশে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যখন দেখলাম পরবর্তী ব্যাচে অর্থাৎ দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে এফ-২৭ অ্যারোপ্লেনের ক্যাপ্টেন হওয়ার জন্য আমার ট্রেনিং শুরু হতে যাচ্ছে তখন আর সোমালিয়ায় গেলাম না। ওই সময় সোমালিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা পাকিস্তানের চেয়ে ভালো ছিল।

 

তারপর ওই দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ায় অর্থনৈতিক অবস্থা একেবারে ভেঙে পড়ল। আজ পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র দেশ হিসেবে পরিচিত সোমালিয়া। পাকিস্তানের অবস্থাও অচিরেই সোমালিয়ার মতো হতে পারে! পাকিস্তানের বড় শত্রু কে ভারত, না ওই দেশের সেনাবাহিনী? অবশ্যই পাকিস্তানের সেনাবাহিনী।

 

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক বৈমানিক কিলোফ্লাইট

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version