-->

আর কত ভার সইবে শিশুর কাঁধ?

জলি রহমান
আর কত ভার সইবে শিশুর কাঁধ?

প্রতিবছরই শিক্ষা পদ্ধতিতে কোনো না কোনো পরিবর্তন লক্ষণীয়। চলতি বছরে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষাদান পদ্ধতি তৈরি করা হয়েছে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে নিজের সন্তান পড়ছে বিধায় অনেকটাই জানার সুযোগ হচ্ছে। এখন আর এ দুই ক্লাসের শিক্ষার্থীদের বাসায় এসেই স্কুলের পড়া নিয়ে নেই কোনো ব্যস্ততা। অনেক সময় পাচ্ছে বিশ্রাম নেয়ার।

 

পাশাপাশি শিক্ষকরা যেসব প্রাকটিক্যাল কাজ দিচ্ছেন, সেগুলো করতে হয় বিভিন্ন কালারফুল কাগজে। নানা রঙের কাগজ কিনতে অভিভাবকদেরও ছোটাছুটির শেষ নেই। এরপর তাদের তৈরিকৃত সেসব জিনিসের মাধ্যমে শিক্ষকরা মূল্যায়ন করেন। তবে কোনো নম্বরের মাধ্যমে মূল্যায়িত হয় না। একই সঙ্গে প্রতিদিন ছয়টি ক্লাস হয়, বিভিন্ন রকম সৃজনশীল পড়াও দেয়া হয়।

 

সেগুলো শেষ করতে শিক্ষার্থীদের বেশি সময় লাগে না। কেননা এখন আর পরীক্ষার চিন্তা নেই। পড়াটা বুঝে পড়ে তার মধ্য থেকেই সৃজনশীল কিছু লিখতে হয়। প্রথমে বিষয়টা মেনে নিতে কষ্ট হলেও ধীরে ধীরে কিছুটা ভালো লাগতে শুরু করেছে। হয়তো এভাবে একসময় সবাই এর সঙ্গে মানিয়ে নেবে। তথ্যানুযায়ী, পরের বছর থেকে অন্যান্য ক্লাসেও পর্যায়ক্রমে পাঠদানে পরিবর্তন করা হবে।

 

মূলত আমরা বছরে দুইটা সাময়িক ও বার্ষিক পরীক্ষাতেই অভ্যস্ত। আর ছেলেমেয়েরা অধিকাংশ সময় পড়ার টেবিলে থাকবে এটাই ছিল স্বাভাবিক। হঠাৎ এর ব্যত্যয় ঘটায় শিক্ষাবিদ থেকে অভিভাবক সর্বত্র চলছিল আলোচনা-সমালোচনা। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। কেননা শুধু গদবাঁধা বই পড়ে মেধাবী জাতি তৈরি হয় না। জ্ঞানার্জনের জন্য মেধাকে কাজে লাগাতে হয়।

 

শিক্ষা পদ্ধতিতে ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন আসছে ঠিকই, কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো শিক্ষার্থীদের এখনো সেই আগের মতোই কাঁধে বহন করতে হয় ভারী বোঝা। অভিভাবকরা শিশুদের হাতে ন্যূনতম ওজনের কিছু দিতে চাইবে না। অথচ তাদের কাছেই প্রতিদিন দেয়া হচ্ছে কয়েক কেজি ওজনের একটি ব্যাগ। স্কুল ছুটির সময়ে দেখা যায় অধিকাংশ বাবা-মায়ের কাঁধে ঝুলছে বইয়ের ব্যাগ।

 

নীরবে হেঁটে চলছে। হয়তো ভাবছে কয়েক দশক আগেও এ রকম বোঝা বহন করে শিক্ষা অর্জন করতে হয়নি। তবে আজ কেন আমার সন্তান এমন বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে। আর কোমলমতি শিশুরা ব্যাগের ভারে বাঁকাভাবে হাঁটছে। অনেকে আবার আলাদা আরেকটি ব্যাগে কিছু বই ভাগ করে নেয় পিঠের বোঝাটা হাল্কা করার জন্য।

 

এ দৃশ্যের পরিবর্তন হওয়াটা খুবই প্রয়োজন। প্রতিটি ক্লাসে শিক্ষকরা ছেলেমেয়েদের সামনে বই না দেখলে রাগ করে। সে জন্য শিক্ষার্থীরা যত্ন সহকারে ব্যাগটা রাতেই গুছিয়ে রাখে। তবে গ্রামের শিশুরা এখনো বোর্ডের বই নিয়েই স্কুলে যাওয়া-আসা করছে। অথচ শহরে বোর্ডের পাশাপাশি দেয়া হচ্ছে নানা ধরনের বই, যা পড়া বাধ্যতামূলক। রাজধানীতে বর্তমানে কিছু নামি বলব না, দামি স্কুলের কথা শোনা যায়, যেখানে বই নিয়ে যেতে হয় না।

 

তারা উন্নত বিশ্বের মতো স্কুলের শ্রেণিকক্ষে প্রত্যেকের জন্য আলাদা বই-খাতা রাখার ব্যবস্থা করেছে। এই দামি স্কুল সবার জন্য নয়, যারা উচ্চবিত্তের কাতারে তারাই এ শিক্ষা ব্যয় বহন করতে পারে। আর এ সংখ্যাটা খুবই নগণ্য।

 

বইয়ের বোঝা কমানো কি খুবই ব্যয়বহুল? প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এই যুগে বিদ্যার্জনের বোঝাটা পিঠে চাপিয়ে দেয়াটা খুবই বেমানান।

 

গ্রামের ছেলেমেয়েদের বোর্ডের বইয়ের মাঝেই পড়ালেখা সীমাবদ্ধ। তারা কি কম শিখছে? প্রশ্নের উত্তর পেতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার দিকে তাকানো প্রয়োজন। প্রতিবছরই একটি বিষয় খুবই লক্ষণীয় যে, ভর্তিযুদ্ধে উত্তীর্ণ হওয়া অধিকাংশই গ্রাম থেকে শহরে আসা ছেলেমেয়ে। তা হলে শহরের স্কুলে এসব অতিরিক্ত বই শিশুদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে কেন?

 

প্রতিনিয়ত ওপর মহলের বিশাল কোনো লাভের ভুক্তভোগী হচ্ছে কোমলমতি শিশুরা। কয়েক দশক আগেও যারা কোনোভাবে মাধ্যমিকের গন্ডি পেরোতে পারত। তারাও খুব ভালো ছিল গণিত ও ইংরেজির মতো বিষয়ে। বাংলা মাধ্যমে পড়া মানুষরাও ইংরেজি বলতে পারত স্পষ্ট। অথচ এ যুগের ছেলেমেয়েরা প্রায়ই ভর্তি পরীক্ষার সময়ে এসব বিষয়ে পাসই করতে পারে না। তা হলে কি লাভ হলো এত বই পড়িয়ে আর এত বোঝা কাঁধে চাপিয়ে!

 

শিক্ষা হবে আনন্দের। ভোরবেলা উঠেই বইয়ের ব্যাগের কত কেজি ওজন বহন করা যায়, সেই প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে হবে। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে পাঠদানে যেমন পরিবর্তন হয়েছে, তেমনি পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন বইয়ের বোঝার ক্ষেত্রেও। আঠারো বছর পর্যন্ত শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের উৎকৃষ্ট সময়। এ সময় শিশুর হাড় ও মাংসপেশি থাকে যথেষ্ট নরম।

 

সামান্য আঘাতে অথবা চাপে মেরুদন্ড বেঁকে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। অথচ প্রতিনিয়ত একটি শিশুকে মাত্রারিক্ত ব্যাগের বোঝা বহন করতে হচ্ছে, যে বোঝাটি পিঠে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে হচ্ছে। দীর্ঘদিন ভারী বইয়ের বোঝা কাঁধে বহন করায় শিশুরা আর্থ্রাইটিস ও অস্টিওপোরোসিসের মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ারও শঙ্কা থাকে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য উদ্বেগের কারণ।

 

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) অনুমোদিত ও বিনামূল্যে বিতরণ হওয়া বই ছাড়া শিশুদের কাঁধে অন্য কোনো সহায়ক বইয়ের বোঝা না চাপাতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে নির্দেশ রয়েছে। কিন্ডারগার্টেন ও অধিকাংশ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর শুধু বইয়ের চাপই দিচ্ছে না, করছে অনিয়ম। অতিরিক্ত বই, খাতা, কলম, পোশাক ইত্যাদি কোমলমতি শিশুদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের চেষ্টা একদিকে যেমন অনৈতিক, অন্যদিকে স্বাভাবিক মানসিক বিকাশের পরিপন্থি।

 

সরকারের বিভিন্ন মহলের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও কোনোভাবেই যেন অতিরিক্ত বইয়ের বোঝা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমোদনহীন বই চাপিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে নীতিমালা গ্রহণ করা অপরিহার্য। অভিভাবকরা চান সন্তানকে একটি ভালো স্কুলে পড়াতে। ভালো স্কুল মানে তো অনেক বই থাকতে হবে তা নয়, প্রয়োজন মানসম্পন্ন শিক্ষক দ্বারা ভালো পাঠদান করা।

 

পাশাপাশি আরেকটি বিষয় খুবই ভারাক্রান্ত করে সেটি হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক অসাধুতা। আজকাল বিদ্যালয়ে অযাচিত অনেক বিল নেয়া হচ্ছে। এসব বিষয়ে কথা বলতে কেউ আগ্রহ প্রকাশ করে না। নিজের সামাজিক সুখ্যাতি নষ্ট হওয়া, সন্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি হতে পারে এ রকম নানা কারণে বাবা-মায়েরা নীরব থাকেন।

 

মূল্যস্ফীতির এ সময়ে যেখানে পুষ্টির চাহিদা পূরণ করাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে নার্সারিতে পড়া একটি শিশুর মাসিক বেতন প্রায় চার হাজার টাকা। বিলম্বে পরিশোধ করলে অর্থাৎ পনেরো তারিখের পরে দিলে আরো পঞ্চাশ টাকা জরিমানা। এটা হলো মোটামুটি স্বনামধন্য একটি ইংলিশ ভার্সন স্কুলের চিত্র।

 

বলা হয়েছে মাসিক ফি ১ হাজার ৯শ’ টাকা। কিন্তু প্রায় মাসেই এর সঙ্গে যোগ হয় আইসিটি বিল, গ্যাস বিল, উন্নয়ন তহবিলসহ নানা ধরনের বিল। অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই প্রতিবছর ভর্তিতেও নেয়া হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। অভিভাবক শ্রেণি এসব অরাজকতার কাছে জিম্মি হয়ে গেছে। রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলে ভর্তি এবং বেতন নিয়ে নৈরাজ্য নতুন কিছু নয়। এসবের অবসান আদৌ হবে কিনা জানা নেই। তবে সুপরিকল্পনার মাধ্যমে পাঠদান পদ্ধতির সঙ্গে পরিবর্তন আসা দরকার বইয়ের ব্যাগের বোঝায়ও। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আরো কঠোর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।

 

লেখক : সাংবাদিক

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version