-->

নির্বাচন সামনে রেখে একটি সফল বাজেট প্রণয়ন

মাহফুজুর রহমান
নির্বাচন সামনে রেখে একটি সফল বাজেট প্রণয়ন

শত বিপর্যয়ের মুখে বৃহস্পতিবার বিকেলে সরকারের অর্থমন্ত্রী মহান জাতীয় সংসদে ঘোষণা করেছেন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট। এবারের বাজেটের আকার আগের চেয়েও বড় এবং ‘বড় হয়ে তুমি কী হতে চাও’ ধরনের আবেগমাখা এবং অতিপ্রত্যাশা সমৃদ্ধ।

 

করোনা অতিমারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধে পর্যুদস্ত বিশ্ব অর্থনীতির ধাক্কা, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, ডলার সংকট, রেমিট্যান্সে ঘাটতি, খেলাপি ঋণের উল্লম্ফন, মূল্যস্ফীতি, আমদানির লাগাম টেনে ধরা এবং এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া, প্রাইভেট সেক্টরের প্রবৃদ্ধি রোধ, কর্মসংস্থানের ঘাটতি এবং আরো অনেক সমস্যা বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতির সামনে হিসহিস করে এগিয়ে এসে সকল উন্নয়ন ও আশাবাদকে অনেকটাই ঘিরে ধরেছে; এ রকম একটা সহায়হীন পরিস্থিতিতে নির্বাচনের কর্মসূচিকে সামনে রেখে একটি সফল বাজেট প্রণয়ন করা খুবই কঠিন।

 

আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির শতকরা ১৫ দশমিক ২ ভাগ। বাজেটে প্রস্তাবিত রাজস্ব আয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য উৎস হতে ৭০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

 

অন্যদিকে প্রস্তাবিত ব্যয় বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে মোট ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। প্রস্তাব অনুসারে বাজেট ঘাটতি দাঁড়াবে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির শতকরা ৫ দশমিক ২ ভাগ। এই ঘাটতির মধ্যে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস হতে এবং ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা বৈদেশিক উৎস হতে সংকুলান করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

 

বাজেট বক্তৃতায় সরকারের অর্থমন্ত্রী বিগত দিনে সরকারের সফলতার তথ্য তুলে ধরেন। এর মধ্যে সফল কোভিড নিয়ন্ত্রণ এবং কোভিড-উত্তর প্রণোদনা কার্যক্রম, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ খাতে সবার জন্য সুলভ ও মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা, মা ও শিশুস্বাস্থ্য সুরক্ষা, স্বাস্থ্য শিক্ষা কার্যক্রম, শিক্ষা খাতের অগ্রগতি, কৃষি খাতের উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তা, পতিত জমি আবাদ ও কৃষিপণ্য বহুমুখীকরণ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় স্মার্ট কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের আধুনিকায়ন, সুনীল অর্থনীতি ও সমুদ্রে মৎস্যসম্পদ আহরণের সুযোগ সৃষ্টি, কর্মসংস্থান ও দক্ষতা উন্নয়ন, বৈদেশিক কর্মসংস্থান, সামাজিক সুরক্ষা, নারী উন্নয়ন ও শিশু কল্যাণ, ভৌত অবকাঠামো (বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও যোগাযোগ), তথ্যপ্রযুক্তি, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন, শিল্প ও বাণিজ্য, জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সংরক্ষণ, পরিকল্পিত নগরায়ণ ও আবাসন, আঞ্চলিক ও উপআঞ্চলিক সহযোগিতা, ক্রীড়া, সংস্কৃতি ও ধর্ম ইত্যাদি বিষয়ে অগ্রগতির কথা উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়াও নতুন উদ্যোগ, সংস্কার ও সুশাসন নিয়ে বক্তব্য রেখেছেন। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, গত দেড় দশকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, বৈজ্ঞানিক ও অবকাঠামোসহ সকল ক্ষেত্রে অভ‚তপূর্ব অগ্রগতি সাধন করেছে এবং তার মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের একটা টেকসই ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। আর এজন্য প্রধানমন্ত্রীর চিন্তাপ্রসূত ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গঠনের উদ্যোগসমূহ কার্যকর ভ‚মিকা রাখবে। স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার চারটি মূল স্তম্ভ হচ্ছে স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট সরকার, স্মার্ট সোসাইটি ও স্মার্ট অর্থনীতি।

 

বিগত বছরগুলোতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের অর্থনীতি যে গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল, সেটা বর্তমান পর্যায়ে এসে বেশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। দুর্নীতি, অর্থপাচার এবং মূল্যস্ফীতি সম্ভবত দেশের অর্থনীতির চাকায় শেকল পরিয়ে দেয়ার প্রয়াস চালিয়েছে। দুর্নীতি ও মুদ্রাপাচার নিয়ে এবারের বাজেট যথেষ্ট নিশ্চুপ।

 

বিগত বছরে নামমাত্র কর পরিশোধ সাপেক্ষে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার যে উচ্চকণ্ঠ প্রস্তাব অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় ঘোষণা করেছিলেন, তা বাস্তবায়িত হয়নি; হওয়ার কথাও নয়। যারা এদেশ থেকে অর্থপাচার করেছেন তার সেই টাকা ফিরিয়ে আনার জন্য পাঠাননি। উন্নত দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে পরম সুখে জীবন নির্বাহের জন্যই তারা টাকা পাচার করেছেন।

 

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অন্তর্মুখী রেমিট্যান্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। করোনাপরবর্তী সময়ে যথাযথ কারণেই দেশে রেমিট্যান্স আসার পরিমাণ কমেছে। সরকারও বিভিন্নভাবে উদ্যোগ নিয়ে বিদেশে কর্মী পাঠানোর চেষ্টা করে চলেছে। বর্তমানে বিশ্বের ১৭৬টি দেশে মোট ১ কোটি ৪৯ লাখ বাংলাদেশি কর্মী কর্মরত আছেন। সামাজিক সুরক্ষা খাতে এবার সামান্য কিছু টাকা বাড়ানো হয়েছে।

 

এক্ষেত্রে বয়স্ক ভাতা ১০০ টাকা বাড়িয়ে ৬০০ টাকা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা ৫০ টাকা বাড়িয়ে ৫৫০ টাকা, প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের মাসিক উপবৃত্তি বিভিন্ন পর্যায়ে কিছুটা বাড়িয়ে ৯০০ টাকা ও ৯৫০ টাকা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বর্তমান বাজারমূল্য বিবেচনায় এ পরিমাণ অর্থ কীভাবে এদের মাসব্যাপী সুরক্ষা প্রদান করবে, তা ভাবতেও অবাক লাগছে। এই অর্থের পরিমাণ আরো বাড়ানো আবশ্যক বলেই মনে করি।

 

বর্তমানে সারা দেশে বিদ্যুৎ নিয়ে এক ধরনের হাহাকার চলছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে অনেক এলাকায় শতভাগ বিদ্যুতায়ন সম্পন্ন হয়েছে। গর্ব করে বিভিন্ন এলাকার সাংসদ বা অন্য কোনো গণ্যমান্য ব্যক্তি শতভাগ বিদ্যুতায়িত এলাকা উদ্বোধন করেছেন এবং রাস্তার পাশে বড় করে সাইনবোর্ড লাগিয়ে রেখেছেন। কিন্তু শতভাগ বিদ্যুতায়িত এলাকায় কতভাগ বিদ্যুৎ সরবরাহ যে করা হয় তা পরীক্ষা করে কেউই দেখছেন না।

 

পত্রিকান্তরে জানা যায় যে, সামনের দিনগুলোতে বিদ্যুতের সমস্যা আরো প্রকট হবে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা; ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই খাতের বরাদ্দ প্রায় শতকরা ৩৩ দশমিক ৫৮ ভাগ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এবার কি লোডশেডিংয়ের বিপর্যয় কিছুটা হলেও কমবে?

 

এবারের বাজেটে যথাযথভাবেই করমুক্ত আয়সীমা কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। এক্ষেত্রে পুরুষ করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা ৩ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৩ লাখ, মহিলা ও ৬৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের করদাতাদের সাড়ে ৩ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৪ লাখ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সাথে সর্বনিম্ন করহার ৫ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ করহার ২৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়াও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি করদাতা, গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা করদাতা, তৃতীয় লিঙ্গ করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমাও বাড়ানো হয়েছে।

 

বাজেটে ভ্রমণ কর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভ্রমণ কর বৃদ্ধির প্রস্তাবটি যথাযথ বলেই মনে হয়। তবে ভ্রমণ কর বাড়ানোর ফলে বিদেশ ভ্রমণ কমে যাবে এবং কৃচ্ছ্রসাধন অভ্যাসে পরিণত হবে বলে মনে হয় না। তরুণ সমাজের মানসিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য বিদেশ ভ্রমণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে ডলার সংকটের মুখে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ বা বিদেশে উচ্চশিক্ষা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে আমাদের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। এ ছাড়া স্বর্ণবারসহ অনেকগুলো পণ্যের ক্ষেত্রে কর ও মূসক বাড়ানো বা কমানো হয়েছে যা অযৌক্তিক বলে মনে হয়নি। বিশ্ব অর্থনীতির এই টালমাটাল অবস্থায় ঘোষিত এই নির্বাচনী বাজেট বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার কতটুকু জনকল্যাণ সফল করতে পারে এটাই এখন দেখার বিষয়।

 

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও অর্থনীতির কলাম লেখক

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version