-->

ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের কর্মকান্ড প্রসঙ্গে

বাবুল রবিদাস
ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের কর্মকান্ড প্রসঙ্গে

বাবুল রবিদাস: সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- দেশ গড়ায় ও রক্ষায় সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের ভূমিকা প্রথম ও প্রধান এবং তা সর্বজন স্বীকৃত। কোনো দেশ বা জাতি স্বাধীনতার আলো তখনই দেখেছে, যখন তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের চরম উন্নতি হয়েছে। যে জাতির সাংস্কৃতিক রূপরেখা নেই, সাংস্কৃতিক উন্নতি নেই, সাংস্কৃতিক চর্চা নেই সে জাতির কোনো উন্নতিও হতে পারে না। এমনকি যে জাতি সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে পিছিয়ে আছে, সে জাতি কোনো দিনই স্বাধীনতার আলো দেখতে পায় না।

 

পরাধীনতার গ্লানি নিয়ে তাদের যুগ যুগ ধরে কাটাতে হয়। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ফলেই পৃথিবীর অনেক দেশ, অনেক জাতি স্বাধীনতার সুখ ভোগ করছে এবং উন্নতির চরম শিখরে আরোহন করেছে। দেখা গেছে, সাংস্কৃতিক অনুন্নতির ফলে অনেক দেশ অনেক জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। দেশ গড়া তো দূরের কথা, স্বাধীনতা পর্যন্ত বিপন্ন হয়ে পরাধীনতার নাগপাশে বন্দি হয়ে পড়েছে, হারিয়ে ফেলেছে তাদের জাতীয় সত্তা।

 

বিশেষ করে আমাদের দেশের আদিবাসী তথা ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যারা এককালে বন জঙ্গল কেটে পাহাড় পর্বত কেটে, নদী-নালা, খাল-বিল ভরাট করে দেশ গড়ায় সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল, তারা আজ তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের অভাবে সব থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়েছে। একদা তাদেরও নিজস্ব একটা সাংস্কৃতিক রূপরেখা ছিল; কিন্তু সেগুলোকে তারা চর্চার অভাবে বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি। দেশ গড়ায় ও রক্ষায় তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ভ‚মিকাকে খাটো করে দেখাকে কারো পক্ষেই উচিত হবে না।

 

আদিবাসী তথা ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী জনগণ দেশ গড়ার কাজে প্রথম আত্মনিয়োগ করেছে এবং দেশ রক্ষার জন্য তাদের ভ‚মিকা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। আমাদের দেশে ২৫৫টি আদিবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে এবং তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডও ভিন্ন ভিন্ন। এ দেশে যখন পাক-বাহিনীরা বেপরোয়া হত্যাকান্ড চালাচ্ছিল তখন সবাই বর্ণের সবাই গোত্রের মানুষ একত্র হয়ে তার মোকাবিলা করা কালে বিভিন্ন জাতির সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ উৎসাহ জুগিয়েছিল।

 

বিশেষ করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আঞ্চলিক ভাষায় যেসব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো, তাতে বিভিন্ন বাঙালি ও ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী জাতি উদ্বুদ্ধ হয়েছিল এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ‘চরম পত্র’ নামে একটি অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো যা তখন ছিল বাঙালি জাতিকে জাগানোর মূল মন্ত্র।

 

বিভিন্ন সংগীতে তথা ভাটিয়ালী গান, লোকসংগীত, আঞ্চলিক গান পৌঁছিয়ে দিয়েছিল বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার চরম শিখরে। বিশ্ব কবি কর্তৃক রচিত গান দিয়ে বাঙালি জাতিকে উদ্বুদ্ধ করা হতো; যা পরবর্তীকালে জাতীয় সংগীতে স্থান পায়।

 

আদিবাসী সম্প্রদায় দীর্ঘদিন বাঙালিদের সঙ্গে বসবাস করায় এবং একসঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত হওয়ায় তাদের কিঞ্চিত এক মিশ্র সংস্কৃতির উদ্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর দেশ গড়ার কাজে এবং দেশ রক্ষার কাজে আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের ভূমিকা রয়েছে। আদিবাসীরাও তাদের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে হতাশাগ্রস্ত মানুষের মাঝে প্রাণের সঞ্চার করেছে। মানুষকে আশার আলো দেখিয়েছে, উৎসাহ-উদ্দীপনার সঞ্চার করেছে।

 

সাধারণ মানুষের মাঝে শক্তি সঞ্চার করেছে, বিভিন্ন যাত্রা, নাটক, পালাগান, জারিগান, বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাহায্যে সামাজিক অবক্ষয় দূরীভ‚ত করে নতুনভাবে সমাজ তথা দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেছে। আদিবাসী জনগণ তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেই ক্লান্ত হয়নি, বরং দেশ রক্ষার কাজেও লিপ্ত রয়েছে।

 

বর্তমানে আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিয়েছে। যেমন- আদিবাসীর সাংস্কৃতিক সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা না থাকা, সাংস্কৃতিক চর্চার অভাবে সাংস্কৃতি বিলুপ্ত হওয়ার মতো, কারণ সাংস্কৃতি সংগঠনের অভাব। সমাধানের উপায় হলো- সাংস্কৃতিক সচেতনতা গড়ে তোলা। জেলা, উপজেলা পর্যায়ে এমনকি গ্রাম ভিত্তিক সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলতে হবে।

 

জাতীয় সরকারি প্রচার মাধ্যমে অনুষ্ঠান মালা নিয়মিতভাবে প্রচারের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। সাংস্কৃতিক রক্ষা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়/পি-স্কুলের পাঠ্যসূচিতে সাংস্কৃতিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। ফলে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড বিকশিত হবে এবং দেশ গড়ায় ও রক্ষায় অংশগ্রহণ করে দেশকে এগিয়ে নেয়ার ভূমিকা পালন করতে পারবে।

 

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, অনেক দেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই কিন্তু তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড দূর্বল থাকায় দেশ গড়া তো দূরের কথা স্বাধীনতাই বিপন্ন হয়ে পড়েছে। উদাহরণস্বরূপ পাকিস্তানের কথা বলা যায়-পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল দুটো অংশ নিয়ে। একটি পূর্ব পাকিস্তান, অপরটি পশ্চিম পাকিস্তান। মাঝখানে বিশাল ভারত রাষ্ট্র।

 

পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতির সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের কোনোরূপ মিল ছিল না। শুধু যে অমিল ছিল তা নয়, পশ্চিমা গোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত বাঙালির সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানে বসবাসরত জনগণের চাল-চলন, আচার-ব্যবহার, ভাষাও ছিল ভিন্ন ভিন্ন।

 

কাজেই পাকিস্তানের দুই অংশের সাংস্কৃতিক রূপও ছিল ভিন্নতর। যার ফলে দেশ গড়া ও রক্ষা হওয়া তো দূরের কথা, পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের জন্ম হয়। আজ বাঙালি স্বাধীনভাবে তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড মনের সুখে চালিয়ে যাচ্ছে। কোনো বাধা বিপত্তি নেই এবং পশ্চিমা গোষ্ঠীর হস্তক্ষেপ নেই। নিজের দেশ গড়তে এবং রক্ষা করতে বাঙালিরা তথা সবাই স্তরের লোক আত্মনিয়োগ করেছে। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডই হচ্ছে তার ধারক ও বাহক।

 

বাংলাদেশে যত জনগোষ্ঠীই থাকুক না কেন; সবাই আমরা বাঙালি এবং এই বাঙালি পরিচয়ে বাংলাদেশের জনগণ গর্ববোধ করে। স্বাধীনতা যুদ্ধে সব জনগোষ্ঠী একত্র হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং তার ফলেই অল্প সময়ের মধ্যে স্বাধীনতার সুখ পেয়েছে।

 

স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সমস্ত বাঙালি তার নিজস্ব সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছিল। বিশ্ববাসী দেখেছিল আদিবাসীসহ সবাই বাঙালি একত্র হয়ে পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল এবং বিশ্বের অনেক দেশ খুশি মনে বাঙালিকে তথা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। আজ স্বাধীন বাংলায় বাঙালিরা সবাই জাতিভেদ ভুলে গিয়ে একত্রিত হয়ে বাংলাদেশ গড়ায় এবং রক্ষায় নিজ নিজ সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড তুলে ধরতে সক্ষম।

 

এমন বাঙালিরা তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে দেশ গড়ায় ও রক্ষায় ব্যস্ত এবং তাদের মাতৃভাষা বাংলাকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে। বাংলাদেশ এখন অনেক এগিয়ে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে।

 

বাংলাদেশ সরকার সাংস্কৃতির বিষয় চিন্তা-ভাবনা করে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের লক্ষ্যে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিধান প্রণয়নকল্পে প্রণিত আইন তৈরি করেছেন। আইনটির নাম-ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন-২০১০।

 

সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে মানুষকে যত দ্রুত উদ্বুদ্ধ করা যায় অন্য কোনো কার্যক্রমের মাধ্যমে তা করা যায় না। যুদ্ধের সময় দেখা যায়, সৈনিকদের মধ্যে এবং জনগণের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনা বা শক্তি সঞ্চার করার জন্য বীর রসের গান, কবিতা আবৃত্তি প্রচার করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে প্রচারিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছিল, শক্তি ও সাহস জুগিয়েছিল, বাঙালিকে একত্রিত করেছিল, বিশ্ববাসীকে অবগত করিয়েছিল বলেই আমাদের ন্যায্য দাবি আদায় করতে পেরেছিলাম।

 

যার ফলে মাত্র ৯ মাসে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল এবং পাকিস্তানি বাহিনী পরাজিত হয়েছিল। এখন দেশ গড়া ও রক্ষার জন্য সমাজের সবাই স্তরের জনগণ মনোযোগী হয়েছে এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এখন স্লোগান হয়েছে কাউকে পেছনে ফেলে উন্নয়ন নয়।

 

সমাজের উন্নয়নের মধ্য দিয়ে যেমন দেশের উন্নয়ন, তেমনি সাংস্কৃতিক উন্নয়ন মানেই একটি জাতির উন্নয়ন। সাংস্কৃতিক দিক থেকে একটি জাতি অনুন্নত থাকলে সেই জাতি পৃথিবীর বুকে সহজে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না।

 

সংস্কৃতির প্রধান বাহন হিসেবে সংগীতকে চিহ্নিত করা যায়। যেহেতু স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন বিভিন্ন শিল্পী, সাহিত্যিক তাদের সংগীতের মাধ্যমে দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করে ঘুমন্ত মানুষগুলোকে জাগিয়ে তুলেছিল। সংস্কৃতি একটি জাতির পূর্ণ পরিচয় বহন করে, এটি একটি জাতি বা সম্প্রদায়ের মূল সত্তা একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বোধ। প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নিজ নিজ সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পালন, উন্নয়ন ও সংরক্ষণ করা পবিত্র দায়িত্ব।

 

তবে সংস্কৃতিতে কোনো খারাপ দিক বা অবৈজ্ঞানিক কোনো বিষয় থাকলে তা অবশ্যই বর্জন করা উচিত, যদি কোনো ভালো দিক থাকে যা উন্নয়নমুখী কল্যাণকর এবং দেশ গড়ায় এবং রক্ষায় সহায়ক ভ‚মিকা পালন করে তা অবশ্যই গ্রহণ ও উৎসাহিত করা উচিৎ। তাই আমরা বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলতে পারি, দেশ গড়ায় ও রক্ষায় সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই মোটেই।

 

লেখক : আইনজীবী, জজকোর্ট, জয়পুরহাট

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version