-->

খাদ্যপণ্যে সিন্ডিকেট

নাজনীন বেগম
খাদ্যপণ্যে সিন্ডিকেট

নাজনীন বেগম: সামনে ইবাদতের মাস পবিত্র রমজান। ইতোমধ্যে পালিত শবে মেরাজের মতো পুণ্য রজনী আমাদের ধর্মীয় ভাবানুভূতির অনন্য এক দৃষ্টান্ত, পরম করুণাময়ের সঙ্গে নবী করিম (স.) এর নিবিড় সান্নিধ্যের ঘটনা। অভাবনীয় ধর্মীয় ভাবগম্ভীরে ইবাদতের মাস রমজান সর্ববিধ আবেদনে সংশ্লিষ্টদের জাগিয়ে তোলা। মাসটা শুধু নামাজ রোজার মাহাত্ম্যে মহিমান্বিত হয় তা কিন্তু নয়, খাদ্যাভাসেও আসে এক নতুনতর আমেজ।

 

খাবারের সময় হেরফের হওয়াও রমজানের গভীরতম তাৎপর্য। সেহেরি আর ইফতারের মিলন দ্যোতনায় পুরো মাস সবাইকে ধর্মীয় অনুভবে উদ্বুদ্ধ করতে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, পবিত্র রমজান উপলক্ষে দেশের জনগোষ্ঠীর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক বেড়ে যায়, যা তাদের ওপর সৃষ্টি করে অসহনীয় চাপ।

 

এই মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বেশি অস্থির করে তুলছে নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্য। এমন চিত্র প্রতিবছরই দেখা যায়। এতে সাধারণ মানুষদের অবস্থা হয় দিশাহীন। ২০২৩ সালকে স্বাগত জানাতে হরেক কর্মসূচির মধ্যে খাদ্যপণ্যের দাম দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাওয়া এক অনাকাক্সিক্ষত প্রতিকূল পরিবেশ। সাধারণত নিত্যপণ্যের দাম একবার বাড়লে পরবর্তীতে তা কমতে দেখা যায় না।

 

এ অবস্থায় নতুন করে আবারও পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে অতি সাধারণ মানুষরের নাভিশ্বাস হওয়ার দশা। হচ্ছেও তাই। নতুন বছরের সূচনালগ্নে গণমাধ্যমে ছাপা হয়েছে রমজানের আগেই মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা। সুযোগ পেলেই দ্রব্যমূল্য বাড়ানোর পাঁয়তারা শুরু করে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। তাদের সব সময় শ্যেনদৃষ্টি থাকে বিশেষ বিশেষ সময়ে কিভাবে দ্রব্যমূল্যকে লাগামহীন করা যায়।

 

বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে উঠে এসেছে খাদ্যপণ্যের দাম কিছুটা সহনীয় থাকলেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খরচের মূল্য বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন কঠিন হয়ে উঠেছে, যা সংশ্লিষ্টদের ভাবিয়ে তুলছে। ফলে, তাদের সাংসারিক জীবনযাপনে বাধ্যতামূলক কৃচ্ছ্রসাধন করতে হচ্ছে।

 

রমজানের আগেই এগুলোর দাম বৃদ্ধিতে সামনে কি অবস্থা হবে ভাবাই যাচ্ছে না। কোমলমতি শিশু-কিশোরদের খাদ্যাভাসে যদি শরীর ও মন গড়ার মূল ব্যবস্থাপনার ওপর কুচক্রী মহলের বিপরীত ছায়ায় অন্ধকার নেমে আসে, তাহলে উদীয়মান বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম কিভাবে মানসিক সক্ষমতা ও শারীরিক শক্তি সামর্থ্য নিয়ে সুস্থ নাগরিক হিসেবে নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যাবে? যারা খাদ্যসংকট না থাকার পরও অকারণে অপ্রয়োজনের নিত্য আহার সামগ্রিকে সংশ্লিষ্টদের ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে যায়, তারা কেন যে অধরা থেকে যাচ্ছে বলা মুশকিল। সিন্ডিকেটের অপকৌশল আর শক্তি আসলে কত?

 

বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে আসছে অতি সাধারণ মানুষের আমিষের অনন্য নিয়ামক শক্তি ব্রয়লার মুরগি ও ডিম। শুধু তাই নয়, এই দুটো উপাদেয়, সুস্বাদু, পুষ্টিকর খাদ্য শিশু, অসুস্থ এবং বয়স্ক মানুষদের প্রোটিনেরও অন্যতম উৎস। আর কুচক্রীমহল এই দুটি অত্যাবশ্যক পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়িয়েছে। সত্যিই এই মুহূর্তে খাদ্যপণ্যে আগুন জ্বলছে। খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার আশ্বস্থ করছেন এই মুহূর্তে দেশে কোনো খাদ্য সংকট নেই। খাদ্যমন্ত্রী জানান, কোটি দরিদ্র পরিবারের মাঝে প্রতিমাসে সরকার ১০ কেজি চাল বিনামূল্যে সরবরাহ করবে।

 

এছাড়া ওএমএসের মাধ্যমে ট্রাকভর্তি খাদ্যপণ্য সরবরাহও বাড়ানোর ইঙ্গিত এসেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। এমন সব ইতিবাচক সংবাদের পরও বাস্তবে নিম্ন আয়ের মানুষ সবক্ষেত্রে দৈন্যদশার শিকার হচ্ছে। বিশেষ করে যারা মজুরি শ্রমিক, দৈনিক আয় করে নিত্যসংসার চালাতে হয়, তাদের অবস্থা শোচনীয়। যা মূলত গ্রামেগঞ্জে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেশি দেখা যায়। এখন গ্রামীণ নারীরা উৎপাদনের বহুমাত্রিক ক্ষেত্রে যুগোপযোগী অবদান রাখছেন যা স্বস্তিদায়ক। তবে সেখানেও আড়ালে আবডালে চলে বৈষম্যমূলক বেতন ভাতা। এটাও নতুন কোনো বিষয় নয়।

 

শস্য-শ্যামল, উর্বর কৃষি উৎপাদনের দেশ হিসেবে আবহমান বাংলার পরম সুখ্যাতি সেই পুরাকাল থেকে। আধুনিকতার নির্মাল্যেও সেখানে কোনো ঘাটতি তৈরি হওয়ার পরিবর্তে নিত্যনতুন ফলন প্রক্রিয়ায় উৎপাদনের যে অবধারিত গতিপ্রবাহ, সেটা এখন পর্যন্ত ‘মাছে ভাতে বাঙালি’র প্রবাদ বাক্যটির মর্যাদা সুরক্ষিত রেখেছে। ধান, সবজি ও মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের সম্মান এখন আন্তর্জাতিক বলয়েও। নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে বিভিন্ন কৃষিজাত পণ্য বিদেশেও রপ্তানিও হয়। এতে যথেষ্ট পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে দেশ।

 

উত্তরবঙ্গের এক সময়ের মঙ্গা বিভিন্ন অঞ্চলেও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার চিত্র স্বস্তিদায়ক। প্রয়োজনে সরকার কিছু ঘাটতি পণ্য বিদেশ থেকে আমদানিও করে, যা গণমাধ্যমে উঠে আসে। মূলকথা, সব সামাল দিয়ে দেশে খাদ্য সংস্থান সরবরাহ করতে পারা দেশ ও জাতির জন্য শুভযোগ। সেখানে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের মুনাফা লাভের আসক্তির প্রবাহে যদি লাগাম টেনে ধরা যেত, সাধারণ মানুষের নিত্যজীবনের সংকট থেকে বেরনোও সহজ হয়ে যেত।

 

তবে টিসিবির পণ্যও বাজারে সরবরাহের তথ্য সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিলেও কার্যক্রমে তা সংশ্লিষ্টদের পক্ষে না পাওয়ার চক্রান্তও দৃশ্যমান হতে থাকে।

 

ন্যায্যমূল্যে দৈনন্দিন পণ্য বিক্রিই নয়, বরং হতদরিদ্র এক কোটি পরিবারের মাঝে কার্ড বিতরণও শুরু করার ইঙ্গিত এসেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। সবই যে সুষ্ঠু ও নির্বিঘ্ন ভাবে এগিয়ে যায় তা কিন্তু নয়। বরং বিপরীত চিত্রও হতদরিদ্রের দুর্ভাগ্যে যেন চেপে বসে।

 

রমজান আসার আগেই কীভাবে দুই দফা নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি করে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট তা জনস্বার্থে খতিয়ে দেখা জরুরি। রমজানের আগাম প্রস্তুতি হিসেবে সরকার ইতোমধ্যে সয়াবিন তেল আমদানি করার উদ্যোগ নিয়েছে।

 

প্রতিবছর পবিত্র বন্দেগির মাসে খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির অপকৌশল ধর্মীয় তাৎপর্যকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে যাচ্ছে। ব্যবসায়ী কুচক্রী মহল তাদের অশুভ পাঁয়তারায় যে মাত্রায় বাজার ব্যবস্থাপনাকে কুক্ষিগত করে রেখেছে, সেখান থেকে উদ্ধারের পথ নির্দেশিত না হলে সমস্যা যেই গভীর সেই তিমিরেই থেকে যাবে।

 

ইতোমধ্যে সরকার অতিরিক্ত খাদ্য মজুতের বিরুদ্ধে কঠোর নীতিমালা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ‘মৃত্যুদন্ড’ নির্ধারণ করা হয়েছে। শুধু শাস্তি দিয়ে সব অপরাধে দন্ড দেয়া যায় না। বরং মানবিকতা, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা, নীতিনৈতিকতায় অপরাধ প্রবণতাকে প্রবলভাবে ঠেকানোর কার্যক্রম সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সাড়া জাগাতে পারে।

 

লেখক : সাংবাদিক

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version