-->

বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার প্রস্তাব দীর্ঘদিনের

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার প্রস্তাব দীর্ঘদিনের

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ: ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ২০০ বছর ব্রিটিশ কলোনিয়াল শাসনের অবসান হয়ে দেশ ভাগ হয় ধর্মের ভিত্তিতে। বাংলা ভাষার পরিবর্তে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে চাপিয়ে দেয়া হলে শুরু হয় অসন্তোষ। অসন্তোষ ক্রমে আন্দোলনে পরিণত হতে থাকে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত চলে আন্দোলনের প্রস্তুতি। অবশেষে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ লাভ করে।

 

জাতিসংঘ, ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪- বিশ্বমঞ্চে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্ম উৎসর্গকারীদের অভিবাদন, বাংলাদেশকে সমর্থন দেয়া সব দেশ ও জনগণের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে মাতৃভাষা বাংলায় অবিস্মরণীয় এক বক্তৃতা করেন বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

 

জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের ৮ দিনের মাথায় সাধু ভাষায় দেয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ছিল সমগ্র বিশ্বের অধিকারবঞ্চিত নির্যাতিত-নিষ্পেষিত মানুষের ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠা ও বিশ্বশান্তি, ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠার বলিষ্ঠ উচ্চারণ ও সাহসী পদক্ষেপ।

 

ইতোমধ্যেই জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বক্তৃতা দেয়ার সময় পেরিয়ে গেছে ৪৮ বছর। বাংলাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মর্যাদার আসনে। মহান একুশে ফেব্রুয়ারি পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি। বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার প্রস্তাব দীর্ঘদিনের।

 

সংশ্লিষ্টদের মতে, দাবি আদায়ের পথেই হাঁটছে বাংলাদেশ। এজন্য সংস্থাটির সব নথিপত্র অনুবাদের বিশাল খরচ মেটাতে হবে বাংলাদেশকেই। প্রয়োজন নিজ দেশে সর্বস্তরে মাতৃভাষা চালু। সেই সঙ্গে জরুরি বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন আদায়। পথ যতই দুর্গম হোক, দাবি আদায়ে প্রত্যয়ী বাংলাদেশ- যা সময়ের ব্যাপার মাত্র।

 

১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক ২১ ফেব্রæয়ারি দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পর থেকে বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক ব্যাপ্তি লাভ করে। যদিও এর আগে ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের ৩০তম অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

 

আরও পেছনে ফিরে গেলে রবীন্দ্রনাথের নোবেল কিংবা সত্যজিৎ রায়ের অস্কার জয়ের কথা বলতে হয়। তবে মূলত গত এক দশক ধরে বাংলাদেশে ও বিদেশে থাকা বাংলাদেশিদের মধ্যে বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার দাবিটি জোরালো হচ্ছে।

 

জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদা পেতে সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়ম নেই। জাতিসংঘ চার্টারের গঠনতন্ত্রেও কোনো নির্দেশনা ছিল না। এমনকি জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষাগুলো জনসংখ্যার ভিত্তিতে সঠিক প্রতিনিধিত্ব করে না। বর্তমানে ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্তির দৌড়ে বাংলার পাশাপাশি রয়েছে পর্তুগিজ, জার্মান, ইতালিয়ান, জাপানিজ, হিন্দি ও উর্দু।

 

প্রত্যেকেরই রয়েছে নিজস্ব যুক্তি। জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বক্তৃতার ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করেন এবং জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলাকে সপ্তম দাপ্তরিক ভাষা করার আনুষ্ঠানিক দাবি তুলেছেন একাধিকবার।

 

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল বিজয়, বিশ্ববাঙালি সত্যজিৎ রায়ের অস্কার পুরস্কার, বিজ্ঞানী সত্যেন বোসের বোসন কণা, আচার্য জগদীশ বসুর গাছের প্রাণ আবিষ্কার বিশ্বজুড়ে বাঙালিকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। তবে গবেষকদের মতে, এসব প্রাপ্তির ধারাবাহিকতায় সবচেয়ে বড় অর্জন বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন।

 

ভাষার জন্য রক্তে রাজপথ রাঙিয়ে বাঙালিরা সারাবিশ্বে ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করেছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে একাত্তরে বিজয় অর্জন, জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর বাংলায় ভাষণ, ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতিসংঘে এসব তথ্য তুলে ধরে বাংলা ভাষার গুরুত্ব বোঝাতে হবে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, বিশ্বের সব মাতৃভাষা রক্ষায় ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব তুলে ধরে বাংলা ভাষাসহ বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর প্রতি বাংলাকে সমর্থনের আহব্বান জানাতে হবে। জাতিসংঘের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা পেতে ২০০৯ সালে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ, পশ্চিমবঙ্গের বিধান সভায় প্রস্তাবটির সমর্থনে একই ধরনের প্রস্তাব পাস করা হয়েছে।

 

সমর্থন মিলেছে অন্যান্য ভাষাভাষী অঞ্চল থেকেও। ২০০২ সালে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ সিয়েরা লিওনে অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার নাম ঘোষণা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে দাবি আদায়ের পথেই হাঁটছে বাংলাদেশ।

 

জনসংখ্যার ভিত্তিতে ভাষাগত অবস্থান বিবেচনায় হিন্দির অবস্থান ৪র্থ হলেও কেন এটি সপ্তম ভাষা হিসেবে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হবে না? আবার ৬ষ্ঠ স্থানে থাকা বাংলা ভাষা ও ৭ম স্থানে থাকা পর্তুগিজ ভাষাকে বাদ দিয়ে ৮ম স্থানে থাকা রুশ ভাষা কীভাবে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদা পেয়ে গেল? সমীকরণ মিলাতে গেলে আরো গভীর বিশ্লেষণ করতে হবে, মূলত হিন্দি ভাষাভাষীর সংখ্যা আরবির চেয়ে বেশি হলেও ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে ইংরেজি ভাষা ব্যবহৃত হয়।

 

সেই অর্থে হিন্দি ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী বেশি হলেও প্রায়োগিক অর্থে হিন্দি ভাষার ব্যবহার আরবির চেয়ে কম। ভারতের মোট জনসংখ্যার ৫৩ শতাংশ হিন্দি ভাষায় কথা বলে এবং ভারতে কোনো ভাষাই জাতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃত নয়। হিন্দিকে ভারতে বলা হয় দাপ্তরিক ভাষা আর ইংরেজি দ্বিতীয় দাপ্তরিক ভাষা।

 

বাংলা ভাষার অবস্থান বিশ্বে ষষ্ঠ হলেও এ ভাষাটি মাত্র ৩টি দেশের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, অন্যদিকে রুশ ভাষার অবস্থান ৮ম হলেও বিশ্বের ৩৮টি দেশের দাপ্তরিক ভাষা রুশ।

 

বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার প্রস্তুতি নিলেই হবে না এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখে বাংলা ভাষাকে নিরাপত্তা পরিষদের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এ প্রক্রিয়াটি অনেক দীর্ঘ ও জটিল হলেও অসম্ভব নয়। জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষার প্রতিযোগিতায় হিন্দি, বাংলা ভাষার প্রতিদ্ব›দ্বী নয় কারণ বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলেও ভারতের কোনো রাষ্ট্রভাষা নেই। ভারতে ২২টি ভাষাই দাপ্তরিক।

 

বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন ভাষা ‘অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ’ হিসেবে ব্যবহৃত হয় আবার অনেক রাজ্যে ইংরেজি ভাষা ব্যবহৃত হয়। সে অর্থে ভারত জাতিসংঘে সপ্তম ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দৌড়ে পিছিয়ে থাকবে। জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে দাবিটি কিন্তু বাংলাদেশ সরকারকেই আনুষ্ঠানিকভাবে সাধারণ পরিষদে উত্থাপন করে রেজুলেশন আনতে হবে।

 

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত বাংলাদেশের দাবিটির প্রতি অন্য সদস্য রাষ্ট্রের সমর্থন থাকলেই বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে অন্তুর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। তবে তার আগে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সব ডকুমেন্ট বা দলিল বাংলায় অনুবাদ করার ব্যয়ভার বহন করার জন্য সম্মত হতে হবে।

 

জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হওয়ার আগে প্রয়োজন সর্বস্তরে মাতৃভাষা চালু। নতুবা সবই ভেস্তে যাবে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস করা হয়েছে কিন্তু সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর স্বপ্ন এখনো সফল হয়নি। স্বাধীন দেশে উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্তরা নানাভাবে ঔপনিবেশিক রাজভাষা ইংরেজি চালু রেখেছে কিন্তু পরিশ্রম করে রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে সর্বস্তরে চালু করার প্রয়োজন বোধ করেনি কেউ। যে কারণে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার ক্ষেত্রে এখনো বাংলা অনেক পিছিয়ে রয়েছে।

 

রক্তে অর্জিত ভাষা অনেক আগেই জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হওয়া উচিত ছিল; কিন্তু সর্বস্তরে মাতৃভাষা চালু হওয়ার স্বপ্নই যেখানে অধরা রয়ে গেছে, জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হওয়ার ক্ষেত্রে অনেক দূর হাঁটতে হবে। এজন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি। এ নিয়ে আরও সংগ্রাম করতে হবে। জগাখিচুড়ি ভাষা বন্ধ করে প্রমিত উচ্চারণে কথা বলা প্রয়োজন।

 

অন্যদিকে কিছু শব্দ ইংরেজি ও অন্যান্য পরিভাষা থেকে নেয়া যায়, এতে দোষের কিছু নয়; তবে সব শব্দ ধার করা নয়। ভাষার ক্ষেত্রে যেমন রক্ষণশীলতা, গোঁড়ামি চলবে না তেমনি মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা-উপেক্ষা করা চলবে না। বাংলা ভাষার আছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। বিজ্ঞান বিশেষত- চিকিৎসা বিজ্ঞানে অনেক আগ থেকেই বাংলা ভাষার চর্চা হচ্ছে। আদালতের রায়ে বাংলা চালু হওয়াও অসম্ভবের কিছু না। বাংলা ভাষার ঐতিহ্য ও সাহিত্যিক সমৃদ্ধিকে আড়াল করে রাখা নেহাত বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়।

 

বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে সঙ্গত কারণেই আজ প্রশ্নের উদ্ভব হচ্ছে। বাংলা ভাষা- জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার আর কত দূর? কোনো ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষার স্বীকৃতি প্রদান অর্থের সূচকে কেন? আমরা তো জানি- বাংলা ভাষার পথ ধরেই মাতৃভাষা আন্তর্জাতিকতা লাভ করে বিশ্ব মহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

 

বিশ্ব সাহিত্য সংস্কৃতির আসরে বাংলা ভাষার অবস্থা ও অবস্থান সুদৃঢ় পর্যায়ে। তাহলে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় বাংলা ভাষা এত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি কেন হবে? তবে আমরা আশাবাদী যে, বিশ্বায়নের এই জটিল প্রক্রিয়া একদিন অবসান হবে এবং বাংলা ভাষাও জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে- তা শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র।

 

লেখক: সাবেক উপমহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version