-->

ভাষা শহীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা হয়নি কেন?

সাজ্জাদ কাদির
ভাষা শহীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা হয়নি কেন?

সাজ্জাদ কাদির: বছর ঘুরে আবারো এসেছে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। প্রায় এক দশক যাবৎ চলা ভাষা আন্দোলনের চ‚ড়ান্ত বহির্প্রকাশ ঘটে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হওয়ার মাধ্যমে। এই আন্দোলনে আমরা সবচেয়ে বেশি শুনতে পারি সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও শফিউর এই পাঁচজন শহীদের নাম। এর বাইরে আর কে কোথায় শহীদ হয়েছেন তা খুব একটা জানা যায় না।

 

জানতে হলে আমাদের তখনকার পত্রপত্রিকা বা ভাষা আন্দোলন নিয়ে লেখা বইপত্রের পাতা উল্টাতে হয়। এ ছাড়াও সেই সময়ের প্রত্যক্ষদর্শী ভাষা সংগ্রামীদের জবানিতে জানতে হয়। দুঃখের বিষয়, প্রত্যক্ষদর্শী ভাষা সংগ্রামীদের প্রায় সবাই এরই মধ্যে মারা গেছেন। সীমিত যে কয়েকজন জীবিত আছেন তাঁরা বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত, স্মৃতিভ্রষ্ট প্রায়। পৃথিবীর নিয়মে আর অল্প দিনের মধ্যে তাঁদেরকেও আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলি, কয়েক বছর ধরে ভাষার মাস উপলক্ষে টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য কোনো ভাষা সংগ্রামীকে খুঁজে পাচ্ছি না।

 

চরম দুঃখের বিষয়, মহান ভাষা আন্দোলনের এত বছর পরও ভাষা শহীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা হয়নি। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, ১৯৫২ সালের ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে পুলিশ বাহিনীর নির্বিচার গুলিতে বহু লোক নিহত হলেও তারা সবাই স্বীকৃতি পাননি। এ দুঃখ আমাদের আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। কারণ, দিন যত যাচ্ছে ইতিহাস ততই দূরে সরে যাচ্ছে।

 

পাকিস্তান সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন ফোরামে শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের উদ্যোগে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার হীনপ্রচেষ্টা চলে। এতে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এক ছাত্র সভার আয়োজন করে। সভার পরও মিছিল-প্রতিবাদ অব্যাহত থাকে। এ মাসেরই শেষদিকে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়, যার আহব্বায়ক ছিলেন তমদ্দুন মজলিশের অধ্যাপক নূরুল হক ভূইয়া।

 

পরের বছর ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে পরিষদ সদস্যদের উর্দু বা ইংরেজিতে বক্তৃতা দেয়ার প্রস্তাব করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের কংগ্রেস দলের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এ প্রস্তাবে সংশোধনী এনে বাংলাকেও পরিষদের অন্যতম ভাষা করার দাবি জানান। তিনি বলেন, পাকিস্তানের ৬ কোটি ৯০ লাখ মানুষের মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লাখই পূর্ব পাকিস্তানের, যাদের মাতৃভাষা বাংলা।

 

কিন্তু প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এবং পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন বিরোধিতা করলে এ দাবি বাতিল হয়ে যায়। এ খবর ঢাকায় পৌঁছলে ছাত্রসমাজ, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকরা বিক্ষুব্ধ হন। আজাদের মতো পত্রিকাও ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আনা প্রস্তাবের যারা বিরোধিতা করেছিল তাদের সমালোচনা করে।

 

পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র সাত মাস পর ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল, গণপরিষদের সভাপতি এবং মুসলিম লিগেরও সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। সেটিই ছিল তার জীবনে প্রথম ও শেষবারের সফর। নয় দিনের পূর্ববঙ্গ সফরে তিনি ঢাকা ও চট্টগ্রামে কয়েকটি জনসভায় বক্তৃতা দেন। ঢাকায় প্রথম সভাটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ, ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে যা এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।

 

এতে তিনি স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হবে উর্দু- অন্য কোনো ভাষা নয়। এর ঠিক কয়েকদিন পরেই ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বলেন, উর্দু হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, অন্য কোনো ভাষা নয়। তিনি হয়তো ভাবেনওনি যে, এখানে এসে তার উচ্চারিত বক্তব্য এক সময় তারই প্রতিষ্ঠিত নতুন দেশটির ভাঙন ডেকে আনতে ভূমিকা রাখবে। কিন্তু শেষ পরিণতি তাই হয়েছিল।

 

কালক্রমে নানা ঘটনায় ভাষার অধিকার স্বীকৃত হয়ে একটি স্বাধীন ভূখন্ডের দিকে ধাবিত হয় সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলা। একাত্তরে যার চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে বাংলাদেশের জন্মের মাধ্যমে। কিন্তু সেই জিন্নাহ আগুনে তুষ ছিটিয়ে দিয়ে এসবের কিছুই আর দেখে যেতে পারেননি ওই বছরেরই ১১ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করার কারণে।

 

পাকিস্তানের জন্মের আগে থেকেই রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। কিন্তু ১৯৪৭ সালের পর রাষ্ট্রভাষাকে কেন্দ্র করে পূর্ব বাংলার রাজনীতি উত্তপ্ত হতে শুরু করে। এর কেন্দ্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পাকিস্তানে মুসলিম লীগের কার্যকলাপে হতাশ, বলা যায় পাকিস্তান সৃষ্টির স্বপ্ন ভঙ্গ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম তরুণরা ততদিনে সংগঠিত হওয়া শুরু করে। যার কারণে যেকোনো অন্যায় ও অন্যায্য বিধিবিধান প্রণয়নের বিরুদ্ধে প্রেক্ষাপট তৈরিই ছিল।

 

এ থেকে মুক্তি দরকার, সেটি বাঙালিরা বুঝতে পেরেছিল খুব অল্প সময়ের মধ্যে। ভাষার দাবি আদায় হতে না হতেই সামনে চলে আসে নানা রকম বৈষম্য। একের পর এক অন্যায়, অত্যাচার, বৈষম্য বাঙালিকে ইস্পাত কঠিন করে তোলে। এই কঠিন অবস্থা ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে একটি স্বাধীন ভূখন্ড বাংলাদেশ রূপ লাভ করে।

 

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রক্তপাতের যে ঘটনা ঘটেছিল, সেই দিনটিকে স্মরণ করে আমরা প্রতিবছর মাতৃভাষা দিবস পালন করি। ভাষা শহীদদের স্মরণ করি। সেই দিনটি এখন আর শুধু বাংলাদেশের বাংলাভাষী মানুষের মধ্যেই সীমিত নেই। এটি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরে বসবাসরত দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম প্রাথমিক উদ্যোক্তা হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে ১৯৯৮ সালে।

 

১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। এতে ১৮৮টি দেশ সমর্থন জানালে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্যদেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে।

 

বাঙালির জীবনে ফেব্রুয়ারি এলে ভাষা শহীদদের শোককে শক্তিতে পরিণত করার একটি প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। সারাদেশে মাসব্যাপী চলে নানা কর্মযজ্ঞ। আর এই পুরো মাসটিজুড়ে দেশের আনাচে-কানাচে বেজে ওঠে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত, শহীদ আলতাফ মাহমুদ সুরারোপিত গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। এ যেন এই মাসের এক অনন্য থিম সং। এ মাসে রাজধানী ঢাকায় বাংলা একাডেমির উদ্যোগে আয়োজিত হয় অমর একুশে বইমেলা, যা স্বাধীন বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মেলাগুলোর অন্যতম।

 

এই বইগুলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রথম সৃষ্টি। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি একাই বইমেলা চালিয়ে গেছেন। ১৯৭৬ সালে অন্যরা অণুপ্রাণিত হন। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক ড. আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমিকে মেলার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন। ১৯৭৯ সালে মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি। এই সংস্থাটিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা।

 

১৯৮৩ সালে কাজী মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে বাংলা একাডেমিতে প্রথম একাডেমির উদ্যোগে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র আয়োজনের উদ্যোগ নেন। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষা ভবনের সামনে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে ট্রাক তুলে দিলে দুজন ছাত্র নিহত হয়। ওই মর্মান্তিক ঘটনার পর সেই বছর আর বইমেলা করা সম্ভব হয়নি।

 

১৯৮৪ সালে সাড়ম্বরে বর্তমানের অমর একুশে বইমেলার সূচনা হয়। সেই ৩২টি বইয়ের ক্ষুদ্র মেলা কালানুক্রমে বাঙালির সবচেয়ে স্বনামধন্য বইমেলায় পরিণত হয়েছে বর্তমানে। আনন্দের বিষয়, ফেব্রুয়ারি মাসের এই বইমেলা এখন নানা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে।

 

ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছরে এসে বলতেই হয় এটি ছিল বাঙালির এক সুবিশাল অর্জন। ভাষার দাবিতে প্রথম আন্দোলনটি যদি না হতো, তাহলে বাঙালি নিজেকে এত সহজে চিনতে পারত বলে মনে হয় না। ভাষার পথ বেয়েই সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পৃথক রাষ্ট্রের অন্দোলন সূচিত হয়। যার পরিণতি নিজেদের মতো করে বাঁচার লড়াই। সে লড়াইয়েও বিজয়ী হয়ে ১৯৭১ সালে অর্জিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। কাজেই ফেব্রুয়ারি মাস এবং অমর একুশ আমাদের এক অন্তহীন গৌরবের বিষয়।

লেখক : তথ্যচিত্র, টিভি অনুষ্ঠান নির্মাতা

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version