-->

নগরে শিশু স্বাস্থ্য ব্যবস্থা

ডা. মো. শামীম হায়দার তালুকদার
নগরে শিশু স্বাস্থ্য ব্যবস্থা

ডা. মো. শামীম হায়দার তালুকদার: রহিমা বেগম গ্রামের মেয়ে। গ্রামে শুধু অভাব আর অভাব, তাই গ্রামে থাকা হয় না তার। বিয়ের পর স্বামীর সাথে শহরে চলে আসে। নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। থাকে খুলনা মেট্রোপলিটন এলাকায়। স্বামী সবুজ মিয়া গ্রামে কাজের ব্যবস্থা করতে না পেরে শহরে এসে এখন ভ্রাম্যমাণ সবজি বিক্রেতা। হঠাৎ এক দিন ব্যথা শুরু হয় রহিমার। বাসার কাছাকাছি কোনো স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র না থাকায় স্বামী তাকে কাছেই একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে যায়। ক্লিনিকের ডাক্তাররা পরীক্ষা করে জানান সিজার করতে হবে। একটা ফুটফুটে সন্তানের মা হয় রহিমা। কিন্তু ক্লিনিকের বিল মেটাতে গিয়ে বিপদে পড়ে রহিমা-সবুজ দম্পতি। বিক্রি করতে হয় রহিমার স্বর্ণের চেইন। শেষ হয়ে যায় তাদের তিলে তিলে জমানো আয়ের সবটুকু। ম্লান হয়ে আসে সন্তান জন্মের খুশি।

 

দ্রুত নগরায়ন এবং স্বাস্থ্য বৈষম্য সমসাময়িক উন্নয়নশীল বিশ্বের দুটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। শহরের জনগণের হাতের নাগালে অনেক সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে জীবনযাত্রার মানে বৈষম্য দেখা যায়। ফলে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিতে অসমতা লক্ষ্য করা যায়। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সূচি হলো- স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সমতা অর্জন এবং পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশু মৃত্যুহার হ্রাস করা।

 

ইউনিসেফ জানিয়েছে, বাংলাদেশে পঞ্চম জন্মদিন পেরিয়েছে এমন শিশুদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বর্তমানে আগের তুলনায় বেশি। ১৯৯০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে শিশুমৃত্যুর হার প্রায় অর্ধেকে নেমে গেছে, যার অর্থ হলো অনেক অনেক শিশুর জীবন বাঁচানো সম্ভব হয়েছে। বেশিরভাগ শিশুর মৃত্যু হয় জীবনের প্রথম দিন বা সপ্তাহে। জন্মের সময় যথাযথ সেবা ও যত্নের অভাব অথবা দক্ষ সেবা কর্মী না থাকার কারণে নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনাগুলো ঘটে। বাংলাদেশে সন্তান জন্মদানের প্রতি ১০টি ঘটনার মধ্যে ৬টি সম্পাদিত হয় দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর তত্ত্বাবধানে, যা বিশ্বের সর্বনিম্ন হারগুলোর অন্যতম। বাংলাদেশে ৫ বছর বয়সের আগে যেসব শিশু মৃত্যুবরণ করে দুই-তৃতীয়াংশ শিশুর মৃত্যু হয় নবজাতক হিসেবে। এ ছাড়া নিউমোনিয়া, পানিতে ডুবে যাওয়া, শ্বাসযন্ত্রের রোগ ও অপুষ্টিজনিত কারণে পাঁচ বছরের কম বয়সি অনেক শিশু মারা যায়। প্রতি বছর বিভিন্ন রোগ থেকে বাঁচাতে ৩৮ লাখ শিশুর জন্য টিকা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। তবে শহরের বস্তি ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী শিশুরা প্রয়োজনীয় টিকা সাধারণত কম পায়। শহরের বস্তিগুলোতে গর্ভবতী মায়েরা প্রায়ই পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা পান না, প্রসবপূর্ব দুর্বল পরিচর্যা, প্রসবকালীন পরিচর্যার অভাব এবং কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের সক্ষমতার অভাবের কারণে মাতৃগর্ভে শিশু স্বাস্থ্য এবং নবজাতকের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকে ।

 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৮,০০,৪৮৬ জন মানুষ বস্তিতে বসবাস করে। আর ২২,১৮৫ জন রয়েছে ভাসমান জনগোষ্ঠী। শহরাঞ্চলে শিশু-মহিলা অনুপাত ২৯৫ । অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল এই জনগোষ্ঠী মূলতঃ নির্ভর করে সরকারি পর্যায়ের চিকিৎসাকেন্দ্রের ওপর। নগর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা স্থানীয় সরকার, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীনে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় ১৯৯৮ থেকে শুরু করে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রদান করা হবে এই সেবা। বর্তমানে বিভিন্ন সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা মিলে মোট ৪৫টি এলাকায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র রয়েছে। তার মধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে ১৫টি, চট্টগ্রাম ও গাজীপুরে তিনটি করে, রাজশাহী, খুলনা ও নারায়ণগঞ্জে দুটি করে এবং বাকি ১১টি শহরে একটি করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র রয়েছে । এখানে শিশু ও মায়েদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হয়। যদিও জনসংখ্যা অনুপাতে এ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলো নেহায়েতই অপ্রতুল। সরকারের পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের অধীনে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে আরো ১১১টি মা ও শিশু কল্যাণকেন্দ্র রয়েছে । এসব মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রগুলোতে উপচেপড়া ভিড় বলে দেয় এসব কেন্দ্রের জনপ্রিয়তা সম্পর্কে। ঢাকার কমলাপুরের বস্তিতে থাকে হালিমা খাতুন। গৃহকর্মীর কাজ করে। স্বামী রিকশাচালক। দুটি কন্যাসন্তানের পর আবার গর্ভবতী হালিমা। বেলা ১০টা বা সাড়ে ১০টা হবে এমন সময় ব্যথা ওঠে হালিমা বেগমের। স্বামী সেই সকালে রিকশা নিয়ে বেরিয়েছে। মায়ের অবস্থা খারাপ দেখে মেয়ে বারবার ফোন করে বাবাকে। কিন্তু বাবার কোনো সাড়া নেই। উপায়ান্তু না দেখে দুই মেয়েকে নিয়ে আজিমপুর মেটারনিটিতে রওনা করে হালিমা। এক দিন পরই নতুন শিশুকে নিয়ে হাসিমুখে ঘরে ফেরে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের খরচ আর সেবা দুটিতেই অনেক সন্তুষ্ট হালিমা।

 

এ ছাড়া উন্নয়ন সংস্থাগুলোর কিছু কিছু প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র আছে। প্রথমেই বলতে হয় মেরিস্টপসের কথা। ১৯৮৮ সাল থেকে বাংলাদেশে প্রজনন স্বাস্থ্য পরিসেবার ওপর তাদের কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে সারা দেশে ৩০০ সেবাকেন্দ্রের মাধ্যমে মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শ ও সেবা প্রদান করছে মেরিস্টপস । ইউএসএইডের আর্থিক সহায়তায় ‘সূর্যের হাসি’ ১৯৯৭ সাল থেকে সারা দেশে স্বল্প খরচে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে। বর্তমানে সারা দেশে তাদের ১৩৪টি ক্লিনিক আছে। ব্র্যাক তাদের ‘মানসি’ প্রজেক্টের মাধ্যমে শহরের বস্তিগুলোতে নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করছে । বাংলাদেশে নারী ও শিশু স্বাস্থ্যসেবায় ও মৃত্যুহার হ্রাসে ওজিএসবির ভূমিকা অপরিসীম। ওজিএসবির তত্ত্বাবধানে ঢাকার মিরপুরে দুটি হাসপাতাল আছে। সেখানে বহির্বিভাগে স্বল্পমূল্যে মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়। আন্তঃবিভাগও আছে যেখানে অন্যান্য বেসরকারি হাসপাতালের তুলনায় কম খরচে রোগী ভর্তি হতে পারে। সঙ্গে রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থাও রেখেছে তারা ।

 

প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার বিষয়ে সেবা দিচ্ছে আই পাস । ইউনিসেফের আর্থিক সহায়তায় ঢাকা বিভাগের চারটি সিটি করপোরেশনে ‘আলো’ ক্লিনিক চালু হয়েছে। কাগজের অপচয় রোধে এই হাসপাতালগুলোতে ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এখানে মা ও শিশু স্বাস্থ্য, বয়ঃসন্ধিকালীন স্বাস্থ্য, প্রতিবন্ধী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের সেবা দেয়া হয়। সেবার মধ্যে আছে প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য শিক্ষা, পরামর্শ ও টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা । ডিজিটাল এ উদ্যোগটি সবার প্রশংসা কুড়িয়েছে।

 

নিম্নবিত্ত মা, নবজাতক ও শিশুদের জন্য মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির সুযোগ বাড়াতে স্টেকহোল্ডাররা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। তারা মনে করে কমিউনিটি পর্যায়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করার মাধ্যমে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনে সরকারকে কাজ করতে হবে। সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রেখে মা, নবজাতক, শিশু ও কিশোরীদের জন্য মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে নগরের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো দরকার। শিশু ও নারীরা যাতে তাদের স্বাস্থ্য ও সামগ্রিক কল্যাণ বিষয়ে ভালোভাবে জানতে পারে তা নিশ্চিত করতে কাজ করতে হবে।

 

শিশু মৃত্যু হ্রাস, খর্বাকৃতি শিশু জন্ম হার হ্রাসসহ সব সূচকে এগিয়ে যাবে দেশ। পুষ্টি নিশ্চিত হবে প্রতিটি শিশুর। অসুস্থ হলে সমতার ভিত্তিতে বিনামূল্যে পাবে মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা। শিশু আনন্দমেলায় দেশ ভরে উঠবে। বিজ্ঞজনের এই অভিমতের সাথে আমরাও সহমত প্রকাশ করি।

 

লেখক : সিইও, এমিনেন্স অ্যাসোসিয়েট ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট

 

মন্তব্য

Beta version