-->

পঞ্চাশের বাংলাদেশ এবং আগামীর অর্থনৈতিক রূপরেখা

মুজতবা আহমেদ মুরশেদ
পঞ্চাশের বাংলাদেশ এবং আগামীর অর্থনৈতিক রূপরেখা

মুজতবা আহমেদ মুরশেদ: স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ পঞ্চাশ বছর পূর্ণ করেছে। এ দীর্ঘসময়ে রাষ্ট্র হিসেবে আমরা এগিয়ে এসেছি অনেক দূর। যদিও আমাদের প্রতিদিনের চাহিদা, চিন্তা এবং বাস্তবায়ন বাস্তবতার সঙ্গে ফারাকও বিস্তর। তবু আমাদের সামনে সুন্দর ভবিষ্যৎ হাতছানি দিচ্ছে। সেদিকে মনোযোগ দিয়ে আমরা সুবিশাল উন্নতির লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করছি। সেই উন্নতিতে পৌঁছতে হলে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্ব¡পূর্ণ হলোÑ ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য পঞ্চাশ বছরের একটি উন্নয়ন রূপরেখা তৈরি করা। এমন একটা অর্থনৈতিক ম্যাপ, যা বাংলাদেশকে সমসাময়িক বা অর্থনৈতিকভাবে সমমানের প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে একটা শক্তিশালী কাঠামোয় দাঁড় করাতে পারে।

 

আমরা জানি, এখান থেকে আগামী কুড়ি বছরের জন্য আমাদের সরকারের ভিষণ ২০২০-৪১ এর একটা লক্ষ্যমাত্রা আছে। কিন্তু আগামী পঞ্চাশ বছরের কথা যদি ভাবা যায়, তাহলে ২০৪১-এর পরের ত্রিশ বছর থেকে তেমন কোনো নকশা খুঁজে পাওয়া যাবে না। অতএব এখনই পরবর্তী শিল্পায়নের পরিকল্পনার ছক তৈরি করা জরুরি। বর্তমান টেকনোলজির যুগে সবকিছু দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক বা গ্লোবাল পর্যায়ে নির্দিষ্ট করে কেউ যদি বর্তমানের জায়গা থেকে পররে পঞ্চাশ বছরে তার কাক্সিক্ষত জায়গায় যেতে চায়, তার জন্য একটি রূপরেখা প্রস্তুত করা মনে হয় প্রায় অসম্ভব। সেটা প্রণয়ন চিন্তা বাস্তবসম্মত হবে না। সেই আকাক্সক্ষাটাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করার জন্য কিছু ধাপ অনুসরণ করে কাজ করতে হবে। এ করতে পারলে, সেটা গ্রহণযোগ্য হবে অথবা বাস্তবে রূপ নেবে।

 

চলমান বাজার ব্যবস্থা একটু বিশ্লেষণ করলে আমরা বুঝতে পারব এ দ্রুত পরিবর্তনশীল টেকনোলজির সময়ে নোকিয়া আজ বাজার হারিয়েছে। এখনকার গাড়িগুলোর পাশাপাশি অনেক গাড়ি রূপান্তরিত হয়ে ইলেকট্রনিক গাড়ি হয়ে রাস্তায়। দেখা যাবে পাঁচ বছরের ভেতর আস্তে আস্তে উন্নত দেশের সব গাড়ি ইলেকট্রনিক হয়ে যাওয়ার পথে যাত্রা শুরু করেছে। সে গাড়িগুলোয় পেট্রল বা ডিজেল লাগবে না। পেট্রল বা ডিজেল ছাড়াই চলবে। অথবা ধরা যাক, রোবোটিক্সের উন্নতি হয়েছে এবং সেটি অনেক গুরুত্ব পাচ্ছে। তার ফলে ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে বাংলাদেশের অন্য ইন্ডাস্ট্রিগুলোয় রোবোটিক্সের ব্যবহার শুরু হয়েছে। এই যে পরিবর্তন, তার প্রতি খেয়াল রাখা জরুরি। উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে চ্যালেঞ্জগুলো উপস্থিত, সেগুলো এখন খুব বেশি আগে-ভাগে চিহ্নিত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আজকাল সুপার কম্পিউটার ব্যবহারের করে অনেক কিছু নির্ণয় করার চেষ্টা আছে। যদিও এটা ব্যবহারের কথা আগে ভাবা সম্ভব ছিল না। তবে এর ব্যবহার এখন খুবই স্বাভাবিক বিষয়। উন্নয়নের আধুনিক ধারায় টেকনোলজির প্রয়োগ করে এগোতে গেলে সরকারের রাজনৈতিক দর্শনকে মজবুত ও সুদূরপ্রসারী করা প্রয়োজন। আধুনিক প্রক্রিয়ায় উন্নয়ন করতে চাইলে একটি গণতান্ত্রিক এবং উন্নয়নধর্মী রাজনৈতিক দর্শন প্রণয়ন অপরিহার্য। এ দর্শন নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে এসডিজির ১৭টি বিষয়কে কাজে লাগিয়ে সমন্বিত করতে হবে।

 

বর্তমানে বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে রূপান্তরিত হওয়ার দিকে এগোচ্ছে। একটি উন্নত দেশ হিসেবে আমাদের দেশকে বিকশিত করতে হলে আরো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। সে পথ বেশ দুরূহ। বাংলাদেশকে উন্নত দেশের মর্যাদায় নিতে গেলে, সে চ্যালেঞ্জ কীভাবে সরকার মোকাবিলা করবে? এর উত্তরে বলা ভালো, এটির ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিনতম কাজ। কেননা এখানে অনেক পরনির্ভরশীল উপাদান ভূমিকা রাখে। এদের মাঝে অনেক উপাদান মূল শক্তি হয়ে পরিচালকের ভূমিকা গ্রহণ করবে। সেক্ষেত্রে কোনো পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া যদি চলমান রাখতে হয়, তার প্রয়োজনমতো যদি অর্থনৈতিক গতিপথ পরিবর্তন করতে হয়, তাহলে সেটাকে খাপ খাইয়ে নিতে হবে সমাজ কাঠামোয় যে চাহিদা, তার সঙ্গে। সেজন্য কিছু চলমান ধারায় সংস্কার প্রক্রিয়া অপরিহার্য। এ ধারা ধরেই চলতে হবে। কারণ যেকোনো সংস্কার পরিবর্তনশীল। অতীতে যে সংস্কার করা হয়েছে, সেগুলো হয়তো দু-চার-পাঁচ বছর পর্যন্ত চলবে এবং এরপর আবার নতুন সমস্যা আসবে। তখন নতুন সংস্কার করার পথ ধরতে হবে ও সংস্কার করতে হবে।

 

সারা বিশ্বে উন্নয়ন প্রক্রিয়াবলির ধাপে যদি বিশ্ব শিক্ষাব্যবস্থাবলি বা স্বাস্থ্যব্যবস্থা সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনার কথা বলি, তবে জনস্বাস্থ্যে বিশ্বজুড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১ নম্বরে। অথচ করোনার সময়ে সে দেশেই কী বিপর্যয় দেখা গেল। তাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা করোনার সমেয় অর্থহীন প্রমাণিত হয়েছে। এশিয়ার মধ্যে বেশ বড় একটি অর্থনৈতিক দেশ ভারত। অথচ করোনার সময়ে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাগুলো মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে ভয়াবহ দুরবস্থার মধ্যে তাকে পড়তে হয়েছে। অসহায় অবস্থায় সারা পৃথিবী থেকে জরুরি সাহায্য নিতে হয়েছে। এরপর একটা সময়ে সামলে নিয়েছে। কী করে তা হলো? ওই দেশেগুলোর সরকার দ্রুতগতিতে সংস্কারের দিকে ধাবিত ছিল। এটি সত্য, মহামারি পৃথিবীতে বহুবার এসেছে। বহু আগে এবং হয়তো কোনো কোনো ক্ষেত্রে কখনো বারবার ফিরে এসেছে। মানুষ সেটা জয়ও করেছে। এক্ষেত্রেও তাই হবে এবং হয়েছে। অর্থাৎ বিশ্বে নানা সময়ে নানা আঘাত আসবে এবং তা মোকাবিলাও করতে হবে। বলতে চাচ্ছি, যা এখন উপস্থিত নেই, তা আগামীতে আঘাত হানবে না এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। বাংলাদেশের আগামী উন্নয়ন মানচিত্রে অমোন অদৃশ্য বা অপ্রত্যাশিত ঘটনা পঞ্চাশ বছর পর আসতেও পারে এবং তা মোকাবিলা করার মতো হাইপোথেটিক্যাল পরিকল্পনাও এখনি একটি ফ্রেমে নিতে হবে। মূলত সঠিক মাপে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হওয়া স্বপ্ন হলেও সহজ কোনো বিষয় নয়। কিন্তু এর কোনো সহজ সমাধান নেই। তার কারণ হচ্ছে, এ জায়গাটা অর্জন করার জন্য যে শর্ত পূরণ করা দরকার, সেগুলো আসলেই করা হচ্ছে কিনা বা তা পূরণ করার জন্য কাজ করা হচ্ছে কিনা, সেগুলো প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন এবং কোনো কোনো জায়গায় সেটা সরকার করতে পারছে কিনা, তার ওপর চোখ রাখা এবং সমাধানে চেষ্টার ত্রুটি না রাখাও পরিকল্পনার একটি বিশেষ ধাপ।

 

আমরা জানি, উন্নয়ন মানেই শিল্পায়ন। শিল্পায়নের সঙ্গে কর্মসংস্থানের বিষয়টি চলে আসে। উন্নয়ন করতে গিয়ে ব্যাপক কর্মসংস্থান করেছে আমাদের কাছের অনেক দেশ। থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশ উন্নয়নশীল দেশ হয়েছে অনেক আগে। সেখান থেকে উন্নত দেশের স্তরে পৌঁছেছে শুধু দক্ষিণ কোরিয়া এবং তাইওয়ান। অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট সময়ের পরে ওপরের দিকে যাওয়াটা কঠিন। মাথাপিছু আয় বাড়ানোটা অনেক শক্ত। একটি দেশে প্রথম দিকে মাথাপিছু আয় বাড়ানোর ধাপটা সহজ হলেও, পরবর্তী সময়ে এর অনেক গিরিখাত রয়েছে। অনেক পূর্বশর্ত পালন করার ক্ষেত্রে আর সেই পথ আর সহজ থাকে না। ১ হাজার ২০০ ডলার থেকে ১৪ হাজার ডলারে উপনিত হতে অনেক কাজ করতে হবে। অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে এবং মনে করি অবশ্যই তা অসম্ভব নয়।

 

এই যে কাজ করতে হবে অনেক। কাঠখড় পোড়াতে হবে মেলা। সেখানে আমাদের সরকারের পরিকল্পনাধীন ১০০ অর্থনৈতিক জোন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত এবং তার বাস্তবায়ন প্রয়োজন। এখন দেখা দরকার, এসব অর্থনৈতিক জোন বিকাশে অর্থনৈতিক রোডম্যাপ সঠিক করে এগোচ্ছে কিনা। এটির পর্যবেক্ষণ কিংবা মূল্যায়ন করতে হলে অতীতে ফিরতে হবে। কারণ অতীত অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করেই মূলত বর্তমান এবং বর্তমানের ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যৎটা মানুষ রচনা করে। বাংলাদেশে বা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে শিল্পায়নটা শুরু হয় অর্থাৎ বড় একটা শিল্পের কাজ শুরু হয় আমাদের দেশে ১৯৩৭ সালে। সিলেটের ছাতকে তখন ২ লাখ ৩০ হাজার টন উৎপাদন সক্ষমতার আসাম-বেঙ্গল সিমেন্ট ফ্যাক্টরি হয়। যেটি পুরো পশ্চিমবাংলাসহ আসাম-বাংলাদেশের এ অঞ্চলে সর্ব বৃহৎ সিমেন্ট মিল ছিল। ১৯৩৭ সালে ২ লাখ ৩০ হাজার টন উৎপাদন থাকলেও কয়েক বছর আগে সেখানে উৎপাদন হচ্ছিল মাত্র ২৭ হাজার টন। তাদের উৎপাদন সক্ষমতা অনেক কমে গেল।

 

অন্যদিকে বাংলাদেশে লাখ লাখ টন উৎপাদন ক্ষমতার সিমেন্ট মিল চালু অথচ এ কাজ করতে আমাদের প্রাইভেট সেক্টরে সিমেন্ট খাত থেকে শুরু করে কোনো শিল্পই স্থাপনের বড় কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। যেহেতু মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ব্যক্তি মালিকানাধীন খাতে বিকাশের জায়গাটা অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক, সেই প্রতিযোগিতামূলক প্রতিবেশ কাজে লাগানোর সুযোগটা অনেক বেশি। এক্ষত্রে অমোন মানসিক চিন্তার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করে আমাদের শিল্প মালিকরা সাহসে এগিয়েছেন। প্রতিযোগিতামূলক প্রতিবেশকে কাজে লাগিয়ে উৎপাদন বাড়িয়েছেন। অথচ সরকারি সেক্টরে সুযোগ-সুবিধা সহজে পেলেও তারা ক্রমান্বয়ে ভালো ফল করতে পারোনি। ক্রমান্বয়ে খারাপ অবস্থার দিকে গিয়েছে। শুধু কী সিমেন্ট কারখানার গল্প! সরকারি খাতে এমন অনেক উদাহরণ আছে। যেমন বিটিআরসি, বিজিএমসি, বিসিআইসি, বাংলাদেশ লিবারেল ফুড ইন্ড্রাস্টিজ করপোরেশন- এগুলোও এগোতে পারেনি। অর্থাৎ শিল্পকারখানা শুধু স্থাপন করলেই হবে না। এটিকে স্থায়িত্ব দিতে হবে এবং এর জন্য যে পরিবেশ তৈরি করা দরকার, যে ধারার শিল্পকারখানা সংস্কৃতি তৈরি করা দরকার; তা না হলে বাংলাদেশকে উন্নয়নের সঠিক ধারায় নিতে পারা একটি অলঙ্ঘনীয় চ্যালেঞ্জ।

 

লেখক : উপদেষ্টা সম্পাদক, দৈনিক ভোরের আকাশ, কবি, কথাসাহিত্যিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version