-->

দূষিত সমাজের সংশোধন দরকার

মুজতবা আহমেদ মুরশেদ
দূষিত সমাজের সংশোধন দরকার

রাষ্ট্রে আনন্দে বাস করতে নাগরিকদের জন্য অনেক ইতিবাচক অনুষঙ্গ প্রয়োজন হয়। মৌলিক এবং স্বাভাবিক নিরাপত্তা বোধ, উন্নত নৈতিকতার অনুকরণীয় সরণি, শিক্ষা ব্যবস্থায় সন্তানদের জন্য যথার্থভাবে শিক্ষিত হয়ে ওঠার সময়োপযোগী কার্যক্রম- এসবই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক জীবনে মৌলিক আর্থিক সঙ্গতির পাশাপাশি। কিন্তু আমাদের সামনে চলমান সময়ে প্রত্যক্ষ করছি, বাংলাদেশের আর্থিক শক্তি ক্রমশ বাড়ছে। তবুও জনগণের ভেতর নিয়মিত নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা, আর জীবনযাপনের সুর-তাল-লয় কেটে যাওয়ার মতো অনুভব প্রবল। কিন্তু কেন এমন বোধ? ক্ষমতার প্রান্তিক সারিতে থাকা মানুষেরা নিজের পকেটে হাত দিয়ে টাকার অস্তিত্ব টের পাওয়ার পরও কেন ভাবে, তারা ভালো নাই? পত্রিকা পড়ে মন খারাপ করে প্রতিনিয়ত? এত যন্ত্রণার ছাপ, এত প্রকাশিত অত্যাচারে গল্প পথে-প্রান্তরে ছড়িয়ে সবার কাছে!

 

একাধিক প্রশ্ন তখন মনের কোণে উঁকি দেয়। এ সমাজে বৈরী আঁধার কি হয়ে উঠছে প্রবল? ক্রমশ অচেনা হয়ে উঠছে কি আমাদের সমাজ? এক ভিন্ন অবয়বের ধনী আঁধার কি অনেক ক্ষমতাধর, দাপুটে এখন? আপন অন্তর ভুবনে আসন পেতে থাকা বিস্তৃত অলিন্দগুলো কি পরাজিত আলোর কোনো ইঙ্গিতে উঠছে কুঁকড়ে? আমার চারদিকে এখন কি, কেন অভিশম্পাতের ছোবল উদ্যত?

 

এসব প্রশ্নের মীমাংশিত উত্তর প্রত্যাশা করেও তারা বহু দূরে মায়ায় কুয়াশার চাদর জড়িয়ে অস্পষ্ট। সুতরাং কোথাও কোনো স্থিরতা নাই। কিন্তু আমি তো অনেকের সাথে গ্রন্থিত হয়ে পেতে চাই একটি বন্ধুত্বপূর্ণ আঁধার, যেখান থেকে ভোরের নদীতে বকের ডানায় প্রথম প্রভাতের ছলকে ওঠা আলোর রোশনাই দেখব। কে দেবে আমাকে, আমাদেরকে? নেতারা বলেছিল দেব। আমাদের সংবিধান বলেছিল, ’নাও, বাধা নেই।’ তবুও যখন আমি পত্রিকা মেলি সাতসকালে, ভারি হয় মন। এত খুন, এত ধর্ষণ, এত চুরি আর মানুষের অধিকার লঙ্ঘনের খবর কখনো তো দেখিনি এই দেশে! যে মাটির শ্যামলিমায় গান গাইব, সে মাটিতে প্রকাশ্যে মানুষ কোপানোর বিষণ্ন দাগ লাগে। যে স্কুল ঘরে পাঠে নিমগ্ন হবো, সেখানে কিছু শিক্ষকের হাতে তারই নারী শিক্ষার্থী ধর্ষণের উন্মত্ত ছাপ। যে মাদ্রাসায় পবিত্র কোরআন পাকের নুরে নিজেকে স্নাত করতে আপন কন্যা আর পুত্রকে পাঠাই, সেই সব ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও আমাদের সন্তানেরা নিরাপদ নয়। সে মাদ্রাসায় আমার কন্যা তারই শিক্ষক দ্বারা অত্যাচারিত, ধর্ষিত।

 

কেন এমন হবে? যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমাদের সন্তানেরা ধর্মীয় শিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত হবে, নিজেকে গড়ে তুলবে নৈতিকতায় উন্নত সঠিক মানব সন্তান। কিন্তু সে তারই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হচ্ছে ধর্ষিত, বলাৎকারের শিকার। এমন পরিস্থিতিতে এখনো দেখিনি কোথাও যে, মাদ্রাসা বোর্ডের নেতারা বা কওমি মাদ্রাসার নেতৃত্বস্থানীয় মওলানা সাহেবেরা কঠোর বিবৃতি প্রদান করেছেন এই বলে, তারা ওইসব মাদ্রাসার ধর্ষক শিক্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শান্তি চান। তারা প্রবল প্রতিবাদে পথেও নামেনি। কিন্তু কেন এ অবক্ষয়? কেন এ জাহান্নামের আগুনে তাদের হাত পোড়া? কোন জবাব কোনোদিক থেকে কেউ সঠিক করে দেয় না।

 

এসব দেখে বুকের ভেতর পাথর চাপা কান্না। কখনো বোবা হয়ে উঠছে সময়। কার কাছে যাব? আইনের কাছে? আদালতের কাছে? সেখানেও বিপত্তি। পত্রিকায় যখন দেখি, পুলিশের কাঠামোতে কেউ কেউ অপরাধে যুক্ত, তখন মন খারাপ হয়ে যায়। তাহলে আমরা কার কাছে যাব। আমাদের নিরাপত্তা কে দেবে? নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ বাহিনীর কাছে রাষ্ট্র যে ক্ষমতা দিয়েছে, সে কি তার অপব্যবহার করছে না! দুষ্টকে লালন করেছে, আদর করেছে তাদেরকে দমনের বিপরীতে। কিন্তু এমন তো কথা ছিল না। এমন তো আমাদের পুলিশ বাহিনীর শপথ তাদেরকে শেখায় না।

 

এসব ভাবনায় প্রবল হাহাকার ঘূর্ণি হয়ে ওঠে আমাদের চারদিকে। রাজনীতি করা আমাদের নেতারা বলেছিলেন, আমাদের, সাধারণের আয় বাড়বে। তা বেড়েছে। তারা বলেছেন, আমাদের সাধারণদের গৃহ হবে সুখের নন্দন। হ্যাঁ, আমাদের অনেকের গৃহ হয়েছে। সুদৃশ্য গৃহও আছে আমাদের অনেকের। নেতারা বলেছে বারম্বার, ‘আমাদের পথ হবে, আমার এগিয়ে চলার নিরাপত্তায় অনন্য।’ জনগণের সামগ্রিক সুরক্ষায় একই সুরে সংবিধান ১৫নং ধারায় বলেছে, ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তির ক্রমবৃদ্ধিসাধন এবং জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতিসাধন, যাহাতে নাগরিকদের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ অর্জন নিশ্চিত করা যায়:

 

(ক) অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা;
(খ) কর্মের অধিকার, অর্থাৎ কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করিয়া যুক্তিসঙ্গত মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার;
(গ) যুক্তিসঙ্গত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশের অধিকার; এবং
(ঘ) সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতাপিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আয়ত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্যলাভের অধিকার।

 

এটা তো উন্নত জীবনযাপন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে লিখিত এবং মৌলিক ভিত্তি। তবু কি পাই এসব আমরা? যদি পেয়ে যেতাম আমরা, সাধারণেরা; তবে এ দেশে কেমনে ঋণখেলাপি গজায়? জনগণের ব্যাংক হতে ক্ষমতার দাপটে, বা অপরাধের পথ ধরে সুকৌশলে অর্থকড়ি নিজের পকেটে ভরছে কেউ এবং এরপর ফেরত দেওয়ার নাম-নিশানা নেই। ব্যাংকগুলো খোকলা হয়ে উঠছে। ঋণখেলাপিদের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। মাঝে মঝে তাদের তালিকা প্রকাশ পায়, রাঘববোয়ালদের নাম জানা যায় না। দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ সোয়া লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। গত জুন শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। গত মার্চে যা ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। ফলে ৩ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১১ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা। আগস্টের প্রথম দিকে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণসংক্রান্ত হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। একদিকে যেমন ঋণখেলাপির তালিকা লম্বা, অন্যদিকে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশি লোকদের টাকা জমার পরিমাণ বাড়ছে। এখানে কি কোন যোগসূত্র আছে? ঘটনাচক্রের দৃশ্য ঠিক এ রকম- সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে গত বছরের জুলাই থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত মাত্র ১২ মাসে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থ জমা করেছেন তারা। সব মিলিয়ে সুইস ব্যাংকগুলোতে এখন বাংলাদেশিদের টাকার পরিমাণ ৮ হাজার ২৭৫ কোটি। যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ।

 

সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) প্রকাশিত ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড-২০২১’ বার্ষিক প্রতিবেদন সবার সামনে। বাংলাদেশিদের অর্থ জমার এ তথ্য এতে ওঠে এসেছে। দেশে যখন টাকা পাচার ঠেকানোর তোড়জোড়, তখন নজিরবিহীন গতিতে সুইস ব্যাংকে টাকা জমিয়েছেন বাংলাদেশিরা। গত এক বছরে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ প্রায় ৫৫ শতাংশ বেড়েছে। ২০২১ সাল শেষে দেশটির ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ আগের বছরের ৫৬ কোটি ৩০ লাখ সুইস ফ্রাঁ থেকে বেড়ে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ হয়েছে। বর্তমান বিনিময় হার (১ সুইস ফ্রাঁ = ৯৫ টাকা ৮০ পয়সা) হিসাবে বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৮ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা। টাকার হিসাবে ২০২০ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের ৫ হাজার ২০৩ কোটি টাকা জমা ছিল।

 

এ দেশের ঋণখেলাপি বা সুইস ব্যাংকে অর্থ জমানোয় একটি মিলিত ছন্দ আছে, একই বেহালায় ঝংকৃত সুর আছে। যে সুর আমরা সাধারণেরা ধরতে পারি না। আমরা তা ভাঙতে পারি না। কেন পারি না? কেননা, অমন অপরাধ করা মানুষেরা কিন্তু কেউ মধ্যবিত্ত পরিবারের নয়, নয় তারা কৃষকের সন্তান, কেউ তারা কুলি-মজুরও নয়। সবাই বিত্ত-বৈভবের মালিক। তাদের আরও চাই এবং তারা রাষ্ট্রের মানুষের পকেট কেটে রাষ্ট্রের কোষাগার সুকৌশলে ছিদ্র করে নিজের পকেটে তা ঢোকায়। এই যে তারা যখন এ কাণ্ডটি করে, তখন তারা সবাই একটি সুনিপুণ পরিশুদ্ধ অপরাধ কর্ম করে, প্রতারণার আশ্রয় নেয় এবং তাতে সহায়তা করে কারা? বলাবাহুল্য, সব বুঝদার আরা রাষ্ট্র্র কাঠামোর বৃহৎ কুরসিতে বসে থাকা মহাশয়গণ।

 

আর এমন প্রক্রিয়ায় লাখো যোদ্ধার রক্তস্নাত বাংলাদেশে জনগণকে দেয়া সংবিধানের ওয়াদা, জনগণের কাছে খেলাপি হয়ে ওঠে। তখন ব্যথিত হয়ে ওঠে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরলোকে বাস করা আত্মা। ব্যথিত হয়ে পরে পবিত্র সংবিধানের ধারাগুলো। আর সাধারণ জনগণ অনুভব করে বাংলাদেশে মাথা পিছু আয় বাড়লেও, সে অর্থে আমাদের কোনো ভাগ নাই। আমাদের তো দিন আনতে পান্তা ফুরোয় অর্থ কেলেংকারি করা অপরাধীদের অনৈতিক দাম্ভিকতায় সমাজে নৈতিকতার ভিত্তি দুর্বল গেছে বলে। তাহলে এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় কি? কী করে জনগণ তার সাংবিধানিক অধিকার ফিরে পেতে পারে আপন মঙ্গলাকাক্সক্ষায়? কি করে এ দূষিত সমাজের সংশোধন করা যায়? তখন মনে হয় পষ্ট উচ্চারণ দরকার- ঋণখেলাপি, লুটেরাদের সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করা জরুরি। অনেক জরুরি হলো সঠিক ধারায় সাধারণ মানুষের জীবন মানের উন্নয়ন।

 

লেখক : উপদেষ্টা সম্পাদক, দৈনিক ভোরের আকাশ, কবি, কথাসাহিত্যিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version