-->

শারদের বিষাদকাব্য : জলছবিতে মৃত্যু দেখি

ওমর ফারুক শামীম
শারদের বিষাদকাব্য : জলছবিতে মৃত্যু দেখি

কালের শোক বুকে নিয়ে নিরবধি বয়ে চলছে করতোয়া-সুগন্ধা-পদ্মা, বুড়িগঙ্গা আর মেঘনা। অজস্র মানুষের স্বজন হারানোর বেদনাভরা দীর্ঘশ্বাস বংশপরম্পরায় এ নদীগুলোতে এসেই পড়ছে এবং পড়বে। মানুষের মৃত্যু চিরসত্য এবং অবধারিত। তবে সেই মৃত্যু স্বাভাবিক আর অস্বাভাবিক এই পার্থক্যে স্বজনের শোককে কমবেশি ভারি করে তোলে।

 

প্রিয়জনের অস্বাভাবিক মৃত্যু যে কতটা অসহনীয় শোকের তা কেবল স্বজন হারানোরাই জানেন। শোকের ব্যথা স্বজন ছাড়া অন্য কারোরই পরিমাপ করার ক্ষমতা নেই। পঞ্চগড়ের করতোয়ায় সলিলসমাধি হওয়া প্রায় ৭৩ জন মানুষের স্বজনরা এই শোক কীভাবে কাটিয়ে উঠছেন? যাদের কাছে উৎসবই এক দুঃসময় হয়ে উঠেছে, তারা কীভাবে এই সময় পার করছেন? রাষ্ট্র বা সমাজ তাদের কতটুকু সহায়তা দিয়েছেন তাও আজ প্রশ্নসাপেক্ষ।

 

গত ২৫ সেপ্টেম্বরের নৌকাডুবিতে অকল্পনীয় মৃত্যু সংখ্যা স্তম্ভিত করেছে দেশবাসীকে। অল্প প্রস্তের ছোট্ট নদী পারাপারে এমন মৃত্যুসংখ্যা দেশবাসীকে কখনোই গুনতে হয়নি। সেই লাশের মিছিলে সংখ্যা ছিল ৬৯, নিখোঁজ রয়েছে আরও চারজন।

 

২০২১ সালের ২৪ ডিসেম্বর মধ্যরাতে ঘটেছিল ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে আরেক ট্র্যাজেডি। লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায় ৪০টি তাজাপ্রাণ। কী বীভৎস আর মর্মান্তিক ছিল সে দৃশ্য তা বর্ণনাযোগ্য নয়। লঞ্চে এমন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা দেশের ইতিহাসে প্রথম। সে ঘটনায় এক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সস্ত্রীক বেঁচে ফিরেছিলেন। তার বেঁচে ফেরার ঘটনা প্রচার আর এক উচ্চ নাগরিকের বন্দনাই যেন সেদিন দেশের গণমাধ্যমে ফুটে উঠেছিল। কিন্তু পঞ্চগড়ের চাষাভুষাদের এতবড় মৃত্যুর মিছিলে মিডিয়ায় সে রকম শোরগোল পড়েনি। কারণ মৃত্যুর ওই মিছিলে দেশের উচ্চ নাগরিকদের কেউই ছিলেন না, হয়তো এ কারণেই মিডিয়ায় শোরগোল পড়েনি।

 

নাগরিকের শ্রেণিবৈষম্য শুধু এ দেশে নয়, পৃথিবীর অনেক দেশেই আছে। গণতন্ত্রের মুখোশে চলে সাম্রাজ্যবাদী নীতি-রীতির ব্যবহার। আমাদের দেশও এর থেকে ভিন্ন নয়। নৌপথ আর সড়কপথে মৃত্যুর মিছিলকে যেন আমরা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি হিসেবে বেছে নিয়েছি। আইন আছে, রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয়ে প্রয়োগকারী সংস্থাও আছে। অথচ সেই আইন কাগজেই থেকে গেছে।

 

সড়কপথ ও নৌপথের এসব দুর্ঘটনার কারণ এবং প্রতিকার নিয়ে আমরা বরাবরই নির্বিকার। উল্লেখযোগ্য বড় ঘটনাগুলোর একটিও বিচারের মুখ দেখেনি আজও।

 

 

নাগরিকদের প্রতি দরদ আর সহমর্মিতা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এক আন্তরিক সদিচ্ছা। যা থেকে এ দেশের মানুষ বঞ্চিতই থেকেছে বলা চলে।

 

পদ্মা, মেঘনা আর বুড়িগঙ্গার জল যেমনি শোক বয়ে চলছে নিরবধি তেমনি সুগন্ধা আর করতোয়ার জলে এখনো ফুঁসে উঠছে আর্তনাদের ঢেউ। স্বজনদের দীর্ঘশ্বাস প্রতিনিয়ত আছড়ে পড়ছে নদীগুলোর তীরে তীরে। বুক ধুকধুক করা চোখভেজা এমন শোকের কাব্য বারবার বুক মুচড়িয়ে তোলে আমার; আমার মতো এ দেশের অনেক মানুষেরও। দুঃসহ এসব যন্ত্রণায় চোখের কোণে ভেসে আসা নোনাজলের জলছবিতে তখন এও দেখি এসব দুর্ঘটনায় যদি দেশের কোনো মন্ত্রী বা তারচেয়ে বড় উচ্চ পদস্থ কেউ মারা যেতেন, তাহলে হয়তো এসব আইন কার্যকর হতো।

 

ধরে নেই আমার একমাত্র সন্তানটি সুগন্ধা নদীতে লঞ্চের আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়েছে। জীবিত সন্তানটি যখন ধীরে ধীরে আগুনে পুড়তে শুরু করেছে, আর ঝলসে যাচ্ছে তার দেহ! তখন তার আর্তনাদ কেমন ছিল! জলে ডুবে দম নিতে না পেরে যখন জল গিলতে গিলতে ফুসফুসে দম নেয়ার মতো আর জায়গা রইল না, তখন আপনার সন্তানটির অবস্থা কেমন ছিল! উফফ... এসব কষ্ট আর শোকের ব্যথা শব্দমালায় বর্ণনা করা যায় না।

 

একজন স্বজন প্রিয়জনের মৃত্যুর সময়টাকে বারবার এভাবেই কল্পনা করে। প্রিয়জনের মৃত্যুযন্ত্রণা তাকে অস্বাভাবিকরকম কাতর করে তোলে। কষ্টে-শোকে বুক ফেঁপে ওঠে, সামলাতে না পেরেই মানুষ আর্তনাদ করে।

 

মর্মন্তুদ এমন কল্পনা আজও করছে, সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডিতে আগুনের মধ্যখানে আটকে যাওয়া ২০ বছর বয়সি কেরানি ছেলের পিতা। (নামটা ভুলে গেছি) মৃত্যুর আগে কয়েক হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস আগুনের তাপে যখন তার শরীরের পাতলা চামড়া ঝলসে পড়ছিল তখনো বাবার সঙ্গে মোবাইল ফোনে আর্তনাদ করছিল ছেলেটি। এরপর একসময় কথা বন্ধ হয়ে যায়, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে অবর্ণনীয় এক বীভৎস কায়দায়। এমন নির্মম মৃত্যুর গল্প হয়তো আপনিও এ লেখা পড়ে সহ্য করতে পারবেন না।

 

আমার প্রশ্ন, এমন মর্মন্তুদ মৃত্যুর গল্পগুলো রাষ্ট্র বা সরকারের কর্তাদের হৃদয় কেন ছুতে পারছে না। আমরা সবদিকে এগিয়ে যাচ্ছি, তবে নাগরিকের নিরাপত্তায় কেন পিছিয়ে আছি?

গত ৪ জুন বিএম কনটেইনার ডিপোর সেই ভয়াবহ বিস্ফোরণে ফায়ার ফাইটারসহ ৪৯টি তাজা প্রাণ অঙ্গার হয়েছিল। কেউ অঙ্গার হয়েছে ধীরে ধীরে, কেউ হয়েছে টুকরো টুকরো ছিন্নভিন্ন হয়ে, আর কেউ মারা গেছেন মুহূর্তে।

 

এমনসব অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাগুলোকে সরকার ও তার প্রতিনিধিদের মরমে উপলব্ধি করতে হবে। তাহলেই আইন প্রয়োগে উপায় বের হয়ে আসবে। আমরা চাই এমন মর্মান্তিক ঘটনা আর না ঘটুক।

শারদের এই বিষাদ শুধু আমার নয়। যারা মনন-মানবিকতায় ও উদারতায় পোষণ করেন তাদেরও। এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠরা ইসলাম ধর্মাবলম্বী। অর্থাৎ শান্তির ধর্মের মানুষ। ইসলাম ধর্ম অন্যকে সহযোগিতা করার ধর্ম। অন্যের ধর্ম পালনে সহযোগিতা করার ধর্ম। অথচ প্রকৃত ইসলামকে আড়াল করে একশ্রেণির মানুষ সাম্প্রদায়িক আগুনেও দগ্ধ করে আমাদের। এ দেশের সহজ সরল মানুষকে বোকা বানিয়ে বেহেশতের টিকিট বিক্রি করছে একশ্রেণির মোল্লারা। অন্য ধর্মাবলম্বীদের বিধর্মী বানিয়ে মূর্তি ভেঙে বেহেশতে যাওয়ার ফতোয়া দিয়ে থাকেন এরা। অন্য ধর্মের মানুষকে নির্যাতন করলে, খুন ধর্ষণ আর লুটপাট করলে নাকি সামান্য শাস্তি হতে পারে, তবে বেহেশতে যাওয়া ঠেকাবে না আল্লাহ। মারাত্মক রকমের এসব অনাচারী বক্তব্য ইউটিউবের বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচার করছে ওই শ্রেণির মোল্লারা। অথচ শান্তির ধর্ম ইসলামে এসবের কোনো প্রশ্রয় নেই।

 

কুমিল্লার নানুয়ারদীঘির ঘটনা মনে করিয়ে দেয়, দেশের সহজ সরল মুসলমানরা মোল্লাদের ওইসব ফতোয়া গিলে খেয়েছে বলে যেকোনো উছিলায় অন্য ধর্মাবলম্বীদের ওপর অনায়াসে হামলা চালাতে পারে। এর বিপরীত চিত্র প্রতিবেশী দেশ ভারতেও আছে। সে দেশের উগ্র হিন্দুরা ধর্মীয় অপসংস্কৃতি আর অপপ্রচারে লিপ্ত হয়ে মুসলমানদের ওপর হামলা চালিয়ে হত্যা নির্যাতনের মতো ঘটনাও ঘটায়।

 

ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করায় দুদেশেই সাম্প্রদায়িক আগুনে পুড়ছে মানুষ। আমরা এ থেকে মুক্তি চাই। বাঙালির হাজার বছরের সামাজিক-সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন আবার ফিরে আসুক। শিল্প-সংস্কৃতিবিহীন গড়ে ওঠা রুক্ষ্ম প্রজন্মের মাঝে ফিরে আসুক কোমলতা আর মানবিক মূল্যবোধ। শরতের শুভ্র আলোতে মুছে যাক বিদ্বেষের কালো দাগ।

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

ভোরের আকাশ/ওএমএস/জেএস/

মন্তব্য

Beta version