-->

শুভ জন্মদিন গণতন্ত্রের মানসকন্যা

ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম
শুভ জন্মদিন গণতন্ত্রের মানসকন্যা

আজ মহান নেত্রী, গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনার শুভ জন্মদিন। ১৯৭৫ সালের পনেরো আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাত্তরের পরাজিত শক্তির নীলনকশায় এবং ক্ষমতালিপ্সু কুচক্রীদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নৃশংসভাবে সপরিবারে নিহত হন। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে সামরিক শাসনের জাঁতাকলে বাঙালি জাতি নিষ্পেষিত হতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতে গড়া সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ উপদলীয় কোন্দলে জর্জরিত হয় এবং একাধিকবার ভাঙনের মুখে পড়ে। ১৯৮১ সালের ১৭ মে দলের নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে জননেত্রী শেখ হাসিনা স্বজনহারা বাংলায় আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। এরপর একে একে কেটে গেল ৩৬ বছর। শেখ হাসিনা মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত মোকাবিলা করে আজ উঠে এসেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। বাঙালি জাতিকে নিয়ে গেছেন উন্নয়নের মহাসোপানে।

 

প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা আজ শুধু নিজ দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে। কীভাবে জননেত্রী শেখ হাসিনা অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠলেন, আমরা সে আলোচনায় আসি। দেশ ও মানুষের জন্য তার চ্যালেঞ্জের সাফল্য তাকে দেশের মধ্যেই নয়, আন্তর্জাতিক দুনিয়াতেও প্রবল আত্মবিশ্বাসের জায়গায় উঠিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- সামরিক শাসনের কবল থেকে গণতন্ত্র মুক্তি। ১৯৮১ সালে খুনি জিয়া খুন হয়ে যান এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে। প্রতিষ্ঠিত হয় একেবারেই দুর্বল, ষড়যন্ত্রকারীদের ক্রীড়নক বিচারপতি সাত্তারের পুতুল সরকার। সেই সরকারকে রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করে জেনারেল এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি হয়ে সামরিক শাসন জারি করেন। জাতির বুকে আবারও চেপে বসে সামরিক শাসনের জগদ্দল পাথর।

 

১৯৮২ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত ধারাবাহিক ছাত্র-গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর স্বৈরশাসক এরশাদের পতন হয়। এই আন্দোলন-সংগ্রামে দেশরত্ন শেখ হাসিনার দূরদর্শী অবিচল নেতৃত্ব জনগণকে গণতন্ত্র মুক্তির পথ দেখায়। ১৯৯১ সালে তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সূক্ষ্ম কারচুপির মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করা হয়। স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি তথা বিএনপি সরকার গঠন করে। নব্বইয়ের আন্দোলনের সকল অর্জন বিএনপি সরকার জলাঞ্জলি দেয়।

 

কিন্তু আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা জনগণের ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই অব্যাহত রাখেন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। ১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত মেয়াদে সরকারের উল্লেখযোগ্য সাফল্য হচ্ছে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার শুরু এবং জজ আদালতে এর বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন করা। দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা সহিংসতার অবসান ঘটিয়ে পার্বত্য শান্তি চুক্তি সম্পাদন করা। ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি ন্যায্যতার ভিত্তিতে সম্পন্ন করা। দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা। এর বাইরেও অনেক উল্লেখযোগ্য সাফল্য রয়েছে, যা এই স্বল্প পরিসরে লেখা সম্ভব নয়। জাতির দুর্ভাগ্য এই যে, শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর ২০০১ সালে নীলনকশার নির্বাচনে পুনরায় বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতাসীন হয়।

 

বেগম জিয়ার পুত্র তারেক রহমান হাওয়া ভবনখ্যাত বিকল্প ক্ষমতাকেন্দ্র গড়ে তুলে দেশের মানুষকে এক অবর্ণনীয় দুর্যোগের মধ্যে ফেলে দেয়। ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার জন্য বিচারপতিদের বয়স বাড়িয়ে সংবিধান সংশোধন করা হয়। এর বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, চৌদ্দ দল, মহাজোট তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। আন্দোলনের মুখে ইয়াজউদ্দিন সরকারকে হটিয়ে সেনা সমর্থিত মঈনুদ্দিন-ফখরুদ্দীনের সরকার গঠিত হয়। শুরু হয় ছদ্মবেশী সামরিক শাসন।

 

২০০৬ সালে নির্বাচন স্থগিত হয়ে যায়। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার জননেত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে বাধা দেয়; কিন্তু সব বাধা উপেক্ষা করে জনগণের টানে তিনি দেশে ফিরে আসেন। এরপর তাকে কারান্তরীণ করা হয়। জনগণের আন্দোলনের চাপে সেনা সমর্থিত সরকার জননেত্রী শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিয়ে ২০০৮ সালে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষিত বক্তব্য অনুযায়ী একাত্তরের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়, যা এখনও অব্যাহত আছে। কোনো কোনো বিচারের কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন এবং রায় কার্যকর হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা সর্বোচ্চ আদালত থেকে রায় হওয়ার পর হত্যাকারীদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। ২০০৯ সালে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো শেখ হাসিনা সরকার পরিচালনা শুরু করেন।

 

সরকার ও দল পরিচালনায় অভিজ্ঞ হাসিনার উত্তরোত্তর সাফল্যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। আন্তর্জাতিক মদদে জঙ্গিবাদের উত্থান এবং সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানের চক্রান্ত করা হয়। কিন্তু শেখ হাসিনার দৃঢ় পদক্ষেপের কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনী সব অপচেষ্টা রুখে দেয়। যদিও এখনো বিভিন্নভাবে সেই অপচেষ্টা বিদ্যমান আছে। ২০১৪ সালে সাংবিধানিকভাবে পরবর্তী নির্বাচন দেশের জন্য অপরিহার্য ছিল। কিন্তু সেই নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত অংশগ্রহণ না করে দেশকে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়। শত শত মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারে। গরুবোঝাই ট্রাক, শিশু-কিশোর এমনকি চলন্ত বাসও রক্ষা পায়নি। তারা কেটে ফেলে হাজার হাজার বৃক্ষ, তারা ভেবেছিল দেশে এমন পরিস্থিতি তৈরি করে দেশকে অস্থিতিশীল করে পুনরায় অসাংবিধানিক শাসনের দিকে নিয়ে যাবে। কিন্তু শেখ হাসিনার কঠোর মনোভাব এবং দক্ষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সে অবস্থা থেকে জাতি পরিত্রাণ পায়। সম্প্রতি আমাদের দেশের ওপর প্রকৃতির বিরূপ প্রভাব পড়ে।

 

চলতি বছরের এপ্রিলের প্রথম দিকেই হাওরাঞ্চলের সাতটি জেলা অকাল বন্যায় প্লাবিত হয়। বন্যার ফলে হাওরের মানুষ চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। শেখ হাসিনা মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে হাওর অঞ্চলের মানুষের পাশে দাঁড়ান, তাদের অব্যাহত সাহায্য-সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে। এর পরই দেশের উত্তরাঞ্চল আকস্মিক বন্যায় প্লাবিত হয়। দেশের এক-তৃতীয়াংশ ফসল বিনষ্ট হয়ে যায়। মানবতাবাদী নেত্রী শেখ হাসিনা উত্তরাঞ্চলের বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন। উনি নিজেই ত্রাণ তৎপরতা তদারকি করছেন। এরই মধ্যে শুরু হয়ে যায় নতুন আন্তর্জাতিক চক্রান্ত।

 

মিয়ানমার থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে নাফ নদী অতিক্রম করে বাংলাদেশে ঢুকতে থাকে। বাঙালি জাতি এবং তার নেত্রী শেখ হাসিনা মানবতার খাতিরে সীমান্ত উন্মোচন করে দেন। মিয়ানমারের এই গণহত্যায় কয়েক হাজার রোহিঙ্গা নিহত হয়। তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয় এবং হাজার হাজার নারী ধর্ষণের শিকার হন। এমতাবস্থায় তাদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের আশ্রয় দেয়া- মানবিক দৃষ্টিতে আমাদের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায়। নেত্রী শেখ হাসিনা মানবতার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে আক্রান্ত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই’- এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। এ ছাড়া রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কীভাবে করা যায়- এ ব্যাপারে ভারত, চীন ও রাশিয়ার ভিন্নমত থাকলেও নেত্রী তাদের সহমতে আনার চেষ্টা করছেন।

 

জাতিসংঘ মহাসচিব দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ মিয়ানমার সরকারকেই নিতে হবে। আমরা রোহিঙ্গা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই এবং তা কার্যকরী করতে হলে প্রধানমন্ত্রী যে প্রস্তাবগুলো দিয়েছেন, তার কোনো বিকল্প নেই। প্রধানমন্ত্রী এখন আমেরিকায় আছেন। তার গল ব্লাডারের সফল অপারেশন হয়েছে। এখন উনি সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন এবং দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন। আমরা মানবতাবাদী নেত্রী শেখ হাসিনার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি। বাংলাদেশের মানুষ প্রাণভরে দোয়া করছে, নেত্রী যেন দ্রুত সুস্থ ওঠেন। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনে এই আশাবাদ ব্যক্ত করতে চাই যে, জঙ্গি, রোহিঙ্গা সমস্যা, বন্যা, মহামারি, চালের দামের ঊর্ধ্বগতি, জামায়াত-বিএনপির চক্রান্ত, যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত, তা সফলভাবে মোকাবিলা করে দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে যাবেন এবং আগামী নির্বাচনেও শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হবে।

 

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কো. লি.

মন্তব্য

Beta version