-->

বাংলাদেশের বিশ্বায়নে শেখ হাসিনা

মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান
বাংলাদেশের বিশ্বায়নে শেখ হাসিনা

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকহানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে বাঙালি জাতি লাল-সবুজের পতাকা হাতে বিশ্ববাসীকে জানিয়েছিল- এটি একটি স্বাধীন দেশের পতাকা এবং সেই জাতির পিতার নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, দেশটির নাম বাংলাদেশ। বিশ্বের মানচিত্রে একটি দেশের স্থান করে নেয়ার মাধ্যমে বাঙালি জাতির বিশ্বায়নের যে সূচনা, তা সুদৃঢ় হয়েছিল ১২১ দেশের স্বীকৃতির অর্জন ও ১৯৭৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের মাধ্যমে। তবে বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল একই বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বঙ্গবন্ধুর বাংলায় ভাষণদানের মধ্য দিয়ে। সেই অগ্রযাত্রা আরো সুসংহত এবং সমুন্নত রেখেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।

 

বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে উত্থান-পতন, পরাশক্তির মধ্যে ঠান্ডা লড়াই, কখনো যুদ্ধ-বিগ্রহ, জঙ্গিবাদ এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যেও বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক আর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে সমানতালে। গত ২৪ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের ৭৭তম অধিবেশনে একইভাবে বাংলায় ভাষণ দিয়েছেন। কোনো গণতান্ত্রিক সরকারপ্রধান হিসেবে ১৭তম ভাষণ দেয়ার নজির এটাই প্রথম।

 

এ ভাষণে তিনি যেমন আন্তর্জাতিক ইস্যু নিয়ে সোচ্চার ছিলেন, তেমনি তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের সাফল্য আর অগ্রগতির কথা। আমরা জানি, একটা দেশের পররাষ্ট্রনীতি হচ্ছে সেদেশের অভ্যন্তরীণ নীতির সম্প্রসারিত এবং সংযোজিত অংশ। অর্থাৎ দেশটি যে নীতি আর কর্মপদ্ধতি নিয়ে চলে, তাকে কেন্দ্র করেই সমন্বিত করা হয় বৈশ্বিক পদক্ষেপ। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো বা সোনার বাংলা গড়ে তোলার যে প্রত্যয়, বিজ্ঞানমনষ্ক ও প্রযুক্তিনির্ভর জাতি গঠন, অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরের যে পদক্ষেপ এবং সাফল্য, তার ওপর ভিত্তি করেই কোনো দেশের ইতিবাচক ইমেজ গড়ে ওঠে। আর উঠলেই হয় না তাকে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে কৌশলগতভাবে উপস্থাপন করাও পররাষ্ট্রনীতির দাবি- শেখ হাসিনা দেশে-বিদেশে সেই সাফল্যের কথাই তুলে ধরছেন।

 

সাফল্যগুলো কী? অর্থাৎ কোনো অর্জনের গুণগত সাফল্যে বিশ^বাসীকে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করেন। আয়তনে ছোট এবং ঘনবসতিপূর্ণ হলেও অন্তত ১৫টি ক্ষেত্রে ছাড়িয়ে গেছে এশিয়ার অনেক দেশকে। যেমন কৃষি উৎপাদন, মাথাপিছু আয়, নারী ও শিশু অধিকার, জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমন, দারিদ্র্য নিরসন, সবার জন্য শিক্ষা, ডিজিটাল বাংলাদেশ ও প্রযুক্তিনির্ভর জীবনযাত্রা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অন্যতম। করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনর্বাসন আর চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম অবস্থানকারী দেশ। এভাবে তলাবিহীন ঝুড়ির দেশের সে তথাকথিত নেতিবাচক ইমেজ থেকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরের এক সম্ভাবনাময় দেশ বাংলাদেশÑ শেখ হাসিনা সেই পরিবর্তনের চিত্রই তুলে ধরেন বিশ্ববাসীর কাছে।

 

শুধু বাংলাদেশের কথা নয়, তিনি জাতিসংঘের সাম্প্রতিক অধিবেশনে আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গেও তুলে ধরেছেন ছয়টি প্রস্তাব, যার মধ্যে জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষায় ধনী দেশের দায়িত্ব, অভিবাসীদের সমস্যা, নিষেধাজ্ঞা ও পুনর্নিষেধাজ্ঞায় বিশ্বমন্দা পরিস্থিতি, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন অন্যতম। এ অধিবেশনে এসডিজি অর্জনে কাক্সিক্ষত অগ্রগতি অর্জন করায় এসডিজি পুরস্কার দেয়া হয় তাকে। টানা তিনবারের সরকারপ্রধান হিসেবে দেশে এবং বিদেশে তার গতিশীল পদচারণায় বাংলাদেশের মানুষ গর্বিত জাতি হিসেবে পরিচয় দিতে উৎসাহবোধ করে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের যেকোনো প্ল্যাটফর্মে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে তার বিবেচনাপ্রসূত প্রস্তাবনা বাংলাদেশের মর্যাদাকে সমুন্নত করে।

 

বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভিশনারি নেতৃত্ব, সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে শান্তি, গণতন্ত্র, দারিদ্র্যবিমোচন, উন্নয়নের জন্য ও সাফল্যের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিস্বরূপ অর্ধশতাধিক পদক ও ডিগ্রিতে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদানের জন্য ইউনেস্কো শেখ হাসিনাকে ১৯৯৮ সালে ‘ফেলিক্স হোফে বোইনি’ শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করে। শেখ হাসিনা শান্তিনিকেতনে বিশ্ব ভারতী আয়োজিত এক বিশেষ সমাবর্তনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘দেশিকোত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। শান্তি ও সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠায় অবদানের জন্য নিখিল ভারত শান্তি পরিষদ ‘মাদার তেরেসা’ পদক প্রদান করে। দেশ ও জনকল্যাণে অসামান্য অবদানের জন্য প্রধানমন্ত্রী ফোর্বস ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ২০২১ সালে বিশ্বের প্রভাবশালী ৫০ নারীর তালিকায় তিনি অবস্থান করে নিয়েছেন। ক্ষুধার বিরুদ্ধে আন্দোলনের অবদানস্বরূপ জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (এফএও) কর্তৃক ‘সেরেস পদক’ লাভ করেন। ২০১০ সালের ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পদক ২০০৯’-এ ভূষিত হন। ২০১০ সালে শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আনায় জাতিসংঘ ‘এমডিজি পুরস্কার’ প্রদান করে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে দূরদর্শী নেতৃত্ব, সুশাসন, মানবাধিকার রক্ষা, আঞ্চলিক শান্তি ও জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সচেতনতা বৃদ্ধিতে অবদানের জন্য ইংল্যান্ডের হাউস অব কমন্সের স্পিকার জন বারকো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘গ্লোবাল ২০১৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর খাদ্য নিরাপত্তা ও দারিদ্র্যবিমোচনে অবদানের জন্য ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর সাউথ-সাউথ কো-অপারেশন ‘সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ড ২০১৩’ পুরস্কার প্রদান করে।

 

২০১৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে সমন্বিত টিকাদান কর্মসূচিতে ব্যাপক সফলতার জন্য গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন (জিএভিআই গ্যাভি) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ সম্মাননায় ভূষিত করে। এ ছাড়া নারী ও শিশুশিক্ষার উন্নয়নে বিশেষ অবদানের জন্য শান্তি বৃক্ষ পদক, সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ড, জাতিসংঘের মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল অ্যাওয়ার্ড, ডিপ্লোমা অ্যাওয়ার্ড, কালচারাল ডাইভার্সিটি অ্যাওয়ার্ড, গ্লোবাল ডাইভার্সিটি অ্যাওয়ার্ড, ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পদক, ডক্টরস অব হিউম্যান লেটার্স পদক অর্জন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।’ বিশ্ব ফোরামই শুধু নয়, বিশ্ব গণমাধ্যমেও তার সহজ ও প্রাণবন্ত অংশগ্রহণ দেশের সাফল্যের কথা প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তিনি বিবিসি, সিএনএন, আলজাজিরা, গালফ নিউজ, খালিজ টাইমস, দি গার্ডিয়ান, রয়টার, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, টেলিগ্রাফসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সপ্রতিভ ছিলেন সবসময়। উত্তর দিয়েছেন বিভিন্ন অপ্রিয় প্রশ্নের, ব্যাখা করেছেন অনেক নেতিবাচক প্রসঙ্গকে। এভাবেই কখনো বিশ্বমঞ্চ, কখনো বিশ্ব মিডিয়ায় তুলে ধরেছেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ। রোহিঙ্গা সমস্যার ৫ বছর হয়ে গেল। উসকানির মুখে কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত না নিয়ে তিনি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক ফোরামে শান্তিপূরণ সমাধানের আহ্বান জানাচ্ছেন। মানবতার জননী তার কূটনৈতিক তৎপরতায় বাংলাদেশকে যে মর্যাদায় উন্নীত করেছেন, সে একই ধারায় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সমস্যাগুলো সমাধান করবেন। সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির অনুসরণে শেখ হাসিনা ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’- এ নীতির অনুসরণে সব সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে একটি গ্রহণযোগ্য রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন, যা বাংলাদেশের ইমেজকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দৃঢ় ভিত্তি দিতে সক্ষম হয়েছে। সগৌরবে এ ধারা অব্যাহত থাকুক।

 

লেখক : কলামিস্ট ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version