-->
পদ্মা সেতু

ভূ-রাজনৈতির মহাকাব্যিক গেম চেঞ্জার

ড. দেলোয়ার হোসেন
ড. দেলোয়ার হোসেন
ভূ-রাজনৈতির মহাকাব্যিক গেম চেঞ্জার
স্বপ্নের পদ্মা সেতু দিয়ে যান চলাচল শুরু

পদ্মা সেতু এখন আর কল্পনা নয়। বাঙালি জাতির স্বপ্নের সেতু আজ বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করেছে,সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। স্বপ্ন পূরণের এই ঐতিহাসিক ঘটনা নিঃসন্দেহে এক মহাকাব্য। পদ্মাসেতুকে কেন্দ্র করে বাংলার সাধারণ মানুষের রয়েছে সোনালী স্বপ্ন। যার মূলে রয়েছে বাংলাদেশকে আরো উন্নত-সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে মর্যাদাপূর্ণ আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করা। ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে জাতি স্বাধীনতা অর্জন করেছে, সেই জাতি কখনই পিছিয়ে থাকার নয়। এই অকাট্য সত্য আবোরো প্রমাণিত হল। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী তথা ইতিহাসের মাহেন্দ্রক্ষণে পদ্মা সেতুর মত একটি স্বপ্নময় স্থাপনার বাস্তবায়ন দেখতে যাচ্ছে বিশ্ব। দক্ষিণ এশিয়া, বঙ্গোপসাগর অঞ্চল তথা আঞ্চলিক উপনিবেশিক প্রেক্ষাপটে পদ্মা সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। একই সাথে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কিংবা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রশ্নে পদ্মা সেতু একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এই ইতিহাস রচনায় নেতৃত্বে দিয়ে বাঙালির লালিত স্বপ্নে বাস্তবতার রঙ চড়িয়েছেন জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

পদ্মা সেতু মূলত একটি আইকনিক ডেভেলপমেন্ট। এই আইকনিক ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের পেছনের যে ঘটনা অর্থাৎ পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করতে যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে তা ছিল ‘ইউনিক’। কারণ আমরা জানি যে, অবকাঠামোর উন্নয়ন বিশ্বের যেকোন দেশ বা জাতির জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আজকের বিশ্বকে আমরা যদি দু’ভাগে বিভক্ত করিÑএকদিকে উন্নত বিশ্ব, অন্যদিকে উন্নয়নশীল বা অনুন্নত বিশ্ব; অথবা একদিকে উত্তর, অন্যদিকে দক্ষিণ; অথবা একদিকে ধনী রাষ্ট্র, অন্যদিকে দরিদ্র রাষ্ট্র: এই যে বিভাজন; এই বিভাজনের মধ্যে আমরা যে রাষ্ট্রগুলোকে উন্নত বলছি, সে রাষ্ট্রগুলোর ইতিহাসও অনেক দীর্ঘ। লক্ষ করার মত বিষয় হল, পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউরোপের দেশগুলো শত শত বছর ধরে তাদের উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনা করে আসছে। এমনকি বিশ্বে উপনিবেশিক শাসন পরিচালনার মাধ্যমে তারা উন্নত হয়েছে কয়েকশ বছরে। তাদের এই যে উন্নয়ন, এই উন্নয়নের পূর্বশর্তই ছিল সেই দেশ বা অঞ্চলগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং এর মাধ্যমেই তারা তাদের সভ্যতার জানান দিয়েছে। আর এ পথ ধরেই এসেছে গণতন্ত্র বা রাজনৈতিক পরিবর্তনগুলো। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, প্রাকৃতিক বা পরিবেশগত পরিবর্তন এসেছে। একইভাবে আমরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বা পূর্ব এশিয়ার যে টাইগার ইকোনোমি বা ড্রাগন ইকোনোমির কথা বলি, সেই অর্থনীতির বিকাশও কিন্তু হচ্ছে অবকাঠামোর হাত ধরেই। অর্থাৎ অবকাঠামো একটি দেশে যতদ্রুত প্রতিষ্ঠিত হয়ে জনমানুষের দ্বোরগোড়ায় চলে যাবে, তত দ্রুত সেই দেশ বা জাতি উন্নয়ন-সভ্যতার ক্ষেত্রে কয়েকধাপ এগিয়ে যাবে। সেদিক থেকে পদ্মা সেতু কিংবা পদ্মা সেতুর মত মেগা প্রজেক্টগুলো যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে তা সহজেই দৃষ্টিগোচর হয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পূর্ব এশিয়া এমনকি আমাদের প্রতিবেশী ভারতের ইতিহাসও সে কথাই বলছে।

সাম্প্রতিক সময়ে চলমান ইউক্রেন যুদ্ধের মূল প্রতিযোগিতা চলছে প্রকৃতপক্ষে এশিয়া অঞ্চলে। তাছাড়া বিআরআই, কোয়াড এমনকি সাম্প্রতিক ওকাস ও অতি-সাম্প্রতিক আইকিউএস-এর মতো গ্রুপগুলোর প্রতিযোগীতা-প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক খেলায় বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ‘এ্যাক্টর’ হয়ে উঠেছে। এইরূপ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ একটি ‘উন্নয়ন হাব’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের উন্নয়নকে এই অঞ্চল-গ্রুপগুলোর সমন্বিত উন্নয়ন হিসেবে গণনা করা হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে যদি আমরা পদ্মাসেতুর গুরুত্ব বিবেচনা করি, তবে সামনের দিনগুলোতে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা আরো বৃদ্ধি পাবে-সন্দেহ নেই

স্নায়ুযুদ্ধ বা স্নায়ুযুদ্ধের পরের বিশ্ব কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর প্রেক্ষাপটে উন্নয়নশীল বিশ্বের বা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য দাতাগোষ্ঠীগুলোর ভূমিকা আমরা লক্ষ করে থাকি। দাতাগোষ্ঠী হিসাবে আমরা যদি রাষ্ট্র অথবা বিভিন্ন সংস্থাকে বিবেচনা করি, সেক্ষেত্রে তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা চোখে পড়ে। এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক একটি বড় রোল প্লে করে, যদিও ¯œায়ুযুদ্ধোত্তরকালে বিশ্বব্যাংকের প্রভাব বা অল ক্যাপাসিটি কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। অন্যান্য দাতাগোষ্ঠী বিশেষ করে আইডিবি, ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন, জাইকার মতো গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাগুলো তহবিলের উৎস হয়ে উঠেছে। এদের প্রত্যেকেরই এক ধরনের আগ্রহ ছিল পদ্মা সেতুকে ঘিরে। একটি অংশগ্রহণও তৈরি হয়েছিল বিশ্বব্যাংকের নেৃতত্বে। কিন্তু পরবর্তীকালে আমরা একটি বিরল ঘটনা প্রত্যক্ষ করলাম, সচরাচর ঘটেনি এমন একটি ঘটনার অবতারণা করে বিশ্বব্যাংক। পদ্মা সেতুর বিষয়ে যখন সরকার চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে পড়ে, এমনকি একটি সোনালী স্বপ্ন জনমানুষের সামনে উপস্থিত, ঠিক তখন বিশ্বব্যাংক অদ্ভূত অজুহাত সামনে আনেÑপদ্মা সেতুকে ঘিরে এক ধারনের কল্পিত দুর্নীতির গল্প ফেঁদে অযাচিত অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। সেই অভিযোগের বিষয়টি সরকার যেমন প্রত্যাখান করে, দেশের জনগণও প্রত্যাখান করে। কারণ সেই অভিযোগের ধরন-প্রেক্ষাপট-পরিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় কোনভাবেই পদ্মা সেতু থেকে বিশ্বব্যাংকের তহবিল প্রত্যহারের ঘটনা ঘটার কথা নয়। প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের নিজস্ব বক্তব্য কিংবা চাহিদা থাকতে পারে, কিন্তু বিশ্বব্যাংক বা কোন দাতাগোষ্ঠীর প্রকল্প থেকে এভাবে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া আন্তর্জাতিক রাজনীতির ইতিহাসে কিংবা বিশ্ব অর্থনীতির ইতিহাসে আমরা পূর্বে লক্ষ্য করিনি। একটি বিশাল প্রকল্প থেকে হঠাৎ এভাবে সরে আসার ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং নিতান্তই অনাকাঙ্খিত। একথা বললে অত্যক্তি হবে না যে, পদ্মা সেতুকে ঘিরে বিশ্ব রাজনীতির যে খেলা কিংবা দেশের অভ্যন্তরে যে সমস্ত ঘটনার জš§ তা বিশ্বব্যাংকই তৈরি হবার সুযোগ করে দিয়েছে।

বহু জল্পনা-কল্পনা, হিসাব-নিকাশের অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছে শেখ হাসিনার সরকার। সর্বসাধারণের জন্য এই সেতু খুলে দেওয়ার সাথে সাথে আর্থিক দিক দৃশ্যমান হয়ে উঠবে। পদ্মা সেতু দ্বারা একবারে তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত ব্যাপকভাবে সুফল পাওয়া যাবে। শুধু বাংলাদেশই নয়, আঞ্চলিক-উপআঞ্চলিক ও এশিয়া এবং বৃহৎ পরিসরে বিশ্ব প্রেক্ষাপটে পদ্মা সেতু একটি ‘গেম চেঞ্জার’ হিসেবে কাজ করবে। এই সেতুর মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার লাখ লাখ লোকের সংযোগ তৈরি হবে রাজধানী ঢাকার সাথে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন-সমৃদ্ধিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এটা আজ সর্বজনস্বীকৃত যে, বর্তমান বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে একটি উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বিশেষ করে, দেশের বিগত পনের বছরের অর্থনৈতিক উন্নতি চোখে পড়ার মতÑযা দেশকে এনে দিয়েছে এক অনন্য মর্যাদা। এ কথা আজ সর্বজনবিদিত যে, আমরা এখন মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হয়েছি, উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জন করেছি জাতিসংঘের কাছ থেকে। কাজেই স্বীকার করতেই হবে, পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দেশের জিডিপি বৃদ্ধি পাবে। অর্থাৎ, এই সেতুর মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে, তৃণমূল পর্যায়ের মানুষ উপকৃত হবে এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র আরো বিকশিত হবে। ভুলে গেলে চলবে না, যোগাযোগ হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র উপায় যার মাধ্যমে অর্থনৈতিক মেলবন্ধন তৈরি হয়, সম্পর্কের সেতু গড়ে ওঠে। মূলত বিভিন্ন ক্ষেত্রে মেলবন্ধন তৈরি করতে হলে যোগাযোগের গুরুত্ব সর্বাধিক। ফলে সেদিক থেকে আমরা যদি পদ্মা সেতুকে দেখি, তবে দেখতে পাবোÑপদ্মা সেতুর মাধ্যমে অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক বিকাশের সাথে সাথে গ্রামীণ জীবনাচরণেও আসবে আমূল পরিবর্তন। ব্যক্তি পর্যায়ে যে বিকাশ ঘটবে, তার সুফল পড়বে দেশের জাতীয়-আন্তর্জাতিক পরিসরে। এই সুফল ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। আমরা দেখছি, পদ্মা সেতুকে ঘিরে উন্নয়ন-সমৃদ্ধির সুবিশাল উৎসব-আয়োজন শুরু হয়েছে। পদ্মাসেতুর উদ্ভোধনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হতে শুরু করবে এই চিত্র। বাস্তবতা এখন এটিই। উপরন্তু, পদ্মাসেতু এই অঞ্চলের পরিমন্ডলে বিশেষত বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চল কিংবা উপ-আঞ্চলিক এলাগুলোতে ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন বয়ে আনবে।

ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনায় বাংলাদেশকে বলা হয় দক্ষিণ-পূর্ব তথা ‘দক্ষিণ এশিয়ার সেতু’। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে, বিশ্বের বর্তমান অন্যতম দুই শক্তিধর রাষ্ট্র ভারত এবং চীনের মধ্যেও বাংলাদেশ একটি ‘গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর’ হিসেবে কাজ করছে। বলা বাহুল্য, বর্তমান বিশ্বে উন্নয়নের সুতিকাগার ইউরোপ নয়, বরং এশিয়া। কেননা, এই অঞ্চলের বেশ কয়েকটি দেশ একের পর এক চমক দেখিয়ে চলেছে। চীন, ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ডের মতো রাষ্ট্রের উপস্থিতি আছে এই এলাকায়, আছে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের মত দেশ। অর্থাৎ বর্তমান বিশ্বের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র হলো এশিয়া। এবং এই এশিয়ার দেশগুলোর দিকে যদি আমরা তাকাই তবে দেখতে পাবো, এই অঞ্চলে বাংলাদেশের অবস্থান একবারে কেন্দ্র পর্যায়ে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নয়ন মানেই হচ্ছে এশিয়ার উন্নয়ন: আঞ্চলিক বাণিজ্যের উন্নয়ন, আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বিবিআএন (বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, নেপাল)-এর মতো সাব-রিজিওনাল গ্রুপগুলোর অন্তর্ভূক্ত দেশগুলোর উন্নয়ন। এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখা হচ্ছে, পদ্মা সেতুর মাধ্যমে বাংলাদেশের সাথে এশিয়ান হাইওয়ের একটি সংযোগ তৈরি হবে। তাছাড়া সার্ক, বিমসটেকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর আঞ্চলিক করিডোর তৈরির বিষয়ে যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, তার সাথে বাংলাদেশকে সহজ-সাবলীলভাবে যুক্ত করবে। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া কিংবা পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোর সাথেই শুধু নয়, বৃহত্তর পরিসরে বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের যোগাযোগ বাড়ার মাধ্যমে আন্তর্জািতক সম্পর্কের নতুন ভীত রচিত হবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়নের সাথে তাল মিলিয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমানেরও ব্যাপক উন্নয়ন ঘটবে। আমরা জানি যে, এই অঞ্চল একটি ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের মধ্যে রয়েছে; কাজেই পদ্মা সেতুর মাধ্যমে এই এলাকার উল্লেখযোগ্যসংখ্যক যুবসম্প্রদায় ডিভিডেন্টের সুবিধা নিতে পারবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, সাম্প্রতিক সময়ে চলমান ইউক্রেন যুদ্ধের মূল প্রতিযোগিতা চলছে প্রকৃতপক্ষে এশিয়া অঞ্চলে। তাছাড়া বিআরআই, কোয়াড এমনকি সাম্প্রতিক ওকাস ও অতি-সাম্প্রতিক আইকিউএস-এর মতো গ্রুপগুলোর প্রতিযোগীতা-প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক খেলায় বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ‘এ্যাক্টর’ হয়ে উঠেছে। এইরূপ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ একটি ‘উন্নয়ন হাব’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের উন্নয়নকে এই অঞ্চল-গ্রুপগুলোর সমন্বিত উন্নয়ন হিসেবে গণনা করা হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে যদি আমরা পদ্মাসেতুর গুরুত্ব বিবেচনা করি, তবে সামনের দিনগুলোতে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা আরো বৃদ্ধি পাবে-সন্দেহ নেই।

মোটাদাগে আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পদ্মাসেতুর বাস্তবায়নের মাধ্যমে বর্তমান সরকারের প্রতি বিশ্ব রাজনীতির আস্থা বেড়েছে, বিশ্বনেতারা বর্তমান নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল হয়েছেন; যার ফলে শেখ হাসিনার সরকার বিশ্ব পরিমন্ডলে সমীহ পাচ্ছে, যা আগামীতে আরো বৃদ্ধি পাবে। এক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতে হয়, বাংলাদেশের সক্ষমতা বিশ্বকে চমকে দিয়েছে বিধায় বিশ্ব নেতৃত্ব বর্তমান সরকারের প্রতি যেকোন সময়ের চেয়ে এখন অধিক আস্থাশীল, যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনার নতুন নতুন দ্বার উন্মোচন করবে। নানা প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করে পদ্মা সেতুর বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ যে বিষ্ময় দেখিয়েছে, সমসাময়িক বিশ্বে অন্য কোন স্বল্পোন্নত কিংবা উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে তা খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমনকি উন্নত বিশ্বের ক্ষেত্রেও এ রকম নজির বিরল। কারিগরী সফলতা হলো পদ্মাসেতু বাস্তবায়নে আরেকটি কৃতিত্ব: নিজস্ব শ্রম-মেধার সন্নিবেশ ঘটিয়ে এই সেতু বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ কারিগরী সক্ষমতার প্রশ্নে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।

বিভিন্ন প্রতিকূলতাকে পাশ কাটিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মার মতো একটি খর¯্রােতা নদীতে স্বপ্নের সেতুর সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বপরিমন্ডলে যে নবযাত্রা শুরু করেছে তা দেশকে, দেশের মানুষকে বিশ্বপরিমন্ডলে-বিশ্বরাজনীতিতে নতুন পরিচয় এনে দিয়েছে। এমনকি এই সেতুকে ঘিরে যাদের ভেতর এক ধরনের সন্দেহ-পরশ্রীকাতরতা জেগে উঠেছিল তারাও এই অর্জনকে বাহবা দিচ্ছে। সবমিলিয়ে পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট মহাকাব্য। তবে, এটা ভুলে গেলে চলবে না, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এই যে অর্জন-সমৃদ্ধি-এগিয়ে যাওয়া, এটিকে ম্লান করে দেওয়ার মতো শক্তি-গোষ্ঠী ওৎ পেতে আছে দেশের অভ্যন্তরে এমনকি বিশ্বপরিমন্ডলেও। কাজেই অপশক্তিগুলোর বিষয়ে আমাদেরকে সদা সজাগ থাকতে হবে। একই সঙ্গে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের উৎসব-আয়োজনের সাথে সাথে দেশের উন্নয়ন-সমৃদ্ধি বিঘœকারীদের প্রতিও আমাদের সতর্ক অবস্থানে থাকতে হবে। দেশে-বিদেশে এখনও অনেকে বাংলাদেশকে সত্তর-আশির দশকের প্রাকৃতিক দৃর্যোগ কবলিত দরিদ্র দেশ হিসেবে দেখে থাকে। আবার অনেকে বর্তমান সাফল্য, সমৃদ্ধি, উন্নয়নকে সহ্য করতে চায় না কিংবা অস্বীকার করেÑএই সমস্ত বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে। বিশ্বের এমন অনেক দেশ রয়েছে যারা ভূ-রাজনৈতিক কিংবা বিভিন্ন দিক দিয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ হবার পরও অধিক গুরুত্ব-প্রচার পায়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সুবিধা পায়। সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশ যেন পদ্মা সেতুর মতো অবকাঠামো নির্মাণে সহায়তার প্রশ্নে নায্য অধিকার থেকে অযাচিতভাবে বঞ্চিত না হয়ে পড়ে সে বিষয়ে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। বিচক্ষণ, দূরদর্শী, চৌকশ নেতৃত্ব এবং সঠিক কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে পদ্মা সেতুর সফল বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছি আমরা। এই মহাকাব্যিক অর্জন বিশ্বরাজনৈতিক পরিমন্ডলে আমাদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছে অনন্য মর্যাদায়-অনন্য উচ্চতায়। মর্যাদার এই আসন ধরে রাখতে হবে। বিশ্ব রাজনীতি তথা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রতিটি পথচলায় লাল-সবুজের এই মহাকাব্যিক অগ্রযাত্রাকে উঁচিয়ে ধরে নায্য অধিকার আদায়ে সোচ্চার হতে হবে।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সদস্য

 

মন্তব্য

Beta version